আমার ভাইয়ের ব্লাডে রাঙানো টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি!

১৫৩৫৪২ পঠিত ... ১৩:০০, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি; চারিদিকে সাজ সাজ রব। ভ্যালেন্টাইন্স ডে চলে যাবার এক সপ্তাহের মধ্যে আরেকটা ফেস্টিভ্যাল চলে আসাতে এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাদের মাস্টারের কাছে গিয়ে মাইন্ডের ইচ্ছাটা জানায়, টিচার, আমরা টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি ফেস্ট করতেসি। কী লিখতে হবে বুজতেসি না; আপনি যদি কাইন্ডলি একটু হেল্প করেন। মাস্টার বাংলা টিচারকে ফোন করে বাচ্চাদের হেল্প করতে বলেন। বাংলা টিচার বসে বসে পত্রিকায় একুশে ফেব্রুয়ারির দিনের খাবারের রেসিপি পড়ছিলেন আগ্রহভরে। কাচ্চি বিরিয়ানি আর কেকের দুটো রেসিপি। 

ছবি: সংগৃহীত

এমন সময় ছাত্রছাত্রীরা আসে, মিস প্লিজ বাংলায় কিছু লিইখা দেন। বাংলা টিচার অমর একুশের প্রভাত ফেরির গানের  লাইন লিখে দেন, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কী ভুলিতে পারি।" তারপর একবার পড়ে শোনালে এক ডেঁপো ছাত্র মাথা নাড়ায়; গট ইট মিস।

এক ছাত্রী ম্যাডামের টেবিলের ওপর পত্রিকায় একুশের রেসিপিতে কেকের ছবি দেখে চট করে স্মার্টফোনে ছবি তুলে নেয়। 

ছবি: সংগৃহীতছাত্রছাত্রীরা বাংলা টিচারের লিখে দেয়া লাইনটা শুনে আর কেকের ছবি দেখে বোঝে একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে রক্তের একটা সম্পর্ক আছে। তারমানে শহীদ হয়েছিলো কেউ। গুগুল সার্চ দিয়ে খুঁজে পেতে কিছু ছবি বের করে গ্রাফিক্স গিক বন্ধুকে দিয়ে পোস্টারের নক্সা করিয়ে নেয় তারা। যথারীতি স্কুলের সামনে ব্যানার টানিয়ে দেয়া হয়। একুশের রেসিপি কেক বানিয়ে আনা হয়। কয়েকজন ছাত্রী একুশের সাজসজ্জার ফিচার পত্রিকায় দেখে লিপস্টিক ধেবড়ে ঠোঁটের দু'পাশে দিয়ে চলে আসে টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি ফেস্টে। ফেস্ট শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা জানতে পারে, ফেসবুকে তাদের ব্যানার নিয়ে কী যেন সমালোচনা হচ্ছে।

ফেসবুকের বিবেকেরা অত্যন্ত আহত হয়েছেন। একজন বিলাপ করেন, এ-ও দেখতে হলো; কোথায় একুশে ফেব্রুয়ারীর ব্যানারে ভাষা শহীদদের ছবি থাকবে; তা না জুড়ে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংকট হচ্ছে শেকড় সঞ্জাত সংস্কৃতি-ইতিহাস ওদের শেখানো হয়না। এই স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া জরুরী। এদের সঙ্গে মাদ্রাসার কোন পার্থক্য নেই। দেশজ সংস্কৃতি বিমুখ করে শিশু-কিশোরদের গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র এগুলো।

ওদিকে ২১ নম্বর ওয়ার্ডের পাটোয়ারী ভাই ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে বারো রকম লীগের পক্ষ থেকে একটি পোস্টার ছাপিয়েছেন। এক জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্রকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন পোস্টারের ভাষা। ওয়ার্ডের সবাই এই জিপিএ ফাইভ ছেলেটাকে খুবই স্নেহ করে। ওয়ার্ডের মেধাবী ছেলেটি লিখে দিয়েছে, "হে অমর ফেব্রুয়ারী হাজারো মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে শহীদ দিবস আমি কি ভুলিতে পারি।" পাটোয়ারী ভাই বলেন, আবার পড়তো ভাই। ছেলেটি আবার পড়ে। পাটোয়ারী ভাই ছেলেটির পিঠে থাবা দিয়ে বলেন, ব্রাভো; একুশ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘের বাচ্চা লিখচে, ভালা নাই হইয়া যাইবো কই!  পোস্টারের একপাশে তৈলব্রতধর্মী কয়ডা লাইন লিইখা দাও ছোড ভাই। 

ছবি: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম

এই পোস্টার দেখে খোদ আওয়ামী লীগের লোকেরাই মাথায় হাত দিয়ে বসেন, ৫২-র ইতিহাসের সঙ্গে ৭১-এর ইতিহাস এইভাবে কেউ গুলিয়ে ফেলে! তবু কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করে; ফটোশপও হইতে পারে! দলের ভাবমূর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র। একজন ধামাচাপাজীবী বলে, স্পিরিটটা কিন্তু ঠিকই আছে; একুশের আলোক সরণি দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের গন্তব্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। একজন সমালোচনাজীবী বলে, ইতিহাসের কথা এতো ঘুরাইয়া প্যাঁচাইয়া কঠিন কইরা না কইয়া একটু সহজ কইরা কইলেই তো পারেন; পোলাপান তাইলে আর এইরকম ভুল করবো না।

ওদিকে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির আস্থাভাজন টিনু ভাইয়ের পক্ষে যুবলীগের জাবেদ ভাই ছেপেছেন আরেক পোস্টার। খুঁজে পেতে পুরু লেন্সের কড়া পাওয়ারের চশমা পরা পাড়ার এক আঁতেলকে খাতির করে পোস্টারের ভাষা কী হবে তা লিখিয়ে নেয়া হয়। আঁতেল লিখেছে, "২১শে ফেব্রুয়ারী ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী।" এর আগে জাবেদ ভাই দেখেছেন, বিভিন্ন পোস্টারে বীরশ্রেষ্ঠর ছবি থেকে জাতীয় নেতাদের ছবি সবার ক্ষেত্রে নাম আর ছবির গড়বড় হয়; তাই পোস্টারে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও জয়; যে ছবিগুলোতে ভুল হবার ভয় আপাততঃ নাই সেগুলো ছেপেছেন জাবেদ ভাই, নিজের ও যার পক্ষে পোস্টার ছেপেছেন সেই টিনু ভাইয়ের ছবিসহ। 

 

ছবি: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম

আবার একই ভুল; পাকিস্তানী শাসকের থাবা থেকে ভাষা মুক্তির সংগ্রামে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছিলেন কয়েকজন অকুতোভয় ভাষা সৈনিক।  আর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের মুক্তির যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এই যুদ্ধের সময় ২ থেকে ৪ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটে। এইটুকু তথ্য মনে রাখতে না পারার কারণ খুঁজতে থাকে সবাই। শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা, আয়োডিনের অভাব নাকি কমনসেন্সের সমস্যা; নাকি ফরমালিনযুক্ত খাবার খেয়ে এরকম হচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে থাকে সবাই। এই ভুল দেখে এক বামপন্থী বলেন, আওয়ামী লীগের ছেলেরা একদম পড়ালেখা করেনা। ভুল তো হবেই।

 

ছবি: সংগৃহীত

আরেকজন দেখায়, যুবমৈত্রীর নাজমুল তার ছাপা পোস্টারে লিখেছেন, গাজীপুর মহানগরবাসী ও সকল ভাষা শহীদদের জানাই রক্তিম ফুলের শুভেচ্ছা। সবটা ঠিকই ছিলো, শোকদিবসে শুভেচ্ছা জানানোতেই গড়বড়। ফেসবুকের সঙ্গে মাছির মত আটকে থাকা এক ভুক্তভোগী গেয়ে ওঠে, এই পোস্টারের পাতায় পাতায় যা লেখা সবি ভুল; ভুল সবি ভুল। 

ওদিকে শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে একুশের গভীর আবেগ নিয়ে টিভিতে ইন্টারভিউ দেন এক অভিনেত্রী। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, এই যে শহীদ মিনারে অনেকে জুতা-স্যান্ডেল পরে ওঠে; এটা কী ঠিক। অভিনেত্রী প্রায় অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেন, এগুলো পারিবারিক শিক্ষার ব্যাপার; ভাবতেও কষ্ট হয়। আমরা আর কতো নীচে নামবো!

কিছুক্ষণ পরে অভিনেত্রীকে স্যান্ডেল পরে শহীদ মিনারের বেদিতে হাঁটাহাঁটি করতে দেখে টিভি সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনি নিজেই স্যান্ডেল পরে হাঁটলেন যে শহীদ মিনারের বেদিতে! অভিনেত্রী ৩৬০ ডিগ্রির কথামোচড় দিয়ে বলেন, জুতা-স্যান্ডেল ব্যাপারটাতে কিছু নেই। আসল হচ্ছে ভাষাকে আমি কীভাবে ভালোবাসি; চর্চা করি সেটা।

১৫৩৫৪২ পঠিত ... ১৩:০০, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭

আরও

 

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top