শ্রদ্ধেয় চা, মাননীয় চপ ও সিঙ্গাড়া মহোদয়

১৯০০ পঠিত ... ১৪:৫১, জুন ১৮, ২০২১

Manonio

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তিতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আকাশ স্পর্শ করা সাফল্যের অমর সূত্র টিএসসি-র চা-চপ-সিংগাড়া নিয়ে 'একটি মহলে'র অব্যাহত ক্যারিকেচার আমাকে ব্যথিত করেছে। ১৯২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিনে যে চা-চপ-সিংগাড়া থিওরির সূত্রপাত; যে সূত্র জাতিকে ঋদ্ধ করেছে নানাভাবে।

এই চা-চপ-সিংগাড়া খেয়ে যে সিএসপি অফিসার তৈরি হয়েছিলো; তাদের প্রত্যেকের একটি করে প্লট আছে ঢাকা শহরে। এই চা চপ সিংগাড়া খেয়ে যে রাজনীতিবিদ তৈরি হয়েছিলো; তারা নতুন জমিদার হিসেবে ক্রমে ক্রমে দেশের মালিকানা দাবী করেছেন।

এই চা-চপ-সিংগাড়া বিসিএসকে এক বে-নজির কোহিনূর হিসেবে স্থাপন করেছে জাতির কপালের ঠিক ওপরে। এই চা চপ সিংগাড়া খেয়ে 'রাজাকারের নিত্যতা সূত্র' উদ্ভাবন করেন; বিজ্ঞানী কাদের। হ্যা এই কাদেরই সেই কাদের; এক কাদের লোকান্তরে লক্ষ্য কাদের ঘরে ঘরে।  

এই চা চপ সিঙ্গাড়া শ্রদ্ধেয়; কারণ সে বৃটিশ ডিভাইড অ্যান্ড রুলকে অতিক্রম করে ইতিহাসের 'মুনতাসির ফ্যান্টাসি' জন্ম দিয়েছে। সেই ফ্যানটাসি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবারতন্ত্রের 'বাজারের ব্যাগ' পৌঁছে দিয়েছে। চা চপ সিঙ্গাড়ার 'মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়' আত্মীয়তা ও গোলামির শর্তে তৈরি হয়, মিশ্র শিক্ষক। যে বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের 'টেন পার্সেন্ট' থিওরির জন্ম দিয়েছে; নিশীথ সূর্যের গণতন্ত্র, শ্রেণী কক্ষ, ভোটসমনিয়া ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, দুর্নীতি বসন্ত, সেকেন্ড হোম ; এরকম ধন্বন্তরী সূত্রগুলো আমাদের হলো যে জাদুকরী শিক্ষকদের গবেষণার সূত্র ধরে।

পৃথিবীর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন করোনাকালে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করেছে; তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য মহোদয় বলেছেন, করোনাটা যাক; নিশ্চয়ই একদিন ক্লাস হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, জীবন থেকে দুটো বছর ঝরে গেলে; এমন কোন ক্ষতি নেই। সত্যিই তো; শিক্ষামন্ত্রী নিজেও মেধাবী ছাত্রী ছিলেন; কিন্তু পাশ করার পর কয়েকবছর বসে থেকে চিন্তা করেছেন, কী করে দেশপ্রেম বাস্তবায়ন করবেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসের নায়ক সন্দ্বীপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে এসেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের শিক্ষা সফরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চা-চপ-সিঙ্গাড়া খাওয়া মাত্র তিনি 'দেশপ্রেম' শব্দটি জপ করতে থাকেন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ময়রা হেসে বলেন, দেশপ্রেমিকের স্বাস্থ্য ভালো হতে হয়; এই চা-চপ-সিঙ্গাড়া বাড়তি শক্তি জোগায়।

সত্যিই তাই, ১৯৪৭-এর আগে স্বদেশী আন্দোলন অথবা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তো অনেকেই গিয়েছেন; কিন্তু স্বদেশী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়েছেন কেবল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চা-চপ-সিঙ্গাড়া খাওয়া বাহুবলীরা।

বঙ্গবন্ধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে; তাঁকে চা-চপ-সিঙ্গাড়া সেধেছিলেন; সে সময়ের পাকিস্তানশাহীর অংকশায়নী উপাচার্য। বঙ্গবন্ধু এই প্রস্তাব ফিরিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা হাড্ডিসার; অথচ পাকিস্তানশাহীর উন্নয়নের বেহুদা ঢোল বাজানো এন এস এফ-এর পান্ডাগুলোর চর্বি উথলে পড়ছে! কী ব্যাপার, স্যার কী বলবেন অনুগ্রহ করে?

বঙ্গবন্ধু-র ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষের শাখায় ফুল ফোটাতে ব্যর্থ কবি আবুল হাসানের মতোই বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে বলেছিলেন, আমি লাস্ট বেঞ্চি; আমি চোরের খনির চাটার দলের ক্লাস রুমের ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে পারবোনা কখনোই।

শাক দিয়ে মাছ ঢাকা বিদ্যা আর আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে ধর্ম-রাজনীতি-আমলাতন্ত্র-ব্যবসায়ীর ক্ষমতাকেল্লার 'চাকরস্য চাকর'-এ পরিণত হয়ে; বৃটিশ ও পাকিস্তানী উপনিবেশের ফটোকপি নীল ক্ষেত বাজার থেকে সংগ্রহ করে উজ্জ্বল ছাত্রেরা  উপহার দিয়েছে, স্বদেশীর উপনিবেশ-মুক্তিযোদ্ধার উপনিবেশ; যার বহিরাঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; ভেতরে রাজাকারের অস্থি।

দারিদ্র্যে অগমে দুর্গমে পরাধীন ছোট খাট মানুষের কন্ঠস্বর ঢেকে দিতে; এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগবিদেরা 'সাহেব বিবি গোলামের বাক্স' ও কালক্রমে বাতাবি লেবুর মিডিয়া বাগান উপহার দেয়। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য অদৃশ্য সাবানে হাত কচলানোর মুদ্রা। প্রেস কনফারেন্স শেষে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়, ঠিক আছে ঠিক আছে; আপনাদের জন্য 'চা-চপ-সিঙ্গাড়া'-র ব্যবস্থা আছে।

'সবুজ লুঙ্গি নয়'-থ্রি পিস স্যুট-জিনস টিশার্ট-নকশি পাঞ্জাবি ইত্যাদি গায়ে জড়ালে নিও রুলিং এলিট হওয়া যায়; এই ধারণার সূত্রপাত হয়; এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন তার সৈয়দ তৈরির কারখানা থেকে উপনিবেশের কেল্লা পাহারা দেবার উপযুক্ত প্রহরী উপহার দেবার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন; সেই পাকিস্তানকাল। তা আজো সুদৃশ্য কোহিনূর ও বেনজির নিয়াজ উপহার দেয় ক্ষমতা-কাঠামোর অপারেশান ক্লিন হার্টে কিংবা অপারেশান ক্লিন ব্রেনে। কিন্তু মনে রাখতে হবে; চা-চপ-সিংগাড়া ছিলো এই বাহুবলী শক্তি তৈরির মূলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নকল ধরতে ধরতে ক্লান্ত যখন একাডেমিক জার্নালের সম্পাদকেরা; তখন ঢাকার অদূরে জিঞ্জিরা 'মেইড ইন চায়না' শিল্প বিপ্লব সূচিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অবদান 'মানি ইজ দ্য অনলি গড' দর্শনের প্রচলন। যে কারণে একসেস টু টেকাটুকার বটমলেস বাস্কেট থেকে টাকা গিয়ে পড়ছে সুইস ব্যাংকে, কেমেন আইল্যান্ডে ও নানা উন্নত দেশের সেকেন্ড হোমে।

শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীন চারুকলা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর একসময় নিজেই ছবি আঁকা ছেড়ে দিলেন; এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়। রুচির দুর্ভিক্ষের এই ক্যাম্পাসের চা-চপ-সিঙ্গাড়া-কে প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনিও।

কিন্তু তাতে কী; বঙ্গবন্ধু বা জয়নুলের মতো 'ইউটোপিয়ার জগতে'র বাসিন্দাদের প্রত্যাখ্যানে কী এসে যায়। বরং দুর্নীতির বসন্তে টাকা কামিয়ে চা-চপ-সিঙ্গাড়া বাদ দিয়ে 'বোট ক্লাবে' বোনভোজনকেই শিরোধার্য করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। সম্রাটের জুয়ার আড্ডার ক্লাবের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রত্ন, নাসিরের লাল চড়ুই-এর আড্ডার সভাপতি সাবেক ঢাবিয়ান। ওয়েস্টইনের পাপিয়ার আসরের সর্দার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্জয় সাফল্যকে গর্বের শিখরে নিয়ে গেছে। ১০ টাকার চা চপ সিঙ্গাড়া খেয়ে দশ লাখ টাকার মেম্বরশিপ ফি দেয়ার ক্ষমতা অর্জন কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।

কাজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চা-চপ-সিঙ্গাড়ার সমালোচনা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়দ্রোহিতা। বঙ্গবন্ধু ও শিল্পাচার্য যেটা করেছিলেন। এঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষের শাখায় ফুল ফোটাতে পারেননি। বরং এই বিশ্ববিদ্যালয় বৃক্ষের শাখামৃগরাই 'সফল' হয়েছে। সাফল্যকে হিংসা করা সুশীলদের বদ অভ্যাস। নিজেরা টাকা কামাইতে পারেনা বইলা যারা টাকা কামিয়ে দেশের দফার রফা চা-চপ-সিঙ্গাড়া করে দিচ্ছে; তাদের হিংসা করছে সুশীলেরা। এইগুলি হইতাছে জ্ঞানপাপী-ফালতু-ভাঁড় সো কল্ড ব্যর্থ লোক।

তার চেয়ে চলুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত চা চপ সিঙ্গাড়া খেয়ে টাইম মেশিন হয়ে ওঠা ইতিহাসান ভাইদের গল্প শুনি। বৃটিশ ও পাকিস্তান উপনিবেশের হত্যা-ধর্ষণ-লুন্ঠন-নিপীড়নের ঠাকুরমার ঝুলি শুনে শুনে 'বর্তমানের সব অন্যায়- অপরাধ' অগ্রাহ্য করতে শিখি।লোডস অফ সুইফট ডেভেলপমেন্টের(এল এসডি)-র নেশাচুর প্রগতিশীল হারমোনিয়াম বাজাই; গান গাই, উন্নয়নের  মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই; যেন গোরে থেকেও লাইলাতুল ইলেকশানে ভোটাধিকার পাই। ইচ্ছা করে টিএসসি গিয়ে, দশ টাকার জাদুকরি চা-চপ-সিঙ্গাড়া খাই।

১৯০০ পঠিত ... ১৪:৫১, জুন ১৮, ২০২১

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top