ডক্টর গোবিন্দচন্দ্র দেবের নির্জলা কিছু রসিকতা

৮০২ পঠিত ... ১৬:৫৫, জানুয়ারি ২৬, ২০২২

dr-gc-deb-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান, জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ, অকৃতদার ড.গোবিন্দচন্দ্ৰ দেব, (সংক্ষেপে জি. সি. দেব) এর নাম শোনেননি এমন কে আছেন? রাখঢাকহীন স্বভাবের খোলামেলা এবং কৌতুকপ্রিয় এই অধ্যাপক ছিলেন ছাত্রদের ভেতর অত্যন্ত জনপ্রিয়। তীক্ষ্ণ রসালো হাস্যকৌতুকে তিনি সবসময় উপচে থাকতেন। তাঁর সেই রসিকতাগুলো ছিল তখনকার সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিসগুলোর একটি। 

তাঁর বাড়ি ছিল সিলেটে, উচ্চারণের সিলেটি ভঙ্গি ছিল পুরো দরজা-জানালাহীন। তাঁর রাখঢাক ছাড়া নির্বিকার কথাবার্তার সঙ্গে মিশে সে-ভঙ্গি হয়ে উঠত আরও হৃদয়গ্রাহী। ছোট্ট চটুল কথাবার্তার ভেতর দিয়ে গভীর বিষয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গভাবে চলে যেতেন ড. দেব। তাঁর অনেক মজার উক্তিই সেকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। সেসবের মধ্যে যে-রসিকতাটি সবাইকে প্রথমে হতবিহ্বল করে পরে তুমুল হাসিয়েছিল সে-গল্পটা তাঁর নিজের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি মহিলা হলের বর্ষীয়সী প্রাধ্যক্ষ প্রসঙ্গে।

মুখে-মুখে চাউর-হয়ে-যাওয়া সেই গল্পটা ছোট্ট। হঠাৎ দেখা গেল সেই প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে ড. দেবের বেশ জমজমাট ভাব। সবার চোখ গোল হয়ে কপালে উঠল । ব্যাপার কী! শেষে কি এই বুড়ো বয়সে...! দুষ্ট লোকদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। দুজনার মধ্যে মিল অনেক। দুজনেই দর্শনের অধ্যাপক। দুজনেই প্রাধ্যক্ষ। হল দুটোও পাশাপাশি। দুজনেই বৃদ্ধ। একজন অকৃতদার, একজন বিধবা। গভর্নর হাউসের (এখনকার বঙ্গভবনের) নিমন্ত্রণে হুড-খোলা রিকশায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে একই সঙ্গে তাঁরা যাত্রা করেন, বঙ্গভবনের কাছে গিয়ে একই সঙ্গে নামেন। এর পরে এ নিয়ে সন্দেহের আর থাকেই-বা কী! ব্যাপারটা নিয়ে ছাত্রমহলে কানাঘুষা যখন বেশ তুঙ্গে, সেই সময় শোনা গেল একদিন চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়ানো একদল ভক্ত ছাত্রের সামনে নিজেই তিনি গল্পটার আসল তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন।

'তোমোরা যে আমার সম্বন্ধে খী সব খতা বোলো। মিসেস... এর সঙ্গে আমার নাকি খীসব সম্পর্ক আছে।' বলে ছাত্রদের সলজ্জভাবে হাসতে দেখে খুলেই বললেন তিনি আসল সম্পর্কটা।

সম্পর্ক আছে বৈকি, খিন্তু সে সম্পর্ক দুধ খাওয়ার সম্পর্ক।

লজ্জায় স্তব্ধ সবাই। এ কী ভয়াবহ কথা বলছেন অধ্যাপক দেব! কিন্তু না, ভয় নেই। এই বিপন্ন অবস্থা থেকে ছাত্রদের নিজেই উদ্ধার করলেন তিনি। ব্যাপারটা শুনতে যত ভয়াবহ আসলে ততটা নয়। পরের বাক্যটা শুনলেই সব খোলাসা হয়ে যাবে।

'প্রত্যেখ দিন শোখাল বেলায় মিসেস... আমাকে কিছু দুধ পাঠিয়ে দেন।

 হাফ ছেঁড়ে বাঁচে সবাই। এইজন্যেই সম্পর্কটা 'দুধ খাওয়ার সম্পর্ক'। মিসেস...এর বাসায় গোটাকয় দুধেল গরু আছে, প্রত্যেকদিন সকালবেলায় সেই অপর্যাপ্ত দুধের সামান্য অংশ শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ড. দেবের বাসায় পাঠিয়ে দেন তিনি। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে সেই দুধ পান করেন। কী থাকতে পারে এই নিরীহ ব্যাপারটার মধ্যে। কিন্তু এর পরেই তাঁর বক্তব্যের শেষ যে-বাক্যটি সবাইকে আপাদমস্তক হাসিয়ে মারে তা আরও আতঙ্ককর : সম্পর্খ আছে বৈকি খিন্তু সে-সম্পৰ্খ ফিজিখ্যেল সম্পর্ক নোয়, সে-সম্পর্ক মেট্টা-ফিজিখ্যেল সম্পর্ক। হে হে হে হে।

কথার শেষে সামনে দাঁড়ানো ছাত্রের ভুঁড়িতে জোরে খোঁচা দিয়ে সকলের সাথে যোগ দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন ড. দেব।

আরেকবার ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব অল পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেসের সভাপতি হিশেবে যোগ দিতে যাচ্ছেন রাজশাহীতে। উঠেছেন ট্রেনের ফার্স্টক্লাসে। হাঁটু অব্দি তোলা ধুতি, মোটাসোটা কালো দোহারা গেঁয়ো লোকটাকে দেখে চেকারের সন্দেহ হয়েছে আসলে তিনি ফার্স্টক্লাসের যাত্রী কি না। দূর থেকে আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়ে কাছে এসে হাতের ইশারায় টিকিট দেখাতে বলল সে।

চেকার যে তাঁর ফার্স্টক্লাসে যাওয়াটাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, ব্যাপারটা স্যার বেশ কিছুক্ষণ ধরেই উপভোগ করছিলেন। টিকিট চাইতেই তিনি মুখটাকে নির্মল হাসিতে উদ্ভাসিত করে সেটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, হেঁ হেঁ হেঁ, দো আই লুক লাইক থার্ডক্লাস প্যাসেঞ্জার ইয়েট আই হ্যাভ ফার্স্টক্লাস টিকিট... হেঁ হেঁ হেঁ।'

বলেই দুচোখে কৌতুকপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে চেয়ে রইলেন চেকারের দিকে। অপ্রস্তুত চেকার ধাক্কা সামলে নেবার আগেই আবার বললেন, আই হ্যাভ ফার্স্টক্লাস টিকিট বিখজআই এম দ্যা হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট অফ ফিলসফি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফর দ্য লাস্ট সেভেন ইয়ার্স, হেঁ হেঁ হেঁ আই হ্যাভ ফার্স্টক্লাস টিকিট বিখজআই অ্যাম গোয়িং টু রাজশাহী টু অ্যাটেন্ড দি অল ফাখিস্তান ফিলসফিখ্যেল খংগ্রেস অ্যাজ চেয়ারম্যান অফ দি ওপেনিং সেশন, হেঁ হেঁ হেঁ।

এভাবে চেকারকে তাঁর যাবতীয় তথ্য একের পর এক এমনভাবে পরিবেশন করতে লাগলেন যে চেকারের অবস্থা হয়ে দাঁড়াল করুণ। দার্শনিক হিশেবে তিনি ছিলেন যথেষ্ট উঁচুমাপের। একদিকে দার্শনিক চেতনা অন্যদিকে শিশুসুলভ অবৈষয়িক ও আপনভোলা হৃদয়ের মানুষ হিশেবে তিনি ছিলেন একেবারেই আলাদা। তাঁর সঙ্গে কারো কোনো মিল হবার উপায় ছিল না।

এই আলাভোলা মানুষটি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন একটু মনে করিয়ে দেই। উনিশশো একাত্তর সালে পঁচিশে মার্চ রাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের নারকীয় হত্যালীলার সময় তিনি দুশো ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে শহীদ হন। গভীর রাত্রে চারপাশের তাণ্ডবলীলার মধ্যে একদল পাকিস্তানি সৈন্য উন্মত্তভাবে তাঁর বাসায় ঢুকে দরজায় বুট দিয়ে লাথি মারতে মারতে তাঁকে বাইরে আসার হুকুম করতে থাকে। দরজা খুলে তিনি সৈন্যদের সামনে এসে দাঁড়ান। সৈন্যদের সুবেদার তাঁকে জিগ্যেস করে, ‘কেয়া তুম হিন্দু ইয়া মুসলমান হো?’

উনি স্বভাবত সত্যবাদিতার সঙ্গে নিজের সঠিক পরিচয়ের কথা বলেন। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ বুলেট তার শরীর ঝাঁজরা করে বেরিয়ে যায়। যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানেই হাঁটুমুড়ে পড়ে যান ড. দেব।

তিনি হিন্দু না মুসলমান একথাই তাঁকে জিগ্যেস করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যদল, কিন্তু তিনি মানুষ ছিলেন কি না, থাকলে তা কতখানি একথা কেউ জিগ্যেস করেনি! তা হলে নিশ্চয়ই জি.সি দেব সেদিন আমাদের ছেড়ে যেতেন না...

(আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিষ্ফলা মাঠের কৃষক গ্রন্থ হতে সংগৃহীত ও পরিমার্জিত)

 

৮০২ পঠিত ... ১৬:৫৫, জানুয়ারি ২৬, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top