হিমুর হাতে পাঁচটি মনোনয়নপত্র

২৮৫১ পঠিত ... ২৩:৫১, নভেম্বর ১৩, ২০১৮

‘হিমু ভাই, হিমু ভাই... ভাই উঠেন।’

আমি চোখ না খুলেই কার কন্ঠ তা বোঝার চেষ্টা করলাম। আধো ঘুম আধো জাগরণের অবস্থায় কারো কণ্ঠ চেনা সহজ ব্যাপার নয়। তবে আমি সহজেই চিনতে পারলাম, মেসের ম্যানেজার আবদুস সোবহান সাহেব। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। গত মাসে দোতলার কোনার ঘরে একদল ছোকরা বাইক ছাড়াই হেলমেট পরে ঘোরাঘুরি করছিলো, তখন সোবহান সাহেবকে এমন উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। অনেকদিন পর মেসে উত্তেজিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে, ভাবতেই ভালো লাগছে।

‘হিমু ভাই, উঠেন মিয়া। আরে, হিমু ভাই...’

যেহেতু আমি এখন আর ঘুমাচ্ছি না, সুতরাং ঘুম থকে ওঠার কোনো সুযোগ আমার এখন নেই। চাইলেই চোখ খুলতে পারি, কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে না। কল্পনায় সোবহান সাহেবের উত্তেজিত চেহারা দেখতে ভালো লাগছে। তাছাড়া সকালে ঘুম ভাঙার পর চোখ না খুলে চুপচাপ পড়ে থাকার মধ্যেও একটা আরামদায়ক আলস্য আছে। সরকারি দলের বড় মানুষরা সম্ভবত সারা বছরই এই আরাম উপভোগ করেন।

আমি চোখ না খুলেই বললাম, ‘কী ব্যাপার সোবহান সাহেব? ঘটনা কী?’

সোবহান সাহেব আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে আমাকে ডাকছিলেন, আমি কথা বলে ওঠার পর তড়িৎগতিতে হাত সরিয়ে নিলেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি আমাকে কিছুটা ভয় পান। অবশ্য সোবহান সাহেবকে দেখে মনে হয়, আশেপাশের বেশিরভাগ জিনিসই তিনি ভয় পান। কিছু মানুষের ভয় পাওয়ার ব্যারাম থাকে। তারা কারণে-অকারণে ভয় পেতে ভালোবাসে।

‘হিমু ভাই, সজাগ আছেন দেখি! আপনে ইলেকশনে দাড়াইবেন এইবার, আগে বলবেন না? একটা প্রস্তুতির তো ব্যাপার আছে। গতকাল এই খবর জানলে আজকে মেসে মোরগ-পোলাও রান্না করার কথা বলে দিতাম।’

আমি চোখ বন্ধ রেখেই বললাম, ‘আমি ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছি সেটা আমিও জানতাম না। জানলে বলে দিতাম।’

‘কী যে বলেন হিমু ভাই! আপনার মতিগতি বোঝা কঠিন। যাই হোক, সব আয়োজন হবে। আপনে উঠেন, বাদল ভাই নিচে পোলাপানের জটলা নিয়ে আসছে, নিচে নেমে আলাপ সারেন। আর বাদল ভাইকে একটু বলে দেন মেসের ভেতরে ঢুকে যেন স্লোগান-টান না দেয়। মেসে তো নানান রাজনৈতিক চিন্তার লোক আছে, আপনি তো এগুলা বুঝেনই।’

‘আপনি বাদলকে উপরে আসতে বলেন। আমি দেখতেছি কী ব্যাপার।’

আমি চোখ না খুলেই টের পেলাম, সোবহান সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছেন। বেরোনোর পথে বদিকে ডেকে আমার ঘরে দুই কাপ চা পাঠাতে বললেন। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। জানালা দিয়ে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। নিচের রাস্তায় এত মানুষের ভিড় কেন বুঝলাম না। এরাই কি সেই ‘পোলাপান’?

আমি মীনা কার্টুনের মীনার মতো চোখ ডলে নিচে কী হচ্ছে ভালোমতো বোঝার চেষ্টা করলাম। নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের জটলা, সেটা বোঝা যাচ্ছে। অনেকগুলো বাইক দাঁড়ানো, একটা পিক-আপ। পিক-আপে সাউন্ড সিস্টেম লাগানো দেখছি, গান-বাজনা হচ্ছে না যদিও। বড় বড় পোস্টার দেখা যাচ্ছে। পোস্টারে আমার বিরাট ছবি। ফটোশপে বানানো মনে হচ্ছে, এমন মুচকি হেসে কোনো ছবি আমি তুলেছি বলে মনে পড়লো না। স্লোগান টাইপ ব্যাপার স্যাপারও আছে, ‘হলুদের শুভেচ্ছা নিন, হিমু ভাইকে ভোট দিন’, ‘হিমু ভাইয়ের দুই নয়ন, ঢাকা শহরের উন্নয়ন’, ‘হিমু ভাই জিতবে ভোটে, সবার হাসি ফুটবে ঠোঁটে’, ইত্যাদি। ভোট আর ঠোঁটওয়ালা স্লোগানটা নতুন মনে হচ্ছে। বাদলই লিখেছে নাকি?

আমি মনে মনে সুর করে কয়েকবার বলতে চেষ্টা করলাম, ‘হিমু ভাই জিতবে ভোটে, সবার হাসি ফুটবে ঠোঁটে’। স্লোগানচর্চা চলার সময় বাদল ঘরে ঢুকলো।

‘হিমু ভাই, তুমি এখনো বিছানায়? ওঠো মিয়া। মিছিল দিতে হবে না?’

‘কিসের মিছিল? বাদল, ব্যাপারটা একটু বুঝায়ে বল। ঘটনা কী?’

বাদল আয়েশ করে চেয়ারে বসলো। বদি এরই মধ্যে দুই কাপ চা দিয়ে গেছে, বাদল এক কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আরেক কাপে চুমুক দিয়ে বললো, ‘ঘটনা আর কী! ভোট হইতেছে, তুমি ভোটে দাড়াইবা না, সেইটা কীভাবে হয়! তোমারে বললে তো তুমি সিরিয়াসলি নিবা না কিছুই। যা জোগাড়যন্ত্র করার আমিই করে ফেলেছি।’

‘কী জোগাড়যন্ত্র করেছিস?’

‘আরে সব সেট। টোটাল মনোনয়ন পত্র কিনছি ৫টা। আওয়ামী লীগ থেকে দুই আসন, বিএনপি থেকে দুই আসন।’

‘আরেকটা কী? জাতীয় পার্টি?

‘আরে না! আরেকটা হইলো স্বতন্ত্র! যদি কেউই নমিনেশন না দেয়, একলা নির্বাচনা করবা। সমস্যা তো নাই। সব সেটাপ দিয়ে দেয়া হবে।’

আমি চুপচাপ চায়ে চুমুক দিলাম। মনে হলো বাদলের মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে খালু যেসব কথা বলেন, তেমন ভুল বলেন না।’

‘শুনো হিমু ভাই, নমিনেশন কোন দল দিতেছে, এইটা কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হইলো, পার্ট। পার্টে থাকতে হবে। সব সেটাপ দিয়ে দিছি। পোলাপান ভাড়া করছি টোটাল আড়াইশ। পোস্টার, ব্যানার সব রেডি। এখন আমরা এলাকায় রাউন্ড মারতে বের হবো। তোমার তো নির্বাচনী এলাকা টোটাল পাঁচটা। আমাদের এখন পাঁচটা এলাকায় শোডাউন দিতে হবে। চলো, পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়া নাও।’

‘ব্যবস্থা তো সবকিছু আমারে ছাড়াই করে ফেলছিস। প্রচারণা, ক্যাম্পেইন, ভোট এগুলাও আমারে ছাড়াই করে ফেল। সমস্যা কী?’

‘কী যে বলো ভাই! রসিকতা কইরো না। চটপট রেডি হও। আমি তোমারে প্ল্যানটা বলি। আমাদের প্রথম নির্বাচনী আসন হইলো ঢাকা-১৪। মানে মিরপুর। মিরপুর বোঝো তো, অনেকদূর। পুরা রাস্তা জ্যাম, যাইতে সময়ও লাগবে বেশি। এইটা আরো ভালো। অনেক বেশি সময় ধরে শোডাউন দেয়া যাবে। চলো চলো।’

নির্বাচন আর মনোনয়নের ব্যাপার শুনে তেমন ঘাবড়াইনি, তবে এই মুহূর্তে পিক-আপে উঠে নাচতে নাচতে মিরপুরের মতো দুর্গম জায়গায় যেতে হবে, ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে। আমি পাশে থাকা বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে ফেললাম।

বাদল মনে হয় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসতে চেয়েছিল, পারলো না। উত্তেজনায় সে নিজের অজান্তেই কথা বলা শুরু করলো- ‘শুনো হিমু ভাই, আমাদের বাইক আছে ২০টা। তুমি আমি আমরা থাকবো পিক-আপে। আমাদের সামনে ১০টা বাইক, পিছে ১০টা বাইক। পিক-আপে আমাদের সাথে থাকবে ডিজে হলুদিয়া বার্ড। উনি শুধু হিমু সংক্রান্ত গান নিয়ে ডিজে করেন, অত্যন্ত গুণী মানুষ। অনেক কষ্টে খুঁজে বের করছি মালটারে।’

আমি এই পর্যায়ে কিঞ্চিত আগ্রহ বোধ করলাম। ডিজের নাম হলুদিয়া বার্ড, ব্যাপারটা খারাপ না।

‘শোডাউনটাও হবে ভাই চরম সিস্টেমের। তুমি একটা কইরা কথা বলবা, পোলাপান চিল্লাবে সহমত ভাই। ভাইয়ের এক কথা, চারপাশ থেকে লক্ষ সহমত ভাই। আমরা কাপায় দেবো একেবারে। ভাই তুমি তাড়াতাড়ি নামো, আমি নামলাম। আর এই মনোনয়নপত্র পাঁচটা ধরো। ড্রয়ারে রাইখো, রুমও লক করবা। হারায় গেলে সব গেলো।’

বাদল পাঁচটা মনোনয়নপত্র আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নেমে গেলো। আমি সেগুলো হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছি। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। মনে হয় মাজেদা খালার সাথে কথা বলা দরকার।

আমার মোবাইল (মাজেদা খালার দেয়া) আমার কাছে থাকে না। মেসের মোবাইল অপারেটর আনিসের কাছে আমি জমা রাখি। দরকার হলে ফোন অন করে ফোন দিই, বাকি সময় অফ করে রাখি। আনিস যদিও আমার ফোন ব্যবহার করে। জিজ্ঞেস করলে অবশ্য বাক মুখ কুঁচকে প্রতিবারই বলে ‘হিমু ভাই, আপনার ফোন আমি ইউজ করবো? এইটা একটা কথা বললেন? আমানতের খেয়ানত যে করে, সে তো মুনাফিক? আপনি বলেন ভাই, আমি কি মুনাফিক?’

আমি নিচে নেমে বিশিষ্ট ‘মুনাফিক’ আনিসের কাছ থেকে ফোন সংগ্রহ করলাম। ফোন অন করাই ছিল, আনিস জানালো সে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছিলো। আমি কথা বাড়ালাম না। কল রেকর্ড ঘেটে দেখলাম মাজেদা খালা এরই মধ্যে কয়েকশ বার কল দিয়েছে। আমি মাজেদা খালার নম্বরে ডায়াল করলাম।

‘হ্যাঁ রে, হিমু! কোথায় তুই?’

‘আমি মেসেই। ঘুমাচ্ছিলাম। কী ব্যাপার বলো তো!’

‘ব্যাপার মানে? চারিদিকে এত কান্ড, আর তুই ঘুমাস? বাদল কী শুরু করেছে দেখিসনি?’

‘দেখলাম তো! ওর মাথায় ইলেকশনের ভূত কে ঢোকালো?

‘তোর খালু ছাড়া আবার কে! সে এবার ইলেকশন করছে। ব্যস, বাদলের মাথায় ঢুকেছে তার বাপ যদি ইলেকশন করতে পারে, হিমু ভাইয়েরও ইলেকশন করা উচিত। ব্যাংক থেকে টাকা-পয়সা তুলে কত কান্ড যে করছে! বাসা ভর্তি করে তোর নির্বাচনী পোস্টার লাগিয়ে রেখেছে। তোর খালুর ঘরে লাগিয়েছে টোটাল দশটা।’

‘সর্বনাশ! খালুর অবস্থা কী?’

‘তার আর অবস্থা! মাতাল হয়ে একবার তোকে গালাগাল করে, একবার নিজের ছেলেকে। তুই এক কাজ কর, বাদলকে নিয়ে বাসায় চলে আয়। একসাথে বসে বাদলকে বুঝা, ইলেকশন ক্যাম্পেইন তার যদি করতেই ইচ্ছা হয়, বাবার জন্য করুক। সমস্যা কোথায়?’

‘হ্যাঁ, সেটাই তো। আচ্ছা খালা, আমি আসছি। তুমি পারলে একটু খিচুড়ি বসাও। আজকের দুপুর হলো খিচুড়ি খাওয়ার দুপুর।’

আমি ফোন রাখলাম। রূপাকে একটা ফোন দেয়া দরকার।

‘হ্যালো রূপা।’

‘হ্যালো। কী অবস্থা?’

‘অবস্থা জটিল। তোমার অবস্থা বলো।’

‘বাবা এবার নির্বাচনে মনোনয়ন নিচ্ছে। বাসায় নানান ক্যাচম্যাচ, ঘ্যাচঘ্যাচ। ভালো লাগছে না। চোখ বন্ধ করে মোজার্ট শোনার চেষ্টা করলাম, তারও উপায় নেই। বাইরের প্রচারণার সাউন্ডে মাথা ধরে গেছে। এক ডিজে দেখলাম পিক-আপে চড়ে ‘বি কেয়ারফুল বি কেয়ারফুল’ টাইপ কি একটা গান গাইতে গাইতে গেলো। অসহ্য লাগছে।’

‘বুঝলাম। আচ্ছা, তুমি তো অরিগ্যামি এখনো করো?’

‘করি না, কিন্তু করতে পারবো। কী করতে হবে?’

‘কাগজ দিয়ে পদ্ম বানাতে হবে। পারবা না?’

‘পদ্ম বানানো তো সহজ। পারবো। কয়টা পদ্ম বানাতে হবে?’

‘পাঁচটা। তোমার এখনই বানাতে হবে না। আমি আসছি। আমার হাতে পাঁচটা মনোনয়ন পত্র আছে। সেগুলো দিয়ে তুমি পদ্ম বানাবা। আমরা সেটা ময়ূরাক্ষীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসবো।’

‘মনোনয়ন পত্র মানে? কার মনোনয়ন?’

‘আমার। আমি আসছি, তুমি বাসাতেই থাকো।’

 

আমি আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলাম। মোবাইল অপারেটর আনিস মনোনয়নের কথা শুনে আমার দিকে ভীত ভঙ্গীতে তাকাচ্ছে। আমি হেসে বললাম, ‘আনিস মিয়া, ভোটে তো দাঁড়াইতেছি। দোয়া রাইখো।’

আনিসের হাতে মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে আমি মেসের পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। মনোনয়ন পত্রগুলো পকেটে রাখতে পারলে ভালো হতো। মাঝেমাঝে মনে হয়, পাঞ্জাবিতে অন্তত একটা হলেও পকেট থাকা দরকার।

বের হওয়ার সময় দেখলাম পিক-আপে গানবাজনা শুরু হয়ে গেছে। ডিজে হলুদিয়া বার্ড র‍্যাপ নামক এক বিশেষ সঙ্গীত পরিবেশন করছে, কথাগুলো অনেকটা এমন- ‘ওই ইয়েলো ইয়েলো ভোট ফর ইয়েলো অয় মামা’! আমি ডিজে হলুদিয়া বার্ডকে লক্ষ্য করে হাত দিয়ে ‘ইয়ো’ চিহ্ন দেখালাম, সেও ‘ইয়ো’ ফেরত দিলো।

মনোনয়ন সম্পর্কে বাবা কী বলেছেন তা ভাবতে চেষ্টা করলাম। বাবা কি কিছু বলেছেন? মনে পড়ছে না। তবে বললে হয়তো বলতেন, ‘মহাপুরুষদের নির্বাচনের মনোনয়নের প্রয়োজন নেই। তাহাদের প্রয়োজন মন ও নয়ন। চর্মচক্ষুর নয়ন বাদে যদি মনের নয়ন অর্জন করিতে পারো, তবেই তুমি জয়লাভ করিবে।’

আমি মনের নয়ন দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে যাচ্ছে পাঁচটি মনোনয়ন পত্র। না, পাঁচটি পদ্ম। আচ্ছা, মনোনয়ন পত্রের রঙ নীল হয় না কেন?

২৮৫১ পঠিত ... ২৩:৫১, নভেম্বর ১৩, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top