এখানে বসন্ত আজ আনন্দ করো (ছাপ তিলক: ৫ম পর্ব)

৭১ পঠিত ... ১৯:৪৮, এপ্রিল ০৯, ২০২৪

5 (7)

বাংলার লখনৌতি থেকে দিল্লিতে ফেরার পর থেকে খসরুর বিষণ্ণকাল কাটতে থাকে। মন বসে না কবিসভায়। ঘুরে ঘুরে বাংলার পদ্মাবতী নদীর কথা মনে পড়ে; ফুলওয়ারীর  প্রত্ন প্রাসাদের পেছনে পুষ্পবাগান শোভিত দিল বাহারের সেই সাদা রাজহংসীর মতো দোতলা বাড়ির বৈঠকখানার হানা স্মৃতি এলোমেলো করে দিতে থাকে।

পাতিয়ালির কাসগঞ্জে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আম্মা কথায় কথায় সংসারী হবার প্রসঙ্গটা তোলে। বোনের মেয়ে যাহরা নাজের সঙ্গে সম্মন্ধটা পাকাপাকি করার প্রস্তাব দেয়। মহল্লায় ঘুরতে গেলে এক দূর সম্পর্কের ফুপা ঘুরে ফিরে বলে, মিয়া সংসারের বিষ পান না করলে নীলকণ্ঠ হওয়া যায় না। বিবাহ এমন এক দংশন যা সর্প দংশন থেকে আত্মরক্ষার ক্ষমতা তৈরি করে।

খসরু হাসতে হাসতে বলে, সংসারে এত যদিই অমৃত থাকতো; তবে এত রাতে ছাদের চারপায়াতে শুয়ে কেন ফুপা!

খিলখিল করে হেসে তারপর কেশে ওঠে; কাশির দমক থামলে তার বাঁচতে ভালো লাগে। ফুপা বলে, দিল্লির অপরিচিত পরিবারে পাত্রী না খুঁজে আত্মীয়ের মাঝেই পছন্দ করো কাউকে; অচেনা শত্রুর চেয়ে বরং চেনা শত্রু ভালো।

পরদিন দুপুরে খালাতো বোন যাহরা নাজ এক বাটি ফিরনি বানিয়ে এনে পাকা রাঁধুনির পরীক্ষা দেয়। রাজপুতের মেয়ে; সোন্নত গ্রীবার প্রাণোচ্ছল এক তরুণী। খসরু ভণিতা না করে সরাসরি বলে, যাহরা তোমার জন্য কোন রাজকুমার ঘোড়া ছুটিয়ে তেপান্তর থেকে আসবে। আমি তো এক চালচুলোহীন কবি।

: খালুজান যে সম্পদ রেখে গেছে তা কি যথেষ্ট নয়! কী দরকার হিল্লি দিল্লি  করে বেড়ানোর! তার চেয়ে স্পষ্ট করে বলুন কোথায় কার সঙ্গে মনের সুঁতো বেধেছেন হে শায়ের! কবিরা শুনেছি প্রেম ছাড়া থাকতে পারে না!

খসরু হো হো করে হেসে ওঠে, প্রেম ছাড়া কবিতা হয় না এটা ঠিক; সে প্রেম শুধু নারীর সঙ্গে হয় না; খোদার সঙ্গেও হয়।

: কেউ যখন সুফি গল্প তোলে; সে হয়তো এই মুহূর্তের কোন ঝামেলা থেকে পালাতে চায়। যাহরা তো যাহের নয়; আপনি আপনার শায়েরির সঙ্গে সংসারে সুখি হন; দোয়া রইলো।

যাহরা চলে গেলে একটা মুক্তির আনন্দ যেন মনের মধ্যে হুঁই দিয়ে যায়; তবে একটু মন খারাপও হয়। যাহরা নাজের মতো এমন তীক্ষ্ণ তরুণী যে লাখে একটা হয়।

পাতিয়ালি থেকে ফেরার পর খসরু জানতে পারে সুলতান বলবনের বড় ছেলে খান মুহাম্মদ মুলতান থেকে এসেছে। তাকে আঁতিপাতি করে খুঁজছে। সুলতানের দপ্তরে দেখা হতেই সে করমর্দন করে বলে, চলুন আমার সঙ্গে মুলতান চলুন। সিন্ধু, মুলতান, লাহোর জুড়ে সুফি কবিতার জগত। বাগদাদ, পারস্য, আরব থেকে যারাই আসে; মুলতানে তাদের কবিতা আর সংগীতের আড্ডা বসে। সুফি দার্শনিক সুহরোয়ার্দির ফারসি কাব্যগ্রন্থ খাযিনাত আল আসফিয়া এনেছি আপনার জন্য। পড়ে দেখুন কী স্বাদু। এমন আরো অনেক কবি আছেন সেখানে। ভালো কাটবে সময় আপনার। এমনকী লাহোরে রমণীয় নাচের জলসা হয়। সেখানে তুর্কী নৃত্যশিল্পী গুড়িয়ার বেশ নাম ডাক আছে। চলুন কবি সংগীত নৃত্য বাদ্যে লাহোরকে লাল রং-এ রাঙ্গাই।

: লাল রং-এ রাঙ্গাই; বাহ সুন্দর করে বললেন তো!

: মাঝে মাঝে মোঙ্গলরা তাদের মৃত্যু শোভাযাত্রা নিয়ে হানা দেয় সালতানাত দখল করতে; মুলতান হয়ে তারা দিল্লিতে ঢুকতে চায়; মোঙ্গলদের প্রতিরোধ করতে করতে রক্তের হোলিখেলা দেখে ভুলেই গেছি যে লাল রঙ আনন্দের প্রতীক। তাই তো আমার খসরুর সুন্দর আর মঙ্গলের সান্নিধ্য প্রয়োজন। কবিতা-সংগীত-নৃত্যের আনন্দশোভাযাত্রায় অংশ নিতে চাই।

খসরুর ঠিক দিল্লিতে মন বসছিলো না। তাই খান মুহাম্মদের প্রস্তাব লুফে নেয়। মুলতান বেশি দূরে তো নয়!

মুলতান শহরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় এটা কবিদের শহর। বাজার এলাকাতেও হাওয়ায় ভেসে আসে কবিতার লাইন। কখনো কখনো গানের সুর ভেসে আসে। আর চোখে পড়ে মুসাফিরের মেলা। লখনৌতির মতোই একটা শান্তিময় চারপাশ। মানুষের মুখে হাসে। যে শহর হাসিমুখে অতিথিকে স্বাগত জানায়; সেটাই তো আনন্দনগরী।

খসরুর থাকার চমৎকার বন্দোবস্ত সেখানে। লাল ইটের দোতলা ঘর। ঝুলবারান্দায় দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সংগীত বিদ্যালয়। সেখানে আরব-পারস্য-তুর্কী বাদ্যযন্ত্র সারি সারি। খসরু অনেক ভেবে দেখেছে; সে যে ঘরানার উচ্চাঙ্গ সংগীত সৃষ্টি করতে চায় কিংবা খেয়াল সাজাতে চেষ্টা করে; এরজন্য নতুন ধরনের বাদ্যযন্ত্র প্রয়োজন।

পরদিন সকালে সংগীত বিদ্যালয়ে খসরুকে স্বাগত জানায় সবাই। সুলতান খান মুহাম্মদের অতিথি হিসেবে একটা আলাদা গুরুত্ব তো তার রয়েছেই। সময় নষ্ট না করে তান আর সপ্তকের সম্মিলনে কাওয়ালির ওপর কাজ  শুরু করে। প্রচলিত নির্গিত সংগীতের অর্থহীন শব্দের পরিবর্তে অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করে তারানা ঘরানা তৈরি করে দ্রুতই। পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র বীণাতে কিছু পরিবর্তন করে সেতার উদ্ভাবন চলতে থাকে।

মুলতানে সুহরোয়ার্দিয়া, কাদিরিয়া আর চিশতিয়া; প্রধানত এই তিনটি সুফি ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে খসরু। পারস্য, আরব, বাগদাদ ও তুর্কী সুফি ভাবনা মুলতানে অভিবাসী কবিরা বহন করে এনেছিলো। খসরুর মনে হয়; কবিদের জগত যুদ্ধের নিষ্ঠুরতার বিপরীতে অহিংস এক পৃথিবী। তবে এমনো হয়েছে মোঙ্গলদের হামলা থেকে মুলতান শহরকে বাঁচাতে সুফি কবি বখতিয়ার কাকি তার সংগীত ও কবিতার ইন্দ্রজালের কুটনীতি ব্যবহার করেছিলো। এই নগরীতে হিংসা নয় অহিংসা দিয়ে শত্রুর হৃদয় জয় করার মনোভঙ্গির উপকথা খসরুকে উদ্দীপ্ত করে।

খান মুহাম্মদ এক সাঁঝে খসরুকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় লাহোরে তুর্কী নর্তকী গুড়িয়ার নৃত্যের আসরে। প্রথম নজরে গুড়িয়াকে বড্ড অহংকারি বলে মনে হয়। সালতানাতের বড় কর্তাদের সে খুব একটা গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয়না। সওদাগরদের দেয়া উপহার হিরের নাকছাবির দিকেও নজর নেই তার। সুলতান খান মুহাম্মদ খসরুকে আসমুদ্র হিমাচলের কিংবদন্তীর কবি বলে পরিচয় করিয়ে দিলে; তখন হাসির রেখা ফুটে ওঠে গুড়িয়ার স্ফীত ওষ্ঠে।

গুড়িয়া বলে, কবি মহোদয়ের গজলের সঙ্গে নাচতে চাই। উনি কি এটুকু অনুগ্রহ করবেন!

13406814_1228420607181775_7658030994940792781_n

সুলতান খান মুহাম্মদ খসরুর দিকে তাকিয়ে মিনতি করে। খসরু সঙ্গে করে আনা সেতারখানা জড়িয়ে ধরে তাতে সুর তোলে,

আজ বসন্ত মানালে সুহাগান

আজ বসন্ত মানালে

অঞ্জন মঞ্জন কর পিয়া মরি

লম্বা নহর লাগাইয়ে

তু কিয়া সভয় নিন্দ কি মাসি

সো জাগে তেরে ভাগ সুহাগান

আজ বসন্ত মানালে

ওঁচি নার কে ওঁচায় চিতভান

আয়সো দিয়া হ্যায় বানায়ে

শাহ-ই-আমির তোহে দেখা কো

নয়নো সে নয়নো মিলাইয়ে

সুহাগান আজ বসন্ত মানালে

আনন্দ করো প্রিয়া আনন্দ করো

এখানে বসন্ত আজ আনন্দ করো

নিয়ে এসো তোমার রুপসজ্জার প্রসাধন

তোমার দীঘল চুলের বেণী সাজাও প্রিয়া

ওহ এখনো তুমি ঘুমিয়ে; জেগে ওঠো

তোমার নিয়তিও যে জেগে উঠেছে

এখানে বসন্ত আজ আনন্দ করো

ওগো নাক উঁচু মেয়ে তোমার অহংকারী মুখ

আজ এখানে রাজা আমির এসেছে তোমায় দেখতে

তোমার চোখ তার চোখে রাখো

ওহ প্রিয়তমা আনন্দ করো

এখানে বসন্ত আবার।

গুড়িয়া খসরুর সামনে বসে তার চোখে চোখ রাখে;  ‘...চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,’ আরব সাগরের সুনীল রঙ চোখের মধ্যে আজ এই মুহূর্তটাকে চিহ্নিত করে রাখার জাদুর ইশারা। সেতারের ভঙ্গিতে অঙ্গুলি মুদ্রায় মোহন ঘোটকীর মতো সে যেন জয় করে নেয় বসন্ত। ফিসফিস করে বলে, শুকরিয়া বাদশাহ আমির।

(চলবে)

 

ষষ্ঠ পর্বের লিংক

চতুর্থ পর্বের লিংক

৭১ পঠিত ... ১৯:৪৮, এপ্রিল ০৯, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top