আ জার্নি ফ্রম ওস্তাগর টু রাজমিস্ত্রী

১২৫ পঠিত ... ১৬:৪০, নভেম্বর ২৫, ২০২৩

13

ভোর থেকে কাজের অপেক্ষায় বসে থাকতেন রাজমিস্ত্রি বা ওস্তাগরের দল। একটা লোহার ডালি, কাঠের লেভেলার, আরও কিছু আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে থাকতেন তারা কাজের অপেক্ষায়। সকালে ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে চোখে পড়ত এমন দৃশ্য। গ্রামের মানুষ কিছু বাড়তি উপার্জনের জন্য ঢাকায় এসে ভিড় করতেন।

উনিশ শতকের শেষদিকে ঢাকার নামকরা ওস্তাগর ছিলেন, কলতাবাজারের আদি বাসিন্দা মজু ওস্তাগর ওরফে হাজি আবদুল মজিদ, গনি ওস্তাগর ও রহমান ওস্তাগর তিন ভাই। ঢাকায় তাদের নির্মিত স্থাপত্যের মধ্যে পুরানো হাইকোর্ট ভবন, ঢাকা জেলা কালেক্টরিয়েট ভবন উল্লেখযোগ্য। মজু ওস্তাগর পরে ঢাকা পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। তাঁর পুত্র আবদুল মোন্নাফ সরদার ঢাকা পৌরসভার কমিশনার ছিলেন। সে সময় ঢাকায় যে পাঁচটি বিলাসবহুল রোলস রয়েস গাড়ি ছিল তার একটি রোকনপুরের প্রথম লেনের বাসিন্দা আবদুল মোন্নাফ সরদার ব্যবহার করতেন।

ঢাকার নির্মাণ ইতিহাস ইংরেজ শাসনের ইতিহাস। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে কিছুকালের জন্য হলেও ঢাকা এ দেশের রাজধানী হয়। সেই সময়ে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং, হাইকোর্ট বিল্ডিং, কার্জন হল, বর্ধমান হাউস, হুদা হাউস, চামেরী হাউসসহ নীলক্ষেতে আরও কিছু ইমারত গড়ে ওঠে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্থাপনাশিল্পে ঢাকার মোড় অন্যদিকে ধাবিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক আর আনুষঙ্গিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে বসতিবলয়। '৪৭-এ দেশ বিভাগের ফলে আরও একধাপ এগিয়ে যায় ঢাকার স্থাপনাশিল্প। সেই সময়ে ঢাকায় এক নির্মাণ শ্রমিকশ্রেণি গড়ে ওঠে, তাদের বেশ কদরও ছিল। এদের ওস্তাগর বলা হতো। এদের জীবন নিয়ে সে সময় রাস্তার নামকরণ হয়, ছবিও তৈরি হয় '১৩ নং ফেকু ওস্তাগর লেন'।

ইট বসানো ও পলেস্তারা করা ছিল ওস্তাগরদের প্রধান কাজ। তাদের সহযোগী জোগালি চুন-সুরকি মিশিয়ে দিলে তারা কাজ করত। শহরের নামকরা ওস্তাগরদের সমাজে বেশ সম্মান ছিল।

'দে দে স্টালিন ভাই,

পায়ে পড়ি ছাইড়া দে।

আমি হিটলার মরি লাজেতে।'

চল্লিশের দশকে ঢাকায় মুসলিম ওস্তাগরদের প্রিয় একটি ছাদপেটানোর গান ছিল এটি। গান গেয়ে তালে তালে আঘাত করে ছাদ পেটানো হয়। একজন বয়াতি গান গায়, তার শ্রমিকরা শুধু দুয়া বা দিনা ধরে তালে তালে ছাদ পেটায়। একসময় ঢাকায় এ গান বেশ জনপ্রিয় ছিল।

'দে দে কানাইয়া লাল বসন আমার হাতে দে'

এবং

'ঢাকা থেকে আইনা দিও আবের চিরুনি'

বিভিন্ন ঘরানার গানের মতো ঢাকার ছাদ পেটানির গানের ছিল নিজস্ব ধরন। অনেকে ধারণা করেন ঢাকার সংগীতের ধারাবাহিকতায় ঢাকার ছাদ পেটানো গানের আছে নিজস্বতা। ওস্তাগরদের জীবন ছিল খুবই আমোদপ্রবণ। কাজ চলত তাদের গানে গানে।

 

 

'জজ সাহেবের টেরি মাইয়া

পেখম মেলাইছে

মহব্বতের রশির টানে

উধাও হইয়াছে।

কেলাস নাইনের ছাত্র আছিল

গতর শোভা ভালোই আছিল

কেম্বে কমু হগল কথা

সরম অইতাছে।‘

এ তো ছিল ছাদ পেটানোর সময়কার গান। খাওয়া-দাওয়া সেরে শ্রমিকরা যখন কাজে যোগ দেয় তখন ভাতঘুম তাড়াতে তারা গাইতো;

‘বিয়া না দিলে দাদা দেশে যামুগা

কসম খাই, তর জরুরে নজর দিমু না

দাদায় শোয় টিনের ঘরে

আমি শুই ছনের ঘরে

দাদার ঘরে খচমচ করে

মন তো মানে না,

বিয়া না দিলে দাদা দেশে যামুগা।‘

১৯১০ সালে শ্রী কেদারনাথ প্রণীত 'ঢাকার বিবরণ' গ্রন্থে সে সময় ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার থেকে ঢাকার কর্মজীবীদের মজুরির তালিকা পাওয়া যায়, সেখানেও রাজমিস্ত্রি বা ওস্তাগরদের উল্লেখ আছে। কেদারনাথের ঢাকার কর্মজীবীদের মজুরি তালিকা:

উৎকৃষ্ট মিস্ত্রি দৈনিক ১২ আনা

সাধারণ মিস্ত্রি দৈনিক ৬ আনা

উৎকৃষ্ট সূত্রধর দৈনিক ৬ আনা

সাধারণ সূত্রধর দৈনিক ৫ আনা

কুলি দৈনিক ২ আনা ১০ পয়সা

স্ত্রীলোক দৈনিক ২ আনা

বালক দৈনিক ৫ আনা

ঘরামি দৈনিক ১০ আনা

উৎকৃষ্ট কর্মকার দৈনিক ৬ আনা

সাধারণ কর্মকার দৈনিক ৫ আনা

১৮৩৮ সালে পেশা ছিল ওস্তাগরি। কারণ একমাত্র রাজা-বাদশাহরা বা জমিদাররা কেবল ইট-সুরকি দিয়ে বাসস্থান বানাতে পারতেন। তাই হয়তো এদের নাম রাজমিস্ত্রি হয়ে যায়। এই পেশার কদর ছিল রাজরাজড়াদের কাছে। কাজেই তাদের জীবনযাপনও ছিল খুব আয়েশি। তাই তো সেই সময়কার ঢাকার সেরা জায়গাটি রায়সাহেব বাজারের পাশে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারা রাজকর্ম সম্পন্ন করে একেকজন ধনপতি বনে যান। 

তথ্যসূত্র: ঢাকার প্রাচীন পেশা ও তার বিবর্তন, ইমরান উজ জামান

 

১২৫ পঠিত ... ১৬:৪০, নভেম্বর ২৫, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top