বেগম রোকেয়ার রম্যরচনা 'বিয়ে পাগলা বুড়ো'

২৫০০ পঠিত ... ১৮:২৩, এপ্রিল ২৫, ২০১৯

শুনিয়াছি সারদা বিল পাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘কচি মেয়ের সহিতে বুড়ো বরের বিবাহ নিষিদ্ধ’ বলিয়া আরেকটা বিল পাস হইবার কথা ছিলো।  ব্যবস্থাপক সভায় এই বিল পাস হইলে শরিয়তের নামে তাহার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা হইতো কিনা, তাহা অনুমান করা সহজ নহে। অদ্য দুই তিনজন বিয়ে পাগলা বৃদ্ধের ইতিহাস পাঠিকা ভগিনীদের উপহার দিবো।  আশা করি ইহা পাঠে তারা অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিবেন না।

পূর্ববঙ্গের একটি পল্লীগ্রামে একজন সত্তরবর্ষীয় বর ক্রমে সাত জন বিবিকে জান্নাতে পাঠাইয়া দিয়া অষ্টমবার বিবাহ করিতে চাহিলেন। গ্রামের দুষ্ট লোকেরা বেচার দুর্নাম রটনা করিয়াছিলো যে, বুড়ো বউ-খেকো; কাজেই আর কেহ তাহাকে কন্যাদানে সম্মত হয় না। মাতবর সাহেব বৃদ্ধ হইলেও বিবিধ খেজাবের কল্যাণে তাহার মাথার চুল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ছিলো, দাড়িগোফ কলপরঞ্জিত করিয়া ভ্রমরকৃষ্ণ মুখশ্রী  বেশ সুন্দর করিয়া লইয়াছেন। তাহার নগদ টাকাও যথেষ্ট আছে, বাক্সভরা রূপার গয়না,   একটা সোনার সিঁথি ও হলুদ মাকড়ি, সিন্দুকভরা কাপড়, তবু কোনো হতভাগা তাহাকে কন্যাদানে সম্মত হয় না।

অবশেষে পাড়ার কতিপয় যুবকের মনে দয়ার উদ্রেক হইলো। তাহারা বহু কষ্টে একতি পাত্রী ঠিক করিয়া মাতবর সাহেবকে জানাইলো যে, কুমারী মেয়ে পাওয়া গেলো না, একটি বাল-বিধবা আছে। বয়স একটু বেশি, ২২-২৩ বৎসর, আর একটু হৃষ্টপুষ্ট লম্বাগোছের মেয়ে। তিনি চিন্তা করিয়া বলিলেন, তা ভালোই, কুমারী যখন পাওয়া গেলো না, তা কী আর করা।‘

ঘটকেরা বলিল, ‘বিধবা বটে, তবে ৫ বৎসর বয়সে বিবাহ হইয়াছিলো, ছয় মাসের মাথায় বিধবা হয়, তদবধি পিতামাতার অন্ন ধ্বংস করিতেছে; এখন যুবকেরা তাকে পাত্রস্থ করিতে চায়। যদি আপনি পছন্দ না করেন, তবে এ সম্বন্ধ ছাড়িয়ে দেওয়া হউক।‘

বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি সোৎসাহে বলিলেন, না, না, এ সম্বন্ধ ছাড়া হইবে না। বয়স একটু বেশি হওয়ায় সুবিধাই হইবে, ভালো মতো ঘর গেরস্তি করিতে পারিবে।

যথাকালে মাতবর সাহেব বরবেশে বিবাহসভায় উপস্থিত হইলেন। বিবাহ বেশ ঘটা করিয়া হইতেছে, ঘটকেরা তাহার নিকট হইতে অনেক টাকা পয়সা লইয়া খুব ধুমধামের সহিত আয়োজন করিয়াছে।

কনের সম্পর্কের এক নানী এবং পাড়ার ছেলের দল বিবাহসভায় উপস্থিত হইয়া আচার পদ্ধতি পালন করিতেছে -এ নিয়ম,সে নিয়ম নিয়ম আর শেষ হয় না।   ছোকরাগুলি মুখ টিপিয়া হাসে, আর ফিসফিস করিয়া নানিবিবির সহিত কথা কহিয়া সেই উপদেশমতো কাজ করে। বরের সম্মুখে বড় মোটা খেরুয়ার পর্দা, সেই পর্দার অপর পার্শ্ব হইতে স্ত্রীলোকদের চাপ হাসি শোনা যাইতেছে। বর অধীরভাবে শুভ দৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করিতেছেন, বিলম্বের জন্য মনে মনে গ্রাম্য আচার-পদ্ধতির মুন্ডুপাত করিতেছেন।

তিনি পার্শ্বউপবিষ্ট কনের অলঙ্কারের মৃদু ঝনঝনি শুনিতেছেন, আর সতৃষ্ণ নয়নে কনের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন। পাত্রীর হাত পা সব মোটা বারানসী শাড়ীতে ঢাকা, কিছুই দেখা যায় না, কেবল ক্রেপের ওড়নার ভিতর হইতে বাদলা জড়ানো দীর্ঘ চুলের বেনি দেখা যাইতেছে,  চুলের বেনিটা কনের পিঠ বাহিয়া ফরাশের উপর পড়িয়াছে। বৃদ্ধ দেখিয়া ভারি সন্তুষ্ট যে আর কিছু না হইলেও আমার বউ যে কেশর-রানী! এ গ্রামে এমন লম্বা চুল কার কার আছে?

অনেকক্ষণ প্রাণঘাতী ধৈর্যের পর দর্পন আসিল, এখন শুভদৃষ্টি। অবগুণ্ঠন তুলিবার পর পর্দার অপর পার্শ্বস্থিত চাপা হাসি কলহাস্য পরিণত হইলো। এদিকে বৃদ্ধ চমকাইলেন, বউয়ের মুখে মুখে ইয়া দাড়ি, ইয়া গোঁফ, বউ খিলখিল করিয়া হাসিয়া মাথার পরচুলাটা খুলিয়া সম্মুখে রাখিল। হতভম্ব বর তখন দাড়িগোঁফশোভিত  কনেকে চিনিলেন যে, সে সম্পর্কে তাহার নাতি কলুমিয়া, সে দন্ত বিকাশ করিয়া বলিল, নানাজান শ্যাষে আপনে আমারে বিয়া করলেন?’ মাতবর সাহেব অতিক্রোধে কি বলিবেন ঠিক করিতে না পারিয়া কেবল বলিলেন, তোমরা যে এমন নাদান তা জানতাম না সক্রোধে সেই বাদলা-জড়ানো সুন্দর বেনিটাকে তুলিয়া এক আছাড় দিলেন। পরে যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে সে স্থান ত্যাগ করিলেন।

*'অবিকল সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত' - বেগম রোকেয়া 

[বেগম রোকেয়া রচনাবলি থেকে সংকলিত] 

২৫০০ পঠিত ... ১৮:২৩, এপ্রিল ২৫, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top