খুলনার অদূরে সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে ছোটো একটা গ্রামে অনেক বছর ধরেই কাঠ কাটেন মোশাররফ কাঠুরিয়া। ছোটো একটা ভিটে আছে তার। দাম মাত্র কয়েক কোটি টাকা। খুব একটা সম্পত্তির মালিকও ছিলেন না। দুঃখ-কষ্টে সেভিংস করে গড়েছেন মাত্র ১১২ কোটি টাকা। নিজের সন্তান স্ত্রী নিয়ে বেশ সুখ দুঃখ নিয়েই চলে যাচ্ছিল তার জীবন।
একসময় বেশ গরিবই ছিলেন তিনি। তবে আত্মীয় প্রতিবেশিরা তাকে খুব পরিশ্রমী হিসেবেই চেনে। খুব একটা কাজে ফাঁকি দেন না, সকাল হলেই কাঠ কাটতে বের হন নিজের হাতে বানানো কুঠার নিয়ে। দিনভর পরিশ্রম করে কষ্টে-শিষ্টে কয়েকটা গাছ কেটে যা আয় করেন তা দিয়েই নিজের সংসার চালান। ছেলেমেয়েদের পড়শোনা করান।
একদিন কাঠ কাটতে গিয়েছেন নদীর ধারে। বেশ খরস্রোতা নদী।
কাঠ কাটছেন আর ভাবছেন অনেক কষ্ট করে জীবন পার করে দিয়েছেন, সন্তানকে খুব একটা ভালো জীবন উপহার দিতে পারেননি। আজীবন নিজে কাঠ কেটে সংসার চালিয়েছেন তো কী হয়েছে, নিজের সন্তানকে যেন তার মতো কষ্ট করতে না হয় এজন্য আজ থেকে দুইটা গাছ বেশি কাটবেন।
একদিন পাড়ার দোকানে চা খেতে খেতে হার্ভার্ড না কোন জায়গার নাম শুনেছেন। সেখানে নাকি অনেক বড় বড় গাছের বন। তিনি স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন, ছেলেকে সেই হার্ভার্ডের বনে পাঠাবেন। সেই বন থেকে ফিরে এসে ছেলে একদিন দেশের সেবা করবে।
নিজের ছেলের এমন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে করতেই উত্তেজনায় বেশ জোরেই একটা কোপ দিয়ে বসেন। বেমক্কা কোপ দিতে গিয়ে কুঠারটা নদীতে পড়ে যায়।
স্বপ্নের সিঁড়ি থেকে যেন তিনি পড়ে গেলেন অকূল পাথারে। কুঠার না থাকলে কীভাবে কাজ করবেন? কাল সকালে কী খাবেন? ঋণের ১২০০ টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন? সন্তানকেই কীভাবে বিদেশে পাঠাবেন? এসব ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এমন দুরবস্থা দেখে নদীর জলপরীর খুব মায়া হয় তার ওপর। নদী থেকে উঠে তার কান্নাকাটির কারণ জিজ্ঞেস করে জলপরী।
নিজের অসহায় জীবন, অসহায় জীবনের একমাত্র সম্বল কুঠারখানা হারিয়ে ঠিক কী পরিমাণ কষ্টে আছেন তা বোঝাতে থাকেন। কুটকুট করে কেঁদে কেঁদে নিজের গল্প শোনানোর পর জলপরীর মনে হয় এই কাঠুরের জীবনে তো অনেক দুঃখ। একে অনেক ভালো একটা বকশিশ দিয়ে জীবনকে সহজ করে তুললে ভালো হবে হয়তো। কিন্তু তার আগে একটু পরীক্ষা করে নিতে হবে। জলপরীরা সৎ মানুষ ছাড়া কাউকে কখনোই কিছু দেয় না। জলপরীর উপহার পাওয়ার জন্য একমাত্র যে শর্ত সেটা হলো সততা।
জলপরী বলল, দাঁড়াও তোমার কুঠার আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। এই বলেই ঝাপ দিল নদীতে। একটা সোনার কুঠার নিয়ে মোশাররফকে দেখাল। কুঠারটা তার কিনা জিজ্ঞেস করলে মোশাররফ না করলেন। তার তো লোহার কুঠার। এমন হলুদ কালারের লোহা তিনি জীবনেও দেখেন নাই।
জলপরী বলল, উপস, মনে হয় কোনো ভুল হয়েছে। আমি আবার যাচ্ছি।
এবার সে বের করল একটা রূপার কুঠার। রুপার কুঠার দেখেও আগেরবারের মতো ফিরিয়ে দিল কাঠুরিয়া মোশাররফ। জলপরী মনে মনে খুশি হলো।
এইবার সে কাঠুরির আসল কুঠারটা বের করল। কাঠুরিয়ার খুশিতে ‘কেন্দে দেওয়ার’ মতো অবস্থা প্রায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না লুকিয়ে কুঠার নিয়ে জলপরীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বাসায় রওনা দেন।
তিনি তখনও জানতেন না জলপরী তার নিজের কুঠারের মতো দেখতে একটা কুঠার দিলেও আদতে এটা একটা জাদুর কুঠার। যে কোনো প্রমাণ সাইজের গাছ কাটতে দুই চারটা কোপের বেশি প্রয়োজন হয়ই না।
নতুন কুঠার পাবার খুব বেশি দিন পরের কথা না, তার ছোটো কাঠের বাড়ির জায়গায় স্থান করে নিয়েছে বিশাল অট্টালিকা। ছেলেমেয়েদেরকে দেশের বাইরে পড়ালেখা করার জন্য পাঠিয়েছেন। একসময় টুকটাক সেভিংসও শুরু করেন। এভাবে আজ মোশাররফ হোসেন ১১২ কোটি টাকার মালিক।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন