এক আশ্চর্য বইওয়ালা

১৪১ পঠিত ... ১৫:২৫, মার্চ ২৮, ২০২৪

28 (3)

সারা বাংলাদেশে ইন্টার্ন ডাক্তারদের বেতন ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করার একটা চেষ্টা চলছে। ভেতরে ভেতরে আমাদের, মানে এই ইন্টার্ন ডাক্তারদের অবস্থা সদরঘাট। বাইরে থেকে বোঝা যায় না।

এই উপলক্ষে আমরা কর্মবিরতিতে নেমেছি। হাসপাতালে যাচ্ছি না প্রায় ছয় দিন ধরে। রোগীদের বিশ্রী অবস্থা। খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। আমাদের জন্য কারো খারাপ লাগে না। ইদানীং সময় কাটছে সারাদিন শুয়ে বসে থেকে। সকালের দিকে মানববন্ধন করি, সাক্ষাৎকার দেই। ব্যস্ততা বলতে এতটুকুই।  কিছুক্ষণ আগে বান্ধবী অনন্যার সাথে বের হয়েছিলাম।

নতুন এক শস্তা টেইলরের সন্ধান পেয়েছি। দলে দলে সেখানে যাচ্ছি। এছাড়া আসন্ন বিয়ে উপলক্ষে সাবান-শ্যাম্পু কিনবে সে। বই পড়া আগের চেয়ে অনেক  কমে গেছে, তবু প্রত্যেকবার শাপলা মার্কেটের আসে পাশে গেলে আমার ছটফটানি শুরু হয়। পুরাতন বইয়ের দোকানে ঘোরার মতো আনন্দ খুব কম জিনিসেই পাই। অন্যান্যবারের মতো ইচ্ছাকে আজ মেরে ফেলিনি। হকার্স মার্কেটের ভেতর দিয়ে অসংখ্য চিপা গলি পার হয়ে পৌঁছলাম শাপলা মার্কেট।   

এক আশ্চর্য বইওয়ালার সাথে দেখা।

দোকানের নাম- জেনারেল লাইব্রেরি। এক চতুর্থাংশ নামানো মরিচা ধরা শাটার পেরিয়ে রোদ আসছে হুড়মুড় করে। বিশ্রী রোদ না, মোটামুটি নরম রোদ। বগুড়ায় নীলক্ষেত টাইপের কিছু নেই।

এসব বইয়ের দোকানগুলোতে মূলত পুরাতন গাইড বই, কালেভদ্রে ভালো গল্পের বই মেলে। অনেক ঘুরে ঘুরে হুমায়ূন আহমেদের বেশকিছু বই কিনেছিলাম। প্রথম দিকের এডিশন, হলুদ পাতা।

 দোকানদার লোকটার বয়স ৩০-৩৫ এর ভেতর হবে। কম-বেশি হতে পারে। কে জানে। চেহারার মধ্যে একটা ক্রিমিনাল ভাব আছে। গ্যাংস অব ওয়াসীপুরে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর মতো খানিকটা। চোখগুলো শান্ত এবং লাল, দাঁত হলুদ। লাল চোখ সাধারণত শান্ত হয় না। এক ধরনের অস্থিরতা, অসংলগ্নতা থাকে। তার চোখে এসব কিছু নেই, অদ্ভুতরকম শান্ত। কথা বলার ধরনটা ভয়ংকর। কথায় আঞ্চলিকতা নেই, শব্দ কষছে গুনে গুনে। প্রত্যেকটি শব্দ শেষে অন্তত তিন সেকেন্ড নীরবতা। ফিলার হিসেবে ব্যবহার করছে হলুদ দাঁতালো হাসি।

দামাদামি শুরু করলাম আমিই।

শীর্ষেন্দু আর সমরেশের বই দুটো বললাম চল্লিশ টাকা করে। ভেবেছিলাম ষাট টাকার কমে হয়তো দিবে না, তাই চল্লিশ থেকে শুরু। জাস্ট উইমেন থিং। অ্যানিওয়ে। লোকটা বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেলো। আশ্চর্য হলাম।

বাকি বইগুলোর দাম জানতে চাইলে লোকটি হলুদ দাঁত বের করে বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো, 'আপনিই বলেন..'

যে বইয়ের দাম জিজ্ঞেস করি, সে বলে, 'আপনি যেটা বলবেন তাই...’

ভেরি সাসপিশাস।

কিছু কিছু দোকানদার ক্রেতার বলা দাম শোনার পর তাচ্ছিল্যসূচক এ ধরনের কথা বলতে পারে। তার ক্ষেত্রে এমনটা মনে হয়নি।

লোকটার পরনে কাঁচকলা রঙের শার্ট। দেখতে তাকে যতটা অগোছালো লাগছে শার্টটা ঠিক ততটাই পরিষ্কার। গলায় নীল ফিতা ঝুলছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা নেই। ফিতার শেষ মাথা ঢুকেছে বুকপকেটে। ধারণা করি সেখানে কোনো আইডি কার্ড জাতীয় কিছু থাকবে। কিছুক্ষণের জন্য সেটা দেখার কৌতূহল জাগেনি—এটা মিথ্যা কথা।

লোকটার মুভমেন্ট এক্সট্রা স্লাগিশ। বার্ধক্য কিংবা অসুখজনিত কারণে স্লাগিশনেস নয়, ইচ্ছাকৃত। প্রত্যেকটি কাজ সে করছে .25X স্পিডে। তার পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে  আরেকটা ছেলে। সম্ভবত সে ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট। জেনারেল লাইব্রেরিতে ঢোকার পর প্রথমে মনে হবে এখানে দুই একটা ইমদাদুল হক মিলন আর অখ্যাত কিছু কবিতার বই ছাড়া আর কিছু নেই। সম্ভবত এই বইগুলোই লেখকের লেখকজীবনের একমাত্র প্রমাণ।

চিনুয়া আচেবের 'Things Fall Apart' এর প্রথম কয়েক লাইন পড়ছিলাম। পেপারব্যাক ফটোকপি৷ ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নওয়াজুদ্দিন লাইটের এর নির্দেশে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটা ভেতর থেকে বইয়ের বান্ডেল বের করলো একের পর এক।

দোকানদারের মুখে গর্বিত হাসি। সেখানে ভালো কিছু বই আছে, কথা সত্য। তবে বইয়ের দোকানে গুপ্তধনের মতো বই লুকিয়ে রাখার কারণ কী হতে পারে জানি না।

সবকিছু মিলিয়ে ভালো লাগছিলো না।  

ইনট্যুশন বলছিলো খারাপ কিছু ঘটবে। সামথিং আনইউজুয়াল। কী ধরনের খারাপ, সেটা তখনো চিন্তা করিনি। বইয়ের লোভে আমার ফ্লাইট অর ফাইট রেসপন্স তখনো চালু হয়নি। এদিকে অনন্যা আর আমি  ট্রমাতুতো বোন। আমরা দু'জন বের হলে সেদিন কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটবেই। রিসেন্টলি আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। 

যা হোক, যা বলছিলাম।

 সব মিলিয়ে বইয়ের দাম আসে ৩৩০ টাকা। ১০০০ টাকার নোট দেওয়ার পর সে নোটটা মানি ব্যাগে কম্পারেটিভলি দ্রুতই ভরে। এরপর সে এদিক ওদিক তাকায়, বই প্যাকেট করে, রশি দিয়ে বাঁধে, ক্যালকুলেটরের চার বার ১০০০ থেকে ৩৩০ বিয়োগ করে। সবকিছু  হঠাৎ করে আবার. ২৫ স্পিডে ফেরত আসে। আমি তাকে তাড়া দেই না। কৌতূহলের সাথে দেখতে থাকি।

অনন্যার এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য কম।

সে মশার মতো গুণগুণ করে বলে, 'ভাইয়া একটু তাড়াতাড়ি দেন'

লোকটি শুনে অথবা শুনেও না শোনার ভান করে থাকে।

সে আবার বলে, 'ভাইয়া একটু তাড়াতাড়ি দেন না'

মশাকণ্ঠের বদলে এখন জায়গা পেয়েছে বিরক্তি। কোনো এক আশ্চর্য কারণে, সম্ভবত গাট ফিলিং বলছিলো, বাকি টাকা ফেরত পাওয়া হবে না। দোকানদার আবারও চমকে দিয়ে স্লথের গতিতে ৬৭০ টাকা ফেরত দিলো।

আমরা বের হলাম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। ঘরে এলাম।

১৪১ পঠিত ... ১৫:২৫, মার্চ ২৮, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top