চরিত্রকে নতুনভাবে জীবন দিতে পারাই একজন অভিনেতাকে বাচিয়ে রাখে : ইরফান খান

৭৮৯ পঠিত ... ২২:৫৫, মে ০২, ২০২০

দুবছর ক্যান্সারের সাথে লড়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০২০ সালের ২৯ এপ্রিল ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুর কাছে আত্নসমর্পণ করেন ইরফান খান। সে বছরই তাকে 'আংরেজি মিডিয়াম' ছবিতে শেষবারের মতন রঙিন পর্দায় দেখা গেছে। জীবনের পর্দা টেনে ফেলে দিয়ে তিনি এখন অমর হয়ে থাকবেন সেই রূপালী পর্দার মাঝেই। জীবনে সকল ক্ষেত্রে নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সিনেমা, পরিচালক, গল্প কিংবা চরিত্র পছন্দ না হলে তা ফিরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি।

তার মৃত্যুর আগে ফিল্মফেয়ার-এর নেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে অভিনয় ও জীবনবোধ নিয়ে নানা মতামত। তার চলে যাওয়ার মাত্র একদিন পরে বিদায় নেয়া বর্ষীয়ান অভিনেতা ঋষি কাপুর প্রসঙ্গেও কথা উঠেছিল এই সাক্ষাৎকারে...

আপনার যেখানে পৌছানোর উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার নাগাল পেতে দেরি হয়েছে কি?

আমি দেরি বলবো না। বরং পুরোটাই একটা গতি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এমনকি প্রক্রিয়াটাও কোনো নির্দিষ্ট 'প্রক্রিয়া'কে অনুসরণ করে চলেনি। যেন জীবনের মোড়ে মোড়ে সবটার আকস্মিক আবির্ভাব ঘটে গেছে। মনে হয় যেন, জীবন আমাকে এর জন্যই প্রস্তুত করে চলছিল। এটাই তো জীবনের রহস্য, 'ম্যাজিক অফ লাইফ'। সবকিছুই বিস্ময়কর। 

 

আপনার কাজের আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং 'পান সিং তোমার' এর জন্য পাওয়া ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জীবনে নতুনভাবে কিছু সংযোজন করেছে কী?

প্রথমত, আমার মনেহয় আমি এমন একটা জায়গায় নিজেকে আনতে পেরেছি যেখান থেকে নিজস্ব চাওয়াকে গুরুত্ব দিতে পারি। আমার পছন্দ মতন পরিচালক ও প্রজেক্টে কাজ করতে পারি। এ জায়গায় আসতে আমার অনেক সময় লেগেছে। যদিও আমার মনেহয় আমি এখনও পুরোপুরি সেখানে যেতে পারিনি। কিন্তু পছন্দমতো বেছে নেওয়ার যোগ্যতা আমার হয়েছে। 

 

আপনার যাত্রাপথ কিংবা ক্যারিয়ার যদি ভিন্ন কোনো পথে এগোতো, তবে কী খুশি হতেন? 

জীবন ভিন্ন পথে যেতেই পারতো। আমার চিন্তা করার জায়গা থাকতো যদি আমি নিজের কাজের সাথে সংযুক্ত হতে না পারতাম৷ কিন্তু আমার কাছে এগুলো নিরর্থক মনে হয়। এত ভাবনা-চিন্তা, জল্পনা-কল্পনার কখনোই শেষ হয়না। সকল কিছুর আবির্ভাব আকস্মিকভাবেই হয়। জীবন তো প্রতিনিয়ত নতুন কিছু উন্মোচন করেই চলছে আর বিস্ময় ছড়াচ্ছে। 

 

আপনি ডি-ডে'তে র'(RAW) এজেন্টের ভূমিকায় ছিলেন। কিভাবে এমন একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, মনোভাব কিংবা বৈশিষ্ট্য আয়ত্ত করেছিলেন? 

সবসময় অতটা গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়না। আমাদের বাণিজ্যিক ছবিগুলো যেভাবে তৈরি করা হয়, তাতে চরিত্রের মধ্যে অতটা প্রবেশের দরকার পড়েনা। আমি মাপছিলাম আমার চরিত্রের কতটা গভীরে যেতে হবে। সেই অনুযায়ী আমি তাতে ডুব দিব। এছাড়া শারিরীকভাবেও চরিত্রকে নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে। যদিও এসব আগে থেকে ঠিক করা থাকে। আবার, আমি যেভাবে চরিত্রের মাঝে ডুবে যেতে প্রস্তুত সেভাবে হয়তোবা পরিচালক চাননা। তখন নিজের লাগাম টেনে ধরতে হয়। তাই আমার জন্য কিছু তথ্যই যথেষ্ট। এরপর কাহিনীর সাথে সাথে গতিময়তা চলে আসে। যদিও নিজ থেকে চরিত্রে কোনো ক্ষুদ্র পরিবর্তনও আনলে নিখিল (আদভানি) বেশ খুশি হত। তাই আমার নিজের উপরও বিশ্বাস ছিল। 

 

এই লাগাম টেনে ধরার জন্যেই কী মূলধারার চলচ্চিত্রভীতি রয়েছে আপনার?

না তা নয়। কিন্তু মাঝেমাঝে নিজের সাথে মেলানো কঠিন হয়ে যায়। সেই ভীতিটা আছে আমার। যদি আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণের ধরণ এবং পরিচালকের চাহিদার সাথে নিজেকে মেলাতে না পারেন কিংবা চরিত্রের জন্য মন থেকে কিছু অনুভব না করেন, তবে তা সত্যিই ভীতিকর। সে সময় মনে হবে কেউ আপনার থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আপনি শুধু দিয়েই যাচ্ছেন, কিন্তু কিছু গ্রহণ করতে পারছেন না। যখন আপনি চরিত্রের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারবেন এবং অভিনয়ের সময় বাহিরে যা প্রকাশ করবেন তা নিজের ভেতর থেকে আসবে, তখন এই আদান-প্রদানটা আপনাকে, আপনার চরিত্রকে নতুনভাবে জীবন দিবে৷ মুহূর্তের মধ্যে যে আপনার এই পরিবর্তন, এটাই আপনার পুরষ্কার। এটিই একজন অভিনেতাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি অবাক হই ভেবে যে এই অনুভূতি কী একজন লেখক, চিত্রশিল্পী কিংবা খেলোয়াড়ের হয় কিনা। তাই ধরাবাঁধা নিয়মের কাজগুলোতে নিজেকে বিস্মিত করার সুযোগ থাকেনা, নিজেকে আবিষ্কার করা যায়না। আপনি যখন জানেন যে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তখন তো আপনার উত্তেজনাটা কমে যাবে। 

 

করন জোহর কিংবা যশ রাজের ফিল্মে চরিত্র পেলে? তখন চরিত্রের সাথে যুক্ত হতে পারবেন? 

চরিত্র যদি আমার সাথে না যায় তবে তারা আমায় কাস্ট করবে না। যদি চরিত্র ভালো হয় তবে যুক্ত না হওয়ার কারণ দেখি না। 

 

ডি-ডে তে আপনি ঋষি কাপুরের সাথে কাজ করেছেন। সেই অনুভূতি কেমন?

সে আমার ভাই। তার অনেক বড় ভক্ত। যদিও আমি তার সব সিনেমা দেখেছি, কিন্তু আমার মনে হয় না আমি কখনও ঋষি কাপুরের মতন হতে পারবো। তিনি এত সুনিপুণভাবে নিজেকে প্রতিনিয়ত দক্ষ করে তুলেছেন যে তার অভিনয়ের প্রতি আপনার চাহিদা শুধু বেড়েই চলবে। তাতে একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হলেও৷ এটাই তার জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসকে এত ভালো করে তুলেছে বলে মনে হয়। তার স্টার হওয়ার প্রয়োজন নেই, তিনি সাধারণ অভিনেতা হিসেবেই নিজের দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। 

 

কোনো প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হওয়ার আগে কী দেখে হ্যাঁ বলেন?

সাধারণত পরিচালক আর নিজের চরিত্রকে বেশি গুরুত্ব দেই। একজন অভিনেতা হিসেবে চরিত্রটি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। আর অবশ্যই অর্থমূল্য। এছাড়াও পরিবেশ এবং মানুষজনের ধরন দেখা হয়। চলচ্চিত্র নির্মাণকালে একটা বড় সময় কাটাতে হয় ফিল্মের সাথে থাকা একগুচ্ছ মানুষের সাথে। তাদের সাথে সেই সময়টা উপভোগ করাও গুরুত্বপূর্ণ। 

 

কী দেখে না বলেন? 

পুনরাবৃত্তিমূলক, ধর্মপ্রচারমূলক, মানসম্মত কাহিনী ছাড়া ইস্যু-বেসড ফিল্মগুলোকে এবং সেই পরিচালককে যার গল্প বলার ক্ষমতার উপর বিশ্বাস করতে পারি না। 

 

নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করা কোনো কাজ কী সাফল্য এনে দিয়েছে? 

সত্যি বলতে আমি 'দ্য নামসেক (The Namesake)' নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না। 'দ্য ওয়ারিয়র' এর পর আমি অ্যাকশনধর্মী ছবি করতে চেয়েছিলাম।  কিন্তু এটি ছিল একেবারে বিপরীত। আমি যা করতে চাই তা এই চরিত্র আমাকে দিতে পারবে কিনা নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু আমার মিরার (নইর) প্রতি বিশ্বাস ছিল এবং ঝুম্পা লাহিড়ীর কাজের সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। পরবর্তিতে সিনেমাটি দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম। এছাড়াও 'হাসিল' এবং 'দ্য লাঞ্চবক্স'-এ কিভাবে নিজেকে নেতিবাচক ভূমিকায় তুলে ধরবো বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু শেষমেশ ভালোই হয়েছিল। 

 

বাইরের দেশে ভারতীয় চলচ্চিত্রের উপস্থাপন নিয়ে আপনার কী মনোভাব? 

বিদেশে মানুষ ইন্ডিয়ান আনুষ্ঠানিকতা ও উৎযাপনের সাথে নিজেদের মেলাতে পারে। কিন্তু গল্পের দিক দিয়ে, কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। কেউ সত্যিকার, স্বাভাবিক চরিত্র দেখতে চায়না। ছবির মাঝখানে হুট করে নাচ-গান শুরু করে দেওয়ার বিষয়টা যারা মানতে পারবে তারাই এসব ছবির দর্শক হতে পারবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাওয়ার মত বলিউডের সিনেমা খুবই কম। 

 

স্লামডগ মিলিওনিয়ার, দ্য নামস্যেক, লাইফ অফ পাই - ভারত থেকে তো ভালো গল্পও বের হচ্ছে…

কাকতালীয়ভাবে কিছু ভালো সিনেমা বের হয়েছে এবং এর অংশ হতে পেরে আমি সত্যিই ভাগ্যবান। যখন হুট করে স্লামডগ মিলিওনের মুক্তি পেল তখন সবাই বলতে লাগলো যে এ তো ইন্ডিয়ান ফিল্ম নয়৷ এরপর অনুরাগের সিনেমা (The Girl In Yellow Boots) নিয়ে বলা হল এটি অপ্রত্যাশিত সাফল্য পেয়ে গেছে। স্লামডগ বা লাইফ অফ পাই ইন্ডিয়ান ফিল্ম না হলেও এগুলোর সাথে ইন্ডিয়ান প্রতিভা, পরিবেশ এবং ইন্ডিয়ানরা যুক্ত আছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম এসব সিনেমা দেখবে আর ভাববে যে, 'এটা আমাদের সিনেমা' এবং তারা তাদের সিনেমা বানানোর স্বপ্ন এগুলোর উপর ভিত্তি করেই গড়ে তুলবে। ভালো ব্যাপার হচ্ছে যে দেশের বাইরে ভারতীয় চলচ্চিত্র এখন গুরুত্বের সাথে নেওয়া হচ্ছে। 

 

আর ভারতীয় অভিনেতাদের কী গুরুত্বের সাথে নেওয়া হচ্ছে? 

হ্যাঁ। এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একসময় পুরোপুরি ঠিক হবে। আর আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট গুলোর জন্য নিজের দেশের গতবাঁধা কাহিনী ছেড়ে কল্পনা করতে হবে। 

 

কান ফেস্টিভ্যালে 'দ্য লাঞ্চবক্স' স্টান্ডিং ওভেশন পেয়েছিল। সে বিষয়ে বলুন? 

এটি ইন্দো-ফেঞ্চ-জার্মানির সহযোগিতায় তৈরি একটি ছোট্ট, সুন্দর ইন্ডিয়ান ফিল্ম। ২০১৩ সালে কান-এ দেখানো হয়েছিল। এই ছবিটি এত তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল যে এটি কোনো রেকর্ড গড়ে ফেলেছিল বলে আমার মনে হয়। ছবিটি শেষ হওয়া পর্যন্তও তারা অপেক্ষা করেনি। শেষমেশ ছবিটি সনি পিকচার্স কিনে নিয়েছিল।  

 

আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় সিনেমার মধ্যে মানগত দিক দিয়ে যে ফারাক রয়েছে তার মধ্যে সেতুবন্ধন করার উপায় কী? 

আমার মনেহয় একত্রে কাজ করাটাই সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। অন্যান্য দেশের প্রতিভাবান পরিচালক, অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। এমন ধরণের কাহিনী নিয়ে কাজ করতে হবে যেখানে অন্যান্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ রয়েছে। এদিক দিয়ে এখনও তেমন কাজ করা হয়নি। মূলধারার বাইরে যেয়ে সার্বজনীন কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করাটা জরুরি। আমার মনেহয় 'দ্য লাঞ্চবক্স' এই উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ইন্দো-ফ্রেঞ্চ-জার্মান প্রোডাকশন, কিন্তু সব ছাড়িয়ে এই কাহিনী যেকোনো জায়গার জন্যই যথার্থ। 

 

কখনও কাজের খোঁজ করতে হয়েছে?

আমি অনেক সময় কাজের জন্য অপেক্ষা করেছি। আমি ভাবতাম আমার সাথে কোনোদিন X ডিরেক্টরের দেখা হবে, আমি তাকে Y কাজ দেখাবো, এরপর বুম! কিন্তু যখন সত্যিই এমন করার চেষ্টা করলাম তখন এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া ঘটলো। কারো সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই তো তাকে অভিনয় করে দেখানো যায়না, তাইনা? এছাড়াও আমি বেশ লাজুক। তাই এগুলো একেবারেই আমার স্বভাববিরুদ্ধ। আমি ভাগ্যবান যে আমার কখনো কাজ ছাড়া থাকতে হয়নি কিন্তু আমি অনেক অপেক্ষা করেছি। নাটকে থাকার সময় সিনেমার জন্য অপেক্ষা করেছি, সিনেমায় সুযোগ পেয়ে ভালো চরিত্রের অপেক্ষা করেছি, ভালো চরিত্র পেলে ভালো সিনেমার অপেক্ষা করেছি...। এই অপেক্ষার কোনো শেষ নেই৷ 

 

আপনার কাছে সাফল্যের অর্থ কী? 

আমার কাছে সাফল্যের মানে হলো নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে পারা। করতে হবে তাই না করে নিজের ইচ্ছায় করতে পারা। আমি এখনও শিখছি আর প্রতিটি নতুন প্রজেক্ট-ই আমাকে নতুন কিছু শেখাচ্ছে। এভাবেই নিজের দক্ষতাকে শাঁনিয়ে নিতে চাই।

৭৮৯ পঠিত ... ২২:৫৫, মে ০২, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top