ঢাবির হলের বড় ভাইদের নির্দেশে দুনিয়া ঘুরতে বেরিয়েছিলেন ইবনে বতুতা

৬৮৯৩ পঠিত ... ২২:২২, এপ্রিল ২০, ২০১৯

'কোথাও ঘুরতে যেতে হবে।' অফিসের ফাঁকিবাজি আড্ডায় এমন এক প্রস্তাবে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়েছিলাম আমরা। কোথায় যাওয়া যায়, সে ব্যাপারে তেমন কোন চিন্তা ছিল না। গেলেই হল কোথাও! কিন্তু বিপত্তিতে পড়তে হলো ‘কখন’ নিয়ে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা নাকি একেবারে মধ্যরাতে ঘুরতে যাব তা নিয়ে একেবারেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছিলাম না। তখনই মোবাইল ফোন বেজে উঠল। এমন অসময়ে অজানা নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে কিছুটা অবাকই হলাম।

‘হ্যালো, স্লামালিকুম! কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে বেশ গম্ভীর গলায় একজন বলে উঠলেন, ‘ওয়ালাইকুম! জনাব, আমি ইবনে বতুতা!’

এ যুগেও ফোন করে এমন ফাজলামি মানুষ করে নাকি! একটু কড়া গলাতেই বলতে হলো, ‘আপনার আসল পরিচয় বলুন!’

‘আমার আসল নাম শেখ আবু আবদুল্লাহ মুহম্মদ। বাড়ি মরক্কোতে। লোকেরা আমাকে বতুতার পুত্র অর্থাৎ ইবনে বতুতা বলেই ডাকে। চৌদ্দ শতকে আপনাদের দেশে এসেছিলাম। সেই ভ্রমণ নিয়েই কিছু কথা বলা দরকার!’

এসব শুনে কিছুটা সিরিয়াস মনে হলো বিষয়টাকে। আগ্রহ জন্মালো কথা বলার। কতো রকম পাগল মানুষই তো আছে দুনিয়ায়। দেখিই না, সে কী বলে! আর যদি সত্যি সত্যিই ইবনে বতুতা হন, তাহলে একটা এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারকিই লিখে ফেলা যাবে।

eআরকি: আপনিই সেই ইবনে বতুতা? বাহ! কিন্তু আমাদের ফোন করেছেন কেন?

ইবনে বতুতা: অনেকদিন বাংলাদেশের কোন খোঁজ নেওয়া হয় না। সেদিন পত্রিকায় একটা খবর পড়লাম। তখন থেকেই মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে আমার ঘোরাঘুরির সত্যিকারের ঘটনা মানুষজন জানুক। সে জন্যই আপনাদের ফোন করলাম।

eআরকি: (বেশ আগ্রহী হয়ে) কোন খবর? কী বলবেন বলুন!

ইবনে বতুতা: এই যে প্রথম আলোতে পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা রাতের বেলা বড় ভাইদের নির্দেশে ঘুরতে বের হয়। রাতে বের হয়ে ভোর পর্যন্ত চলে ঘোরাঘুরি। সূর্যসেন হলের ছেলেদের কথাই দেখলাম লিখেছে পত্রিকায়। তবে অন্যরাও নাকি এখন ঘোরাঘুরি করে।

eআরকি: হ্যাঁ, আমরাও পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু ছাত্রদের রাত বিরেতে ঘোরাঘুরি নিয়ে হঠাৎ আপনি আগ্রহী হয়ে পড়লেন কেন?

ইবনে বতুতা: আরে আমিও তো বিশ্বভ্রমণে বের হইছিলাম বড় ভাইদের নির্দেশেই! এতদিন পর ঢাবির ছাত্রদের কথা শুনে মনে পড়ল সে দিনগুলোর কথা।

eআরকি: কী বলছেন! আপনি বড় ভাইদের কথায় বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছিলেন? সিরিয়াসলি?

ইবনে বতুতা: হ্যাঁ! আমি তখন পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হলেই থাকতাম। হলের বড় ভাইরা খুব ভালো ছিলেন। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে আমাদের অনেক আপ্যায়ন করতেন গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে। এই যে এতো এতো দেশ ঘুরে বেড়াইছি, নতুন নতুন মানুষের সাথে মিশছি, এগুলা সম্ভব হইছে সেইসব দিনগুলায় ভাইয়েরা আমাদের ম্যানার শিখাইছে দেখেই।

eআরকি: ইয়ে মানে… এসব নিয়ে তো এখন অনেকেরই অভিযোগ শুনি আমরা। আপনাদের সময় নিশ্চয়ই রাত বিরেতে বাইরে ঘুরতে নির্দেশ দিতেন না বড় ভাইয়েরা?

ইবনে বতুতা: যারা এসব বলে, তারা গেস্টরুমের প্রয়োজনীয়তা বোঝে না। এসব কথা কান দিবেন না। আর হ্যাঁ, আমাদের সময়েও বড় ভাইরা বলতেন ঘুরে বেড়াতে। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর তারা আমাদের এখানে সেখানে ঘুরতে পাঠাতেন। এক রাতে এক বড় ভাই বললেন, ‘ইবনে বতুতা, আজকে রাতে তোরা সবাই বুড়িগঙ্গা ঘুরে আয়!’ আমি বললাম, ‘সহমত ভাই! জি ভাই! বুড়িগঙ্গা যাব ভাই!’

eআরকি: এরপর? আপনারা নিশ্চয়ই ভয়ে ভয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন। পরে কোথাও লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?

ইবনে বতুতা: খামোশ! ভার্সিটির বড় ভাইদের কথা না শোনা বেয়াদবি, সেসব জানেন না? আমরা ঘুরতে বের হলাম। কয়েকজন অত দূর গেল না, কাছেই কোথাও লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিই চলে গেলাম বুড়িগঙ্গার রূপ দেখতে। এভাবে বড় ভাইদের নির্দেশেই আমি মধ্যরাতে কখনো বেরিয়ে পড়তাম চাটগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে, কখনোবা সোনারগাঁও। এভাবেই এক রাতে এক পলিটিকাল বড় ভাইয়ের নির্দেশে মাঝরাতে বেরিয়ে পড়লাম কামরূপ কামাখ্যার উদ্দেশ্যে। মুখে ‘সহমত ভাই’ জপতে জপতে নদী-নালা, জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে পৌঁছে গেলাম অপরূপ সুন্দর সেই জায়গায়।

eআরকি: কিন্তু এভাবে যে গভীর রাতে ঘুরতেন, বিপদে পড়তে হয়নি কখনো? ভার্সিটি স্টুডেন্ট হয়ে এত খরচই বা করতেন কী করে?

ইবনে বতুতা: কীসের বিপদ! আমি গর্বিত ঢাবিয়ান। আইডি কার্ড দেখালেই তো ঝামেলা খতম। আর বড় ভাইয়ের দোয়া আছে আমার সাথে! আমার আবার বিপদ কীসের? উনার নাম বলে আমি আট আনা দিয়েই এক মণ চাল কিনেছিলাম একবার।

eআরকি: আরব, পারস্য, উত্তর আফ্রিকা এসব অঞ্চলেও কি ভাইদের কথাতেই ঘুরতে গিয়েছেন?

ইবনে বতুতা: এগুলোও গিয়েছি ভাইদের আদেশেই। তখনকার দিনে আমরা ঘুরতে বেরিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম না। আজকালকার ছেলেপিলেরা যে কী হয়েছে! সূর্যসেন হল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই যেতে পারে না। অথচ আমাদের সময়ে আমরা… (বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন এই বিশ্বখ্যাত পর্যটক।)

eআরকি: আচ্ছা, কিন্তু বড় ভাইয়েরা কেন আপনাদের রাত বিরাতে ঘুরতে পাঠাতেন?

ইবনে বতুতা: ভাইরা বিশ্বাস করতেন, ভ্রমণই হচ্ছে শেখার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। আর রাতে রাস্তাঘাটে জ্যাম কম থাকে। তাই রাতের বেলাতেই তো ঘুরতে হয়!

eআরকি: তাহলে তো আমাদের ঢাবি থেকে খুব দ্রুত অনেকেই আপনার মতো কিংবদন্তি পর্যটক হতে যাচ্ছে!

ইবনে বতুতা: আলবৎ। তবে এজন্য গেস্টরুম সংস্কৃতির দিকে জোর দিতে হবে। তোমাদের হলের বড় ভাইদের আমার সালাম দিও। উনারা আছে বলেই তো...

উনি হয়তো এই মুহূর্তে এমন কোথাও ঘুরছিলেন যেখানে নেটওয়ার্কের সমস্যা! সেজন্যই ফোনটা আচমকা কেটে গেলো। মনে আসা 'সহমত ভাই' কথাটা যেন আর বলা হলো না। তবে আমরা তখনই ভেবে ফেললাম, ঘুরতে বের হতে হলে রাতের বেলা না ঘুমিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাসেই ঘুরে বেড়াবো। কে জানে, হলের বড় ভাইদের দোয়া থাকলে ইবনে বতুতার মতো একজন হয়েই যেতে পারি! 

৬৮৯৩ পঠিত ... ২২:২২, এপ্রিল ২০, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top