বিসিএস দিন

৫১১ পঠিত ... ১৮:১২, মে ১৮, ২০২৩

BCS-din

চায়ের স্টলে বসে একদল লোক টিভিতে খবর দেখছিল। সেইখানে একটি প্রতিবেদনে একজন মান্যবর বলেন, কী যেন বলেন; হৈ চৈ-এ শুধু শোনা যায় বিসিএস দিন। অমনি একদল মিছিল করতে করতে বেরিয়ে যায় চাখানা থেকে; উন্নয়নে অংশ নিন; বিসিএস দিন; বিসিএস দিন।

এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ইউএনও মহোদয়ের দফতরের সামনে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসে। হিন্দুরা একটু ধুপ জ্বালিয়ে দিয়ে আসে। খবর পেয়ে ইউএনও সাহেব মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হন।

–কোথায় এসে পড়লাম!

কিছু অতিউৎসাহী রাজনৈতিক কর্মী উৎসাহিত হয়ে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবকে বলে, চ্যারম্যান সাব আপনে বিসিএস দিবেন না!

–বিসিএস কীরে!

–তাতো জানি না চেয়ারম্যান সাব।

পরদিন গ্রামের স্কুলে শিশুরা তাদের শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে একই প্রশ্ন, –স্যার বিসিএস দিবেন কবে!

–আমি শিক্ষক আমার কাজ শেখানো। তোমাদের যাদের ভবিষ্যতে বিসিএস দেবার ইচ্ছা আছে; তারা পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখবে ঠিকই আমাকে মনে পড়বে। তাই আমার বিসিএস দেয়া লাগে না।

বাচ্চাদের কাছে কথাটা পছন্দ হয়। কারণ প্রত্যেক পরীক্ষার দিনে স্যারের কথা মনে পড়ে।

এলাকার এমপি মহোদয় যিনি সর্বোচ্চ সংখ্যক বিসিএস কর্মকর্তাকে চপেটাঘাত করে নিন্দিত তাকে এলাকার লোকজন এসে উৎপাত শুরু করে, ও গদি ভাই বিসিএস দিবেন না!

–দিমু না যা; তগো বাবার কী!

এলাকায় ফুটবল টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসেছেন প্রধান অতিথি হিসেবে এক মন্ত্রী। তিনি সচিবালয়ে বিসিএস কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য বিতর্কিত। চ্যাম্পিয়ানশিপ পুরস্কার নিতেই বিজয়ী দলের অধিনায়ক মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে,

–স্যার আপনার কী বিসিএস দেবার কোনো পরিকল্পনা আছে।

মন্ত্রী ক্ষেপে গিয়ে একটি চেয়ারে লাথি মারেন। পণ্ড হয়ে যায় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। জনরোষের মুখে মন্ত্রী ইউএনও-র দফতরে আশ্রয় নিতে গিয়ে দেখেন সামনে আগরবাতি ও বেলীফুল। কিছু লোক বসে সুরা পড়ছে। কেউ কেউ রামনাম জপ করছে।

আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ইউএনও-র কক্ষে একটি কম্পিউটারে লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলেন মন্ত্রী। সুরা ও শ্লোক পাঠকারীরা পুলিশের মৃদু লাঠিচার্জে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কেউ কেউ মৃদু আহত হয়ে হাসপাতালে যায়। চিকিৎসা নেবার আগে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন,

ডাক্তার সাব আপনে বিসিএস দেবেন কবে!

ডাক্তার মুচকি হেসে বলেন, আমি তো বিসিএস পাস করেই এই হাসপাতালে এসেছি।

আহত রোগীরা আনন্দে উঠে দাঁড়ায়।

–স্যার ওষুধ লাগবে না। আপনারে দেইখাই ব্যথা চইলা গ্যাছে!

ডাক্তারের সেল ফোন বেজে ওঠে, ইউএনও সাহেবের ভীত ফোন।

–মন্ত্রী মহোদয় আমার রুমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্লিজ একটু আসেন।

ডাক্তার গিয়ে দেখেন মন্ত্রী মহোদয় সোফায় শুয়ে। প্রেসার হাই। বাই-পোলার ডিজ-অর্ডারের পেসেন্ট মনে হচ্ছে। বিড় বিড় করে বলছেন, আমার আব্বা আমাকে বিসিএস গাইড বই কেনার টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সেই টাকাটা মেরে না দিলে আজ বাচ্চাদের কাছে বিসিএস-এর খোঁটা শুনতে হতো না।

–মন্ত্রী মহোদয় আপনি রাজনীতিক; আপনি কেন বিসিএস দেবেন! আপনার কাজ তো আপনার মতো।

মন্ত্রী একটু সুস্থ হয়ে ওঠেন। ইউএনও সাহেব বলেন, আপনার পদমর্যাদা অনেক ওপরে মন্ত্রী মহোদয়।

সহকারী পুলিশ কমিশনার বুঝিয়ে শুনিয়ে কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও হিন্দু জনতা নিয়ে আসেন। তারা মন্ত্রীর সামনে আগরবাতি জ্বালিয়ে ঘুরায় ও রামনাম জপ করে। মন্ত্রী যার কারণে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

এমন সময় স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, চলেন ভাই যাই; এতোগুলি বিসিএস-এর মধ্যে আপনি নন-বিসিএস একা থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আমার বাসায় একটু ডাল-ভাত খাবেন চলেন।

আবার মন্ত্রীর শরীরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। উপজেলা চেয়ারম্যানকে ক্ষেপে জিজ্ঞেস করেন, বলেন দেখি মঙ্গোলিয়ার রাজধানীর নাম কী!

–মঙ্গোলিয়ার রাজধানীর নাম দিয়া আমার কাম কী!

মন্ত্রী বিসিএস কর্মকর্তাদের দিকে তাকাতেই তারা সমস্বরে বলে ওঠেন, উলানবাটোর।

উপস্থিত জনতা আবার বিসিএস কর্মকর্তাদের চারপাশে আগরবাতি নিয়ে ঘোরা শুরু করে। সুরা-শ্লোক চলতে থাকে। মন্ত্রী রেগে বেরিয়ে যান। একটা ফুলের টবে লাথি মেরে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলেন, ঢাকা চলো। ডাইরেক্ট নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়া যাইবা।

–স্যার আমি বিসিএস পরীক্ষার প্রিপারেশান নিতাছি। গাড়িতে গাইড বুক আছে। নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় থিকাই কিনছি। –দেও দেহি পড়ি। তুমি এইডা কাউরে কইও না যে আমি বিসিএস গাইড বই পড়ছি।

–আপনের কুন আকামটার কথা আমি মাইনষেরে কই স্যার!

পরদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অভিযুক্ত কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়ে শুনানি হয়। প্রধানমন্ত্রী একটি বিসিএস গাইড বই হাতে নিয়ে অভিযুক্তদের প্রশ্ন করতে থাকেন।

তবে গতকাল একজন মন্ত্রী লাথি দিয়ে চেয়ার ভেঙে সভা পণ্ড করায় সেই ইস্যুটি সামনে এসে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তোমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। –বলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? –১৯২১ সালে।

–ভেরি গুড। এবার বলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন গ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন?

–গীতাঞ্জলী।

অর্থমন্ত্রী পরামর্শ রাখেন, বিশ্ববিদ্যালয়, নোবেল পুরস্কার এসব ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন না করাই মঙ্গলজনক।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কী করবো! এর পরের প্রশ্নটাই তো সত্যেন বোসকে নিয়ে।

–তার পরেরটা!

–রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শামসুজ্জোহার মৃত্যু দিবস নিয়ে।

–কী সর্বনাশ!

বিসিএস গাইড বুক হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতেই চলে আসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। তার পরের পৃষ্ঠায় মুনীর চৌধুরী, সেলিম আল দীনের নাটক নিয়ে প্রশ্ন। এরপর হাসান আজিজুল হকের কথা সাহিত্য নিয়ে প্রশ্ন। তারপর হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এই গাইডবুক বাদ দিয়ে অন্য একটা আনিয়ে নেয়া যাক।

অন্যমন্ত্রীরা বলেন, আমরা গতকাল থেকে বাজারে এভেইলএবল সব গাইড বুক পড়ে দেখেছি; প্রশ্ন একই রকম।

দফতরবিহীন মন্ত্রী বলেন, বিসিএস গাইড বুক অথচ বিসিএস কর্মকর্তাদের সুকৃতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই! তা কী হয়!

এদিকে বিসিএস দিন স্লোগানের অভিঘাত ছড়িয়ে পড়েছে মেট্রোপলিটানে। এফএম রেডিওর এক জকি হেঁচকি দিয়ে দিয়ে বলছে, আপনাকে আমি ভীষণ ভীষণ লাভ করতে পারি; ফোন নম্বর দেবো যদি বিসিএস দেন। সঙ্গে সঙ্গে কলাররা কল করতে শুরু করে।

–আফা আমার একটা পোল্ট্রি ফার্ম আছে। বিসিএস কর্মকর্তার চেয়ে উপার্জন ভালো। আমারে আবার পরীক্ষার ঝামেলায় ফেলতেছেন ক্যানো।

–নো নো হবে না হবে না; আপনাকে বিসিএস দিতেই হবে।

এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কান্ট্রি ম্যানেজার কর্মক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। লাউঞ্জের সোফায় বসতেই গৃহকর্মী এসে বলে, খালু যদি ধমক না দেন একটা প্রশ্ন করি।

–ধমক দেয়ার কী আছে! কী ব্যাপার!

–আপনে কী বিসিএস পাস দিয়েছেন!

–নাতো। আমি এমবিএ করেছি।

–বিয়া তো সবাই করে খালু। বিসিএস করে কয়জনা!

পাশের বাসায় তুমুল হৈ চৈ। এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পিএইচডি স্কলারশিপ পেয়েছেন। কিন্তু তার স্ত্রী বলছেন, পিএইচডি করে কী হয়। বিসিএস দাও। ওসব পিএইডডি-ফিএইচডি দিয়ে কী আর হবে! কী হয় জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ ছেপে! আনিলার হাজব্যান্ড মুখ্যসচিব হবে আর তুমি বড় জোর অধ্যাপক। দুই গ্রেড নীচের হাজব্যান্ড হবে জানলে জীবনের এতোগুলো বছর তোমার এতো অন্যমনষ্কতা এতো বইপড়া সহ্য করতাম না। এসব বাদ দাও। বিসিএস গাইড বুক পড়ো।

রাতে একটা টকশো থেকে সরাসরি ওয়েস্ট ইনে এসে পৌঁছে এক সাংবাদিক। অনেকেই হাই হ্যালো করে। ছিম ছাম পরিবেশ। আলো আঁধারীতে সংগীতময় মধ্যরাত। সাংবাদিক কোণার টেবিলে একটা অরেঞ্জ জুস নিয়ে বসে। আরো দু’একজন বন্ধু আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। শোবিজের এক মডেলকন্যা এসে বলে, আপনাকে পরিচিত মনে হয়। আপনি কী বিসিএস দিবেন!

–আমি সাংবাদিক মানুষ বিসিএস দেবো কেন!

–আপনার সঙ্গে একটু নাচতে ইচ্ছা করছিল; কিন্তু বিসিএস না দিলে আর নাচি ক্যামনে!

 

৫১১ পঠিত ... ১৮:১২, মে ১৮, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top