গৌর কোমল কব্জির সবুজ চুড়িসজ্জা (ছাপ তিলক: ১ম পর্ব)

১৭৩ পঠিত ... ০৯:৪৬, এপ্রিল ০৮, ২০২৪

1 (10)

দিল্লি সালতানাতের রাজকীয় কবিতার আসরে সবার নজর কাড়ে আমির খসরু। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের ভাগ্নে মালিক চাজ্জুর সেনাদলে সৈনিক এত ভালো কবিতা লিখতে পারে। ফারসি-হিন্দি-আরবি মিলিয়ে এমন নতুন ভাষা রীতিতে এর আগে কেউ লেখেনি। তার কবিতায় রহস্য থাকে; কখনো সুফি ভঙ্গিতে কখনো বা গজলের ভঙ্গিতে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে সে। খসরু যখন কোন প্রেমের গজল গায়; সে প্রেম কখনও যেন নারীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত; একই সঙ্গে তার আত্মাটি পরমাত্মা খোদার সঙ্গে মিলনের আকাংক্ষায় সিঞ্চিত।  

বলবনের মেজো ছেলে বুঘরা খান কাব্যপাঠের আসরের পর খসরুর সঙ্গে হাঁটতে থাকে রাজকীয় প্রাসাদের বাগানে। জানতে চায়, কী করে এত অল্প বয়সে এতোটা কাব্যশৈলী এলো তার মাঝে। খসরু জানায়, বাবা সাইফউদ্দিন মাহমুদ সমরকন্দের লোক। মা দৌলত নাজ স্থানীয় রাজপুত ঘরের মেয়ে। চেঙ্গিস খানের হামলায় পালিয়ে সমরকন্দ থেকে বলখ তারপর শরণার্থী হয়ে দিল্লিতে আসেন সাঈফ। সুলতান ইলতুতমিশ আশ্রয় দেন; এমনকী পাতিয়ালি জেলায় কিছু জমিজমার বন্দোবস্তী দেন। কারণ ইলতুতমিশ ছিলেন মধ্য এশিয়ায় একইরকম দুর্ভাগ্য বরণ করা লোক। আর মা দৌলত নাজ ছিলেন রওয়াত আরযের মেয়ে। রওয়াত ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের যুদ্ধ মন্ত্রী। বাবার কাছ থেকে তুর্কী- ফারসি-আরবি ভাষা আর মায়ের কাছ থেকে হিন্দি ভাষার তালিম পেয়েছে সে। নয় বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করে। তোহফাত উস শিঘর বা শিশুবেলার উপহার নামে তার একটি কাব্যসংগ্রহ গ্রন্থিত হয়।

বুঘরা ক্রমেই যেন খসরুর ভক্ত হয়ে উঠতে থাকে। খসরু নতুন কোন কবিতা লিখলেই তা শুনতে উদগ্রিব হয়ে ওঠে সে। খসরুর সঙ্গে দেখা হবার পর ১২৭৭ সালে বাংলার লখনৌতি সালতানাত শাসনের দায়িত্ব পায় বুঘরা। খসরুকে সে আমন্ত্রণ জানায় বাংলায়। বাংলার রুপে মুগ্ধ হয় খসরু। এত সবুজ; এত উদাত্ত নদী; পাখির গান; এখানে চাঁদের টানে জোয়ার ভাটা হয়। মানুষের মনে চাঁদের প্রভাব-নদীর জোয়ার ভাটার প্রভাব। কৃষি সম্ভারে সমৃদ্ধ এই জনপদ যেন কবিতার দেশ; গানের দেশ; প্রায় প্রতিটি মানুষের কণ্ঠেই সুর এখানে।

খসরু এ সময় তার ওয়াস্ত উল হায়াত বা জীবনের মধ্যভাগ কাব্যগ্রন্থ লিখছিলো। পদ্মাবতী নদীর ধারের মানুষের সঙ্গে সে পাতিয়ালির মানুষের কন্ঠের মিল খুঁজে পায়। পূর্বী শব্দের ব্যবহার আর ঠিক ঐরকম স্বরে কথা বলে এরা। ফলে চোখ বুঁজলে মনে হয় সে পাতিয়ালিতে। পথচারীরা রাতের বেলায় যখন গল্প করতে করতে যায়; মনে হয় যেন তাদের গল্পের শব্দ খুব চেনা। স্বরধনিতে আত্মীয়তা।

বুঘরা খসরুর সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করলে স্থানীয় কবি-সাহিত্যিক-গায়ক-আর লখনৌতি  সালতানাতের কর্মচারীরা আমন্ত্রিত হন। সবাই একে একে এসে দেখা করে। কেবল এক রহস্যময়ী যুবতী দূরে বসে স্মিত হাস্যে সন্ধ্যাটাকে আরো রহস্যময় করে তোলে যেন। খসরু লুকিয়ে লুকিয়ে তাকায় তার দিকে; কচিকলাপাতা রঙ ঘাঘরা চোলি পরে; গৌর কবজি জুড়ে সবুজ চুড়ির মেলা, কপালে স্বর্ণের টিকলী; নাকছাবির নীচে ঠোঁটের ওপর গোলাপি তিল, চোখ তার যেন নদীর মতো প্রশস্ত প্রশান্ত মৃদু ঢেউময়।

বাউল অঙ্গের গান গাইছিলেন একজন গায়ক; সেইখানে পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলনের আকাংক্ষা জারিত হচ্ছে। বুঘরা এসে মুচকি হেসে খুশিজলের তাম্রপাত্রের নল কাত করে খসরুর পানপাত্র উচ্ছলিয়া ওঠায়। কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, দিলবাহার, পণ্ডিত পরিবারের মেয়ে। বাংলা সালতানাতের সম্মানিত এক ব্যক্তির কন্যা।

খসরু উত্তর দেয়, দিলবাহারের দৃষ্টির মাদকতা আমাকে দ্রবীভূত করেছে। আমাকে যেন নিশ্চিহ্ন করেছে। আমার ঠিকানা মুছে দিয়েছে ওর নদীর মতো চোখ জোড়ার অপলক দৃষ্টি। আপনি অনুমতি দিলে ওকে নিয়ে একটা কবিতা পাঠ করতে পারি আসরের শেষে।

--নিশ্চয়ই। তবে ভয় হয়  লখনৌতি থেকে বিরহ নিয়ে না ফিরতে হয় খসরুকে। এখানকার মানুষ পরদেশীর সঙ্গে সম্মন্ধটা ঠিক পছন্দ করে না।

--কোনটা দেশ কোনটা পরদেশ। প্রেমের কবিতার তো কোন দেশ হয়না সুলতান।

Amir_Khusro 1

দিলবাহার ফিরে যাবার জন্য উঠলে খসরু তার দিকে তাকিয়ে আরেকটু থেকে যাবার আকুতি জানায়। কী মনে করে দিলবাহার আবার আসন গ্রহণ করে।

বুঘরা ঘোষণা করে, অভ্যাগত অতিথিবৃন্দ; দিল্লি সালতানাতের কাব্যজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র; যাকে সবাই আসমুদ্র হিমাচলের গানের পাখি বলে চেনে; সেই শব্দের জাদুকর; সুরের ইন্দ্রজাল যার গজলে; আমির খসরু এবার আমাদের একটি প্রেমের কবিতা শোনাবেন।

খসরু ভেতরে ভেতরে একটু স্নায়ুচাপ অনুভব করে। নিজেকে সামলে নিয়ে দিলবাহারের দিকে লুকিয়ে একবার তাকিয়ে বলে, শ্রদ্ধেয় অতিথি বৃন্দ; ছাপ তিলক; আমার আজকের উপহার বিশেষ একজনের জন্য; যার নদীচোখের প্লাবনে আমার সব চিহ্ন যেন মুছে গেছে।

সবাই বাহ বাহ বলে ওঠে। কেউ কেউ বলে সাধু সাধু।

খসরু শুরু করে তার কাব্যপাঠ,

তুমি আমার চেহারা-পরিচয় মুছে দিয়েছো কেবল একবার তাকিয়ে।

প্রেমনেশার খুশিজল পান করিয়ে

মাতোয়ারা করেছো মাত্র একবার তাকিয়ে;

ও আমার গৌর কোমল কব্জির সবুজ চুড়িসজ্জা

মাত্র একবার তাকিয়ে যেন শক্ত করে ধরেছো আমায়

আমার জীবন তোমাকে দিলাম

কেবল একবার তাকিয়ে যেন আমায় শুষে নিয়েছো

আমি আমার পুরো জীবন তোমায় দিলাম

 শুধু একবার তাকিয়ে  আমায় যেন তোমার সঙ্গী করেছো ।

অতিথিরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। সবাই খসরুর কাছে এসে তাকে শুভেচ্ছা জানায়। অতিথিরা ধীরে ধীরে চলে যেতে শুরু করলে; মুখমণ্ডল একদিক থেকে ঘোমটায় আড়াল করে দিলবাহার জিজ্ঞেস করে, এই গজল আপনি কাকে নিয়ে লিখেছেন; আপত্তি না থাকলে যদি বলেন!

খসরু আড়ষ্ঠ হয়; ইচ্ছা করে রহস্য ছিঁড়ে বলে দিতে, বলে দিতে সব কথা। কিন্তু দুনিয়ার সব লজ্জা এসে যেন তার কন্ঠ চেপে ধরে। অনেক কষ্টে শব্দ জোগাড় করে বলে, এ আমার কাব্যগুরুকে নিয়ে লেখা কবিতা; অথবা পরমাত্মার প্রতি মিলনের আকাংক্ষা।

দিলবাহারের ফিরে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে খসরু। আকাশ কালো করে মেঘ করলে ঝোড়ো হাওয়া বইলে; যেমন বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের প্রার্থনা আসে; কবিতাটা পড়ার আগে তেমনি একটা অনুভূতি ছিলো খসরুর মনে। অথচ কবিতাটা পড়ার পরে যেন মনে হলো মেঘ কেটে যাচ্ছে; ঝোড়ো হাওয়া স্তিমিত হয়ে এসেছে; আর দিলবাহার ফিরে যাবার পর মনের গহীনে যেন বরেন্দ্র এলাকার বিশুষ্ক লাল মাটিতে একটি নিঃসঙ্গ ডাহুক পাখির মতো তৃষ্ণা। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন অনেক দিন বৃষ্টি হয়নি; আকন্ঠ খরা। বুঘরা আবার এগিয়ে এসে জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া বলে,  

প্রেমনেশার খুশিজল পান করিয়ে

মাতোয়ারা করেছো মাত্র একবার তাকিয়ে!
(চলবে)

২য় পর্বের লিংক

১৭৩ পঠিত ... ০৯:৪৬, এপ্রিল ০৮, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top