আমার দুরপাল্লার বাস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

৪৫৪৬ পঠিত ... ২০:৩৬, এপ্রিল ২৯, ২০১৭

আঁকা: জুনায়েদ

দূরপাল্লার বাসে যাতায়াত করার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা খুবই ব্যাপক। আমি ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-খুলনা রুটে বিস্তর বাস জার্নি করেছি।

একবার হলো কি, ঢাকা থেকে রংপুর যাব। তিন দিন আগে টিকিট করতে হয়, করলাম। সকাল সাতটায় বাস। সাতটা বাজার পাঁচ কি সাত মিনিট আগে গাবতলী পৌঁছালাম। নির্দিষ্ট বাসে উঠে দেখি আমার সিটে অন্য লোক বসে আছে। আমি বললাম, ‘ভাই, এটা তো আমার সিট। আমি তিন দিন আগে টিকিট কেটেছি।’ তিনি তাঁর টিকিট বের করলেন। দেখা গেল, তাঁরও এই সিটই। বাসঅলারা একই সিটের জন্য দুটি টিকিট বেচছে। আমি রাগীস্বরে ডাকলাম সুপারভাইজারকে, ‘এই মিয়া, এই সিটে দুটো টিকিট ছেড়েছ কেন?’ সে উদাস ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি টিকিট বেচি নাই। কাউন্টার থাইকা বেচছে। আপনে টিকিটঘরে যান, বাস একটু পরে ছেড়ে দেবে।’ আমি টিকিটঘরে যাব? পড়িমরি দৌড়ে গেলাম। কাউন্টার ফাঁকা, কেউ নেই। আবার দৌড়ে এলাম বাসে। আমার আম-ছালা সবই বুঝি যায়।

ইঞ্জিন কাভারে বসে অতিকষ্টে যাত্রা সম্পন্ন করতে হলো। ইঞ্জিন কাভারে বসলে যে আমার জাত যাবে, তা তো নয়। মুশকিল হলো, বাস খানিক চলার পর ইঞ্জিন কাভার খুব গরম হয়ে যায়। নিতম্বের ওপর দিয়ে খুব একচোট ধকল যায়। আমারও গেল। কান ধরলাম, এরপর আর দেরি করে বাসে উঠব না। এক ঘণ্টা আগে বাসে উঠে সিট দখল করে রাখব।

পরের বার ঢাকা-রংপুর বাসের সময় সকাল ছয়টায়। হলের সিট দখল নিতে কত রক্তারক্তি করতে হয়, আর বাসের সিটের জন্য আমি এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারব না? ভোর হচ্ছে গাবতলীতে। নাইট কোচে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আসা মোরগগুলো ডাকতে শুরু করেছে। তাদের প্রাতঃক্রিয়ার দুর্গন্ধে নাকে রুমাল দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। পাশের ইতালিয়ান হোটেলে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। সেটার সুগন্ধও এসে নাকে জায়গা খুঁজছে। খানিক পরে আরও দু-চারজন যাত্রী এসে উঠলেন। সাতটা বাজতে চলল। আমি আমার সিট দখল করে মনে মনে গান গাইছি—দেখা আরিচাঘাটে, শাহজালাল ফেরিতে, রংপুরিয়া চ্যাংড়া বন্ধুর সাথে রে।

এমন সময় একজন ‘বাসের লোক’ এসে বলল, ‘এই বাস যাবে না, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’

বলে কী লোকটা? ব্যাগট্যাগ নিয়ে তাঁর পিছে পিছে ছুটতে হলো। তিনি অন্য একটা বাসের দরজা পর্যন্ত আমাদের নিয়ে গেলেন। বেশি টিকিট বিক্রি হয়নি বলে দুটো বাসের বদলে একটা বাস যাবে। এই বাস আগে থেকে অর্ধেক ভরা। আমি ভেতরে প্রবেশের আগেই বাকি সিট ভরে উঠল।

দূরপাল্লার যাত্রার অনেকে নাইট কোচকে অগ্রাধিকার দেন। আমার অবশ্য ডে কোচই ভালো লাগে। এর কারণ, নিখাদ ঈর্ষা। নাইট কোচ ছেড়ে দেওয়ার খানিক পরে বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়, সমস্ত বাস একযোগে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার পাশের যাত্রীটি মহানিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে আমার কাঁধটাকে বালিশ ভেবে নাক ডাকতে শুরু করে দেন। জেগে থাকে মাত্র দুজন। একজন ড্রাইভার। দ্বিতীয়জন আমি।

বসে বসে ক্যাসেট প্লেয়ারের গান শুনি। বাংলা সিনেমার গান সব আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল নাইট কোচে যেতে যেতে। একটা গান হলো: ‘আমার লাখ টাকার বাগান খাইল দেড় টাকার ছাগলে।’ আরেকটা গান প্যারোডি। ‘ওরে ও কলাঅলা, তোর কলা বিচি কলা, খাইতে ভালো লাগে না।’ উদাহরণ বাড়াতে চাই না।

তো আমি ডে কোচ বেশি পছন্দ করি। দুধারের ধানখেত দেখতে দেখতে যাই। আর যেখানেই বাস থামে, ফেরিঅলার কাছ থেকে খাবার কিনে খাই। ঝালমুড়ি, আমড়া, আখ, সেদ্ধ ডিম ইত্যাদি। অবিরাম ভক্ষণ। এ কারণে আমি একা একা চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কোনো ভদ্রলোককে পাশে রেখে এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া কি ঠিক?

এবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার সময় পাশের সিটে পেলাম একজনকে। তিনি বাঙালি, বগুড়ার সান্তাহারের লোক, কিন্তু সেটল করেছেন পাকিস্তানে। বাংলাদেশ থেকে আম কিনে নিয়ে যাবেন। দাউদকান্দি ফেরিঘাট থেকে তিনি আম কিনলেন। অনেকগুলো আম। আমাকে সেই আম খাওয়াবেনই। সহযাত্রী কোনো কিছু খাওয়াতে চাইলে খাবে না—এটা বাসে চড়ার দেশি নিয়ম। কিন্তু এ লোকের পীড়াপীড়িতে না খেয়ে কোনো উপায় রইল না। মুখে দিয়ে দেখি অতি জঘন্য আম। টক হলে তো কথা ছিল—টকও না, মিষ্টিও না। পানির মতো স্বাদ। ভদ্রলোক বড় আশা নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন—‘ভালো না? খুব মিষ্টি না?’ বিস্বাদে আমার মুখ তখন বিকৃত। অতি কষ্টে বললাম, ‘হ্যাঁ, খুব মিষ্টি।’ তিনি পরিতৃপ্তির সঙ্গে বললেন, ‘মিষ্টি হতেই হবে। আম কিনতে হয় দেখে। এই যে দেখেছেন বোঁটার কাছটা ভরা ভরা, এ ধরনের আম মিষ্টি হয়।’

একটা সময় ছিল, যখন আমরা তিন ভাই ঢাকায় থাকতাম। ঈদে প্রত্যেকেই বাড়ি যাবে! আমরা তিন ভাই তিনটা বাসে চড়তাম। দোয়া-দরুদ পড়েই চড়তাম। এটা হলো ঝুঁকিটা ছড়িয়ে দেওয়া। তিন ভাই যদি একসঙ্গে মারা পড়ি, বাবা-মা বড় কষ্ট পাবেন যে। শেয়ার মার্কেটে এভাবে বিনিয়োগ করতে হয়। একই কোম্পানির শেয়ার বেশি করে না কিনে তিন-চারটা কোম্পানির শেয়ার কিনুন। একটা মারা পড়লে যেন অন্যটা বেঁচে থাকে।

আমি ঢাকায় একটা দৈনিক সংবাদপত্রে কাজ করি। একবার আমার শখ হলো আমার পড়াশোনা যে ক্ষেত্রে, সে পেশায় ফিরে যাব। ইঞ্জিনিয়ারিং করব। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি পেলাম রেলে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে একাডেমিতে ট্রেনিং। দিন পনেরো চট্টগ্রামে ছিলাম। এই পনরো দিনে আমি মোট দশবার ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা বাসে যাতায়াত করলাম। রেলের কর্মচারী হিসেবে রেলের টিকিট বিনে পয়সায় পাওয়াটাওয়া যায়। এসব ঝামেলা কে করে? তা ছাড়া বাসে চড়ে যখন-তখন আসা-যাওয়া করা যায়। আমার থাকার কথা চট্টগ্রামে, দেখা গেল আমি ঢাকায় এসে আমার সংবাদপত্র অফিসে বসে আছি। আমার মনের অবস্থা আল্লাহতাআলা বুঝলেন। আমার জ্বর হলো। আমি আর চট্টগ্রাম ফিরে গেলাম না।

সবশেষে আমার এক বাসের কন্ডাক্টরের কথা মনে পড়ছে। সেবার ডে কোচে চড়ে রংপুর যাচ্ছি। পথিমধ্যে একজন যাত্রী পরার কাপড় নোংরা করে ফেলেছেন। বাস থামানো হলো। ওই যাত্রী তাঁর সঙ্গের দু-তিনজনসমেত নেমে গেলেন পথের পাশের বাড়িতে, কাপড় পাল্টাতে। তাঁদের ফিরতে দেরি হচ্ছে। এদিকে বাসের সবাই অস্থির, ‘ওই কন্ডাক্টর, বাস ছাড়ে না কেন?’

কন্ডাক্টর বলল, ‘প্যাসেঞ্জার না ফিরলে আমি কী করব?’

একজন যাত্রী বলল, ‘তুমি গিয়ে প্যাসেঞ্জারকে তাড়াতাড়ি ডেকে আনো।’

কন্ডাক্টর হেসে বলল, ‘এরপর বলবেন, প্যাসেঞ্জারের বাড়ি গিয়ে তার কাপড় ধুয়ে নিয়ে আসো।’

৪৫৪৬ পঠিত ... ২০:৩৬, এপ্রিল ২৯, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top