eআরকি বিশ্বকাপ রিভিউ: যেভাবে কাটলো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব

৪৭১ পঠিত ... ১৭:২৬, জুন ৩০, ২০১৮

রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের ২১তম আসরের গ্রুপ পর্ব শেষ হয়ে গেল। টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিল ১৬টি দল, যার মাঝে আছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এই গ্রুপ পর্ব শেষে বিশ্বকাপ এখন কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে? সব জানতে পড়ে নিন eআরকির ফুটবল গবেষক দল নিবেদিত eআরকি বিশ্বকাপ রিভিউ (গ্রুপ পর্ব)।

বিশ্বরাজনীতিতে ভ্লাদিমির পুতিনের দাপট সম্পর্কে কমবেশি সবারই ধারণা আছে। কিন্তু বাস্তবেই নিজ মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে রাশিয়া এমন কল্পনাতীত পারফর্মেন্স দেখাবে এমনটা হয়ত কেউ খুব একটা ভাবেনি। প্রথম ম্যাচেই চেরিশেভের জোড়া গোলে সৌদি আরবকে ৫ গোলে উড়িয়ে দিয়ে তেলের উপর রাশিয়ান ভদকার জোর দেখিয়ে দেয় রুশরা।

অন্যদিকে সালাহবিহীন মিশরের বিরুদ্ধে ১-০ গোলের জয় তুলে নেয় উরুগুয়ে। যদিও সালাহ থাকলে ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম হতো বলে ধারণা অনেক মিশরীয় এবং লিভারপুল সমর্থকের। বি গ্রুপে ইরান বনাম মরক্কো ম্যাচে মরক্কোর আজিজ বুহাদুজ অতিরিক্ত সময়ে আত্মঘাতী গোল দিয়ে নতুন এক ট্রেন্ড শুরু করে দেন। ফলে এবার গ্রুপ পর্বে আত্মঘাতী গোল সব মিলিয়ে হয়েছে ৯টি, যা যেকোন বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ।

ঈদের আগের রাতে গ্রুপপর্বের সবচাইতে হাইভোল্টেজ ম্যাচে পর্তুগালের মুখোমুখি হয় স্পেন। অবশ্য ম্যাচটাকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বনাম স্পেন বললেও চলে। ৩-৩ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচটিতে পর্তুগালের হয়ে তিনটি গোলই করেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। রোনালদো ছাড়াও এ ম্যাচে স্প্যানিশ গোলরক্ষক ডেভিড ডে হেয়ার পারফরমেন্স সবাইকে বেশ অবাক করিয়ে দেয়।

গ্রুপ সিতে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে বেশ ভুগিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এই ম্যাচে দুই দল দুটো পেনাল্টি নেয়। যার একটি ছিল VAR এর সহায়তায় পাওয়া। এই প্রথম বিশ্বকাপে VAR এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম আলোচিত এই বস্তু যেমন রেফারির চোখ ফাঁকি হয়ে যাওয়া ফাউলকে পেনাল্টি বানিয়েছে, আবার রেফারির দৃষ্টিতে হয়ে যাওয়া একাধিক পেনাল্টিও বাতিল হয়েছে। সব মিলিয়ে এই ‘ভাঁড়ে’র কল্যাণে গ্রুপ পর্বেই পেনাল্টির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪টি তে।

গ্রুপ ডিতে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে আসা আইসল্যান্ডের সাথে ড্র করে বাংলাদেশি আর্জেন্টিনা সমর্থকদের জীবন নাজেহাল করে দেয় মেসি অ্যান্ড কোং। যেখানে স্বয়ং মেসি একটি পেনাল্টি মিস করে তার ষোলকলা পূর্ণ করেন। পরবর্তীতে মেসির ক্লাব রাইভাল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ইরানের বিরুদ্ধে পেনাল্টি মিস করে খানিকটা সাম্যাবস্থা সৃষ্টি করেন বাংলাদেশি ফুটবলবোদ্ধাদের মধ্যে।

তবে গ্রুপ পর্বের প্রথম বড় ধরনের অঘটনের শিকার হয় বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি। প্রথম ম্যাচে জার্মানিকে ১-০ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে মেক্সিকো। গোলরক্ষক গিয়ের্মো ওচোয়া এবারও নিজেকে চীনের মহাপ্রাচীরের রূপে আবির্ভূত করেন। ফলে কপাল পোড়ে জার্মানির এবং দেশের লাখো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের ঈদটা যেন আরেকবার ফিরে আসে! পরের দিনই টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ব্রাজিল সুইজারল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে এই বিশ্বকাপকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'আন্ডারডগদের বিশ্বকাপ' তকমা দেয়।

গ্রুপ জি-তে যেন হয়ে গেল গোলের মেলা। বরাবরের মত মিডিয়ায় হাইপ সৃষ্টি করা দল ইংল্যান্ডের হয়ে হ্যারি কেন আর বেলজিয়ামের হয়ে রোমেল লুকাকু এন্ড গং যথাক্রমে পানামা আর তিউনিশিয়াকে নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করেছে। তিন ম্যাচে বেলজিয়াম দেয় ৯ গোল আর ইংল্যান্ড ৮ গোল।

নিজের দেশে খেলতে এসেছে দেখে অতিথিদের ছাড় দেবে, এমন মন মানসিকতা যে রাশিয়ানদের নেই তার প্রমাণ পাওয়া যায় মিশরের সাথে তাদের ৩-১ গোলের জয়ে! সালাহ স্কোয়াডে ফিরলেও সুবিধা করতে পারেনি ২৮ বছর পর বিশ্বকাপে আসা মিশর। ২০১০ এ স্পেনের বিশ্বকাপজয়ী দল পুরো টুর্নামেন্টে করেছিল ৮ গোল, রাশিয়া তা দিলো ২ ম্যাচেই! বেশ অনেকগুলো ছোট দলকেই বিশ্বকাপের এ পর্যায়ে বাস পার্কিং ফুটবল খেলতে দেখা যায়। সৌদি আরব, মরক্কো, ইরান বাস পার্কিং করেও ড্র আদায় করতে পারেনি। সুয়ারেজ, রোনালদো আর ডিয়েগো কস্তার গোলে তিনটি দলকেই হেরে যেতে হয়।

গ্রুপ ডি-তে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে অস্বস্তিকর অবস্থানে থাকা আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় ক্রোয়েশিয়ার। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হেরে অস্বস্তি দূর করার পরিবর্তে নিজেদের এবং ফ্যানদের অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বকাপের আশা প্রায় ছেড়ে দেয়া আর্জেন্টাইন সমর্থকদের ত্রাণকর্তা হয়ে আসে নাইজেরিয়া। আইসল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের এবং আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপের আশা জিইয়ে রাখে তারা।

বড় দলগুলির এই দুরবস্থা দেখেই কিনা কোস্টারিকার সাথে ম্যাচের আগেও ব্রাজিলের সমর্থকদের ঘুম হারাম হবার জোগাড় হয়। ৯০ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য থাকার পর ৯১ আর ৯৭তম মিনিটে কৌটিনহো আর নেইমারের গোলে বুক চিতিয়ে তর্ক করার সুযোগ পায় তারা। দুই ম্যাচেই অসংখ্য 'ডাইভ' দিয়ে সমালোচনার শিকার নেইমার এই ম্যাচে গোল দিয়ে 'হেটার’দের মুখ বন্ধ করে দেন।

অন্যদিকে শেষ মিনিটে টনি ক্রুসের দুর্দান্ত ফ্রি-কিক গোলে সুইডেনের বিপক্ষে ২-১ গোলের নাটকীয় জয় পায় ম্যাচের শেষ দিকে ১০ জন নিয়ে খেলা জার্মানি। গ্যারি লিনেকারের অমর বাণীকে আবার ঠিক প্রমাণ করার পাশাপাশি নিজেদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও অক্ষত রাখে 'ডি মানশাফট'।

এবারের বিশ্বকাপের সব উত্তেজনা নিয়ে হাজির হয় গ্রুপ পর্বের শেষ রাউন্ডের ১৬টি ম্যাচ। শুধুমাত্র চারটি দল সেকেন্ড রাউন্ড নিশ্চিত করতে পেরেছিল তাদের প্রথম দুই ম্যাচ থেকে। বাকি সবার জন্য বিশ্বকাপ তখনো উন্মুক্ত।

গ্রুপ এ-তে উড়তে থাকা রুশদের মাটিতে নামিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। আর সৌদি আরব বিশ্বকাপের একমাত্র জয় ছিনিয়ে এনে মিশরকে জয়শূন্য রাখে। গ্রুপ বি-তে স্পেন আর পর্তুগালের আপাত সুখের বিশ্বকাপে আরেকটু হলে ভাগ বসিয়ে দিত ইরান। শেষ মুহূর্তে মরক্কো-স্পেন এবং পর্তুগাল-ইরানের ম্যাচ দুটিই ড্র হওয়ায় সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে যায় এই দুই ফেভারিট।  

গ্রুপ স্টেজের একমাত্র গোলশূন্যু ড্র হয় ফ্রান্স বনাম ডেনমার্কের ম্যাচটি। কিন্তু সব নাটক যেন জমা করে রাখা ছিলো গ্রুপ ডি, এফ আর এইচে। তখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপে জয়ের মুখ না দেখা আর্জেন্টিনার জন্য সমীকরণটা ছিলো এমন, নাইজেরিয়ার বিপক্ষে জয় এবং ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আইসল্যান্ডের হার। বাঁচামরার ম্যাচে শুরুতেই এ বিশ্বকাপে নিজের প্রথম গোলটি করেন লিওনেল মেসি। কিন্তু পরবর্তীতে পেনাল্টি থেকে গোল করে সমতায় ফেরে নাইজেরিয়া। আর আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে শুরুতে গোল দিলেও, গোল হজম করে বসে ক্রোয়েশিয়া। ফলাফল এমন থাকলে গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যেত আর্জেন্টিনা। এ অবস্থায় আর্জেন্টিনার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন মার্কোস রোহো। শেষমেশ ক্রোয়েশিয়াও জয় পেলে ফেভারিট দুই দলই পরের রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয়।  

গ্রুপ এফ-এ দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে জার্মানির ছিলো বিশ্বকাপ এবং নিজেদের মান বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ। টিকে থাকতে হলে তাদের জিততেই হত। আগের দুই বিশ্বকাপেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দল গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছিলো, এ ভয়ও ছিলো জার্মানদের মনে। কিন্তু অন্য ম্যাচে সুইডেন মেক্সিকোর বিরুদ্ধে একের পর এক গোল করে জার্মানির জন্য কাজটা এক রকম সহজই করে ফেলছিল। অথচ জার্মানি একটি গোলও দিতে ব্যর্থ হয়, বরং কোরিয়া ইনজুরি সময়ে দু দুটো গোল করে বসে। শেষ গোলটি হয় যখন ম্যানুয়েল ন্যয়ারের মধ্যমাঠে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ফাঁকা গোলপোস্টে।

ফলাফল, ৮০ বছর পর আবারও বিশ্বকাপ ১৯৩৮ সালের পর এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত গ্রুপ পর্বে বাদ পরে জার্মানি এবং তার সাথে বহাল থাকে ‘চ্যাম্পিয়নস কার্স’! এবং সুইডেনের কাছে ৩-০ গোলে হেরেও পরের রাউন্ডে সুইডেনের সঙ্গী হয় মেক্সিকো। গ্রুপ ই তে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের শেষ ম্যাচে পলিনহো এবং থিয়াগো সিলভার গোলে ২-০ গোলে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নক আউট রাউন্ডে উঠে যায় ব্রাজিল। আগের ম্যাচগুলোর মত এ ম্যাচেও নেইমার মাঠকে খাট মনে করে অধিকাংশ সময়ই গড়াগড়ি করে কাটান। নক আউট পর্বে এই গ্রুপ থেকে ব্রাজিলের সঙ্গী হয় সুইজারল্যান্ড।

গ্রুপ এইচে জাপান সেনেগাল কলম্বিয়া, তিন দলেরই সম্ভাবনা ছিলো পরের রাউন্ডে যাবার। জাপান পোল্যান্ডের কাছে এবং সেনেগাল কলম্বিয়ার কাছে হেরে যাওয়ায় জাপান ও সেনেগালের পয়েন্ট এবং গোল ডিফারেন্স সমান হয়ে যায়। কিন্তু কম হলুদ কার্ড হজম করার কারণে জাপান এই প্রথম কোন দল হিসেবে 'ফেয়ার প্লে' রুলে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে যায়। পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে জাপানিদের দেখা যায় শেষ কয়েক মিনিট কোন রকম কোন ঝুঁকিতে না যেয়ে নিজেদের মধ্যেই বন্ধুত্বপূর্ণ ফুটবল খেলে সময় শেষ করতে। এই ভদ্রতা ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে থাকবে বলেই ধারণা করছেন সবাই।

গ্রুপ জি তে এই নিয়মের কারণেই ইংল্যান্ড বনাম বেলজিয়ামের ম্যাচটিতে দুটি দলই দ্বিতীয় সারির টিম নামায়। কারণ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলেই পরবর্তী রাউন্ডগুলোতে কঠিন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত 'ধৈর্যের পরীক্ষায়' জিতে যায় ইংল্যান্ড, আর ১-০ গোলে ম্যাচ জিতে বেলজিয়াম। অন্য ম্যাচে তিউনিশিয়া নিজেরাই ৩টি গোল দিয়ে পানামাকে ২-১ গোলে হারায়।

৪৭১ পঠিত ... ১৭:২৬, জুন ৩০, ২০১৮

Top