বিচ্ছিন্ন কয়েকটি দ্বীপ যেভাবে ক্রিকেট মাঠে হয়ে ওঠে 'ওয়েস্ট ইন্ডিজ'

২০৬২ পঠিত ... ২০:৩৫, জুন ১০, ২০১৯

প্রায় তিন দশক ক্রিকেট বিশ্বকে রীতিমত শাসন করেছিল দলটি। একের পর এক ওয়ানডে ও টেস্ট ম্যাচ জিতে ক্রিকেট সাম্রাজের একচ্ছত্র অধিপতির আসনে বসা সেই দল রঙ হারিয়েছে অনেকদিন হলো। ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসদের, গ্যারি সোবার্সদের হাত ধরে সে সময়ে ক্রিকেটের দুই ফরম্যাটেই টানা ১৫ বছর অপরাজিত ছিলো যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তারা আজকের টেস্ট বা ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ের নিচের দিকের দল। টেস্ট র‍্যাংকিংয়ে এখন দুই-তিন-চার নম্বরে নয়, একেবারে আট নম্বরে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ!

তবে সুসময়ের ছিটেফোটা না থাকলেও এই টিটুয়েন্টির যুগে ‘পাওয়ার ক্রিকেট’ নামক শব্দের অবতারণ করে বেশ দাপটের সঙ্গেই ক্রিকেট বিশ্বে পদার্পণ করে দলটি। চমৎকার ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখিয়ে দুইবার টিটুয়েন্টি বিশ্বকাপও জয় করে নিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ক্রিকেট বিশ্বে অন্য সব দল নির্দিষ্ট কোন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করলেও এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিন্তু কোন দেশ নয়। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামে পৃথিবীর মানচিত্রে কোন দেশ খুঁজে পাবেন না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ মূলত কোন দেশ না, এটি একটি ক্রিকেটের ‘মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশন’। কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপদেশ মিলেই তৈরি হয়েছে এই উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। মধ্য আমেরিকার পাশে ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত ১০টি ইংরেজিভাষী ক্যারিবীয় দেশ, ৩টি ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটরি, ১টি করে ডাচ ও মার্কিন ওভারসিজ টেরিটরি, এই ১৫টি দ্বীপদেশ মিলে এই ‘দেশ’এর প্রতিষ্ঠা। যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের সমন্বয় ঘটেছে। জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ, বার্বাডোজসহ একাধিক দেশের খেলোয়াড়রা এই দলকে প্রতিনিধিত্ব করেন।

ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গোড়াপত্তনের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৮৯০ এর দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৯২৬ সালে তৎকালীন ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড বা ডব্লিউআইসিবিতে যোগদান করে। এরপরই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম আন্তর্জাতিক খেলায় অংশগ্রহণ করে। এর দু’বছর পরই ১৯২৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল চতুর্থ টেস্ট খেলুড়ে দলের মর্যাদা লাভ করে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই বিখ্যাত পেস কোয়ার্ট্রেট

সব দলই তাদের নিজেদের দেশের জাতীয় পতাকা ক্রিকেটে ব্যবহার করে। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট দেশ নয় বরং দেশ-সমষ্টি, তাই এর কোনো পতাকাও নেই। পতাকার সমস্যা সমাধানের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড একটি প্রতীকী পতাকার ডিজাইন করে। চারপাশে গাড় তামা বর্ণ আর মাঝখানে রৌদ্রজ্বল একটা দ্বীপে একটা পাম গাছ। দ্বীপের উপর ক্রিকেটের স্টাম্প। এটাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্তমান পতাকা। এই ডিজাইন অবশ্য আগে বেশ কয়েকবার বদলেছেও।

আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলতে গেলে দলগুলোকে ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাইতে হয়। দেশ না হওয়ায় উইন্ডিজের কোন জাতীয় সংগীত থাকা সম্ভব নয়। আইসিসির টুর্নামেন্টে জাতীয় সংগীত হিসেবে তারা ডেভিড রুডারের ‘র‍্যালি রাউন্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ গানটি গেয়ে থাকে। গানটি তাদের অঞ্চলের ক্রিকেট স্পিরিট, আবেগ ও প্রাণবন্ত জীবনের কথাই ফুটিয়ে তোলে।

উইন্ডিজের প্রতিটি দেশেই ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। আছে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট দলও। তবে উইন্ডিজ ক্রিকেটের প্রভাবশালী চারটি সংস্থা হলো জ্যামাইকা ক্রিকেট বোর্ড, বার্বাডোজ ক্রিকেট বোর্ড, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো ক্রিকেট বোর্ড, গায়ানা ক্রিকেট বোর্ড। এই ৪টি ছাড়া বাকি ১১টি দেশ লিওয়ার্ড আইল্যান্ডস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন এবং উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ডস ক্রিকেট বোর্ড অফ কন্ট্রোল-এর অন্তর্গত। উত্তরের ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলো লিওয়ার্ড এবং দক্ষিণের দ্বীপগুলোকে উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ডস বলা হয়।

বর্তমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে অবশ্য সবগুলো দেশ থেকে ক্রিকেটার নেই। বর্তমান দলের খেলোয়াড়রা মূলত জ্যামাইকান, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, গায়ানা এবং বারবাডোজের অধিবাসী। তবে বিভিন্ন সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে অন্যান্য দ্বীপদেশ থেকেও খেলেছেন দূর্দান্ত সব খেলোয়াড়।

এখন যেমন জাতীয় দলে সবচেয়ে বেশি খেলোয়ার জ্যামাইকান, তেমনি অতীতেও এই দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রিকেটার খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে। বোল্ট, পাওয়েল বা ব্লেকের মত বিশ্বসেরা সব স্প্রিন্টার যেমন এসেছেন জ্যামাইকা থেকে, তেমনি মাইকেল হোল্ডিং, কোর্টনি ওয়ালশের মত বিধ্বংসী ফাস্ট বোলার কিংবা উইন্ডিজ স্বর্ণযুগের উইকেটকিপার জেফ ডুজনও জ্যামাইকার মানুষ। আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলও কিন্তু জ্যামাইকান।  

ক্যারিবিয়ান আরেক দেশ গায়ানা থেকে উইন্ডিজ দলে খেলেছেন দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার। ক্যারিবিয়ান স্বর্ণযুগের এক দশকে তিনি ছিলেন উইন্ডিজ অধিনায়ক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম দুই বিশ্বকাপ জিতেছিল তারই নেতৃত্বে। প্রথম স্পিনার হিসেবে টেস্টে ৩০০ উইকেট নেয়া ল্যান্স গিবস, ষাটের দশকের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রোহান কানহাই, সত্তরের দশকে উইন্ডিজ পেস কোয়ার্ট্রেটের অন্যতম কলিন ক্রাফট এবং সাম্প্রতিক অতীতে উইন্ডিজ দলের অন্যতম ব্যাটসম্যান শিব নারায়ণ চন্দরপলও এই গায়ানার বাসিন্দা।  

প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে উইন্ডিজ স্বর্ণযুগের অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড

তবে ক্যারিবিয়ান দেশ বারবাডোজ থেকে আসা গ্রেট ক্রিকেটারদের কথা বলতে গেলে শেষ হবার নয়। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার গ্যারফিল্ড সোবার্স এই দেশেরই মানুষ। জোয়েল গার্নার ও ম্যালকম মার্শালের মতো বিধ্বংসী ফাস্ট বোলারদ্বয় এসেছেন বারবাডোজ থেকে। এ ছাড়া পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ‘থ্রি ডব্লু’ বলে পরিচিত ব্যাটিংত্রয়ী ফ্র্যাংক ওরেল, এভারটন উইকস ও ক্লাইড ওয়ালকটও বারবাডোজের অধিবাসী। তবে বারবাডোজের যে একজন ক্রিকেটারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করত হয়, তিনি হচ্ছেন আরেক ক্রিকেট গ্রেট গর্ডন গ্রিনিজ। সত্তর-আশির দশকের এই প্রভাবশালী ব্যাটসম্যান বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলোয় জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। ১৯৯৬-৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের কোচের দায়িত্বে ছিলেন। তার কোচিংয়েই বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে জিতেছিল ঐতিহাসিক আইসিসি ট্রফি। ৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের সময়েও তিনিই ছিলেন কোচ।

আরেক ক্যারিবিয়ান দেশ ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো থেকে ক্রিকেটে এসেছেন ক্রিকেটের বরপুত্রখ্যাত ব্রায়ান লারা। এছাড়াও বর্তমান সময়ে টিটুয়েন্টি ক্রিকেটের জনপ্রিয় দুই নাম কিরন পোলার্ড এবং ড্যারেন ব্রাভোও এই দেশেরই। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের সংক্ষিপ্ততম তালিকায় যার নাম একদম উপরের দিকে থাকবে সেই ভিভ রিচার্ডস এসেছেন অ্যান্টিগা ও বারবুডা থেকে। পাশাপাশি অ্যান্ডি রবার্টস এবং কার্টলি অ্যামব্রোসের মতন দুই মাঠ কাঁপানো ফাস্ট বোলারও এসেছেন অ্যান্টিগা থেকে।

এক সময়ে দাপুটে দল বর্তমানে এসে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রথম তিনটিতেই ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল খেলা দলটি সবসময় অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং যথাযথ নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাবের শিকার হচ্ছিল। এসব কারণে ছিটকে যেতে হয়েছিল অনেক উদীয়মান ক্রিকেটারকে। বোর্ডের সঙ্গে দলের খেলোয়াড়দের দ্বন্দ্ব তো লেগেই রয়েছে সবসময়।

উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বোর্ডের সাথে ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। প্রতিনিয়ত খেলোয়াড় পরিবর্তন, খেলোয়াড়দের শাস্তি এবং ঠিকভাবে বেতন না দেয়ার অভিযোগে মূল দল পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নতুন দল নিয়ে খেলানোর অভিজ্ঞতা বারবারই এই দলটির রয়েছে।

একটা সময় ক্রিকেট বিশ্বের বর্ণবাদী আচরণের জবাব তারা দিয়েছিল ক্রিকেট মাঠে অজেয় হয়ে। আজকের দিনে এসে তিন যুগ আগের উইন্ডিজ দলকে রূপকথার মতোই মনে হয়। সেই রূপকথা নেই আজ। দীর্ঘদিনে গড়ে ক্রিকেট সাম্রাজ্য ভেঙে গেছে অনেকদিন। আজকাল দেখে মনে হয়, সব যেন ভষ্ম হয়ে গেছে। তবুও হয়ত একদিন ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠবে জাতীয়তার সীমা অতিক্রম করে ক্যারিবিয়ান পতাকা বিশ্বের বুকে উঁচু করে ধরে রাখা দলটি।

২০৬২ পঠিত ... ২০:৩৫, জুন ১০, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top