চুরিশিল্প ও ডাকাতি সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ

১৬৩ পঠিত ... ১৬:৪৪, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২৪

420158618_7484569051588124_1697045541571171087_n

শিল্প-সংস্কৃতির বিকশিত ধারার মধ্যে চুরি শিল্প ও ডাকাতি সংস্কৃতি শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে। জীবনে সাফল্যের সূচক হিসেবে এই ধারাটি এই জনপদে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে অনেক আগেই। প্রাচীনকালে পরিব্রাজক ইবনে বতুতার বর্ণনায় প্রথম উঠে আসে এ অঞ্চলে চুরিশিল্পের কথা। তিনি চুরি শিল্পীদের ব্যুৎপত্তি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন।

বৃটিশ শাসকেরা এ অঞ্চলে ডাকাতি করতে এসে চুরিশিল্পীদের দক্ষতায় নাস্তানাবুদ হতে থাকে। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের প্রতিবেদনে উঠে আসতে থাকে চুরি শিল্পীদের মুন্সীয়ানার সুকৃতি।

বৃটিশেরা এই কীর্তিমান চোরদের শিল্পকে ডাকাতি সংস্কৃতিতে রুপান্তরের জন্য কিছু লোককে বিভিন্ন এলাকার ডাকাত হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই ডাকাতদের সবাই এলাকার জমিদার বলে জানতো। এই ডাকাতেরা সম্পদ লুণ্ঠন করে কলকাতায় সেকেন্ড হোম নির্মাণ করে সেকেন্ড হোম সংস্কৃতির সূচনা করে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বৃটিশ ডাকাতেরা পাকিস্তানের ডাকাতদের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে; পাকিস্তানের ডাকাতেরা কিছু চোরকে ডাকাত হিসেবে নিয়োগ দেয়; সম্পদ লুন্ঠন করে রাওয়ালপিন্ডিতে সেকেন্ড হোম নির্মাণ শিল্প বিকশিত হয়।

এইভাবে বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের ডাকাতেরা অভিজাত শ্রেণী হিসেবে বিকাশ লাভ করে। বসার ঘরের দেয়ালে বাঘের চামড়া ও হরিণের মাথা ঝুলিয়ে শিকারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে শুরু করে এই ঔপনিবেশিক আমলের ডাকাতেরা। যেহেতু বৃটিশেরা এ অঞ্চলের চুরি শিল্পকে ডাকাতি সংস্কৃতিতে রুপান্তর করে; তাই বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের ডাকাতেরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে। সন্তানেরা শেক্সপিয়ার, হোমার নিয়ে আলাপ শুরু করায় ছোট ছোট চোরেদের মনে একদিন ডাকাত হয়ে সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার বাসনা তৈরি হয়।

পাকিস্তানি ডাকাত তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে; রাতারাতি বড় বড় বাংলো দখল করে চোরেরা ডাকাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। জাতির জনক আর্তস্বরে বলেন, কত দেশ সোনার খনি-হীরার খনি পায়; আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। তবে উনি টের পান ত্রাণের কম্বল ও গম চুরি করতে করতে এরা ডাকাত হয়ে উঠছে।

মোটামুটি নব্বুই সাল পর্যন্ত ছোটো চুরি ও ভোট ডাকাতির মাধ্যমে এই শিল্পের শিল্পীরা এগোতে থাকে। নব্বুই সালের গণ-অভ্যুত্থানের মাঝ দিয়ে জনগণ শখ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এরপর শুরু হয় ডাকাতি সংস্কৃতি বিকাশের শৈল্পিক ধারা। এ টিম ও বি টিমের ডাকাত দলগুলো তৈরি হতে থাকে একবিংশ শতককে ভোট ও দেশ ডাকাতির আলোয় আলোকিত করতে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এ টিম ডাকাত দলটিকে বিশ্বে চ্যাম্পিয়ান ঘোষণা করে। বি টিম ডাকাত দলটি এরপর চারবছর সেই ডাকাতির শিরোপা ধরে রাখে। বি টিমের কালু-দুলুরা গোলি থেকে রাজপ্রাসাদে উঠে আসে ডাকাতি করে। এই যুগটিকে খাম্বা ডাকাতির যুগ বলা হয়। শুরু হয় এনালগ টাকা পাচার। ডাকাতেরা সাফারি পরে ঘুরতে শুরু করে। সাফারি পরে ডাকাতি হয়ে পড়ে ঈমানের অঙ্গ।

এরপর আসে কুইক রেন্টাল ডাকাতি যুগ। এসময় গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে ডাকাতির সাংস্কৃতিক জয়গান শুরু হয়। টিভি টকশোতে ডাকাতির নান্দনিক দিক নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। এনালগ টাকা পাচার ডিজিটাল টাকা রপ্তানিতে পরিণত হয়। এ টিমের হাবলু-বাবলুরা পশ্চিমের বেগম পাড়ায় সেকেন্ড হোম কিনে; ছেলে-মেয়েকে ইংরেজি শিক্ষা দিতে শুরু করে। ডাকাতি হয়ে পড়ে দেশপ্রেমের অঙ্গ। বাজারে কালো কোটের বিক্রি বেড়ে যায়। ডাকাতেরা কালো কোট পরলেই তাদের ব্যাপ্টিজম হয়ে যায়।

ওশান'স ইলেভেন মুভির মত স্মার্ট ডাকাতির ধারা বিকশিত হয়। ব্যাংক ডাকাতি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি ডাকাতি শিল্পীর দেশ বলে স্বীকৃতি দিলে; ডাকাতের পৃষ্ঠপোষকেরা গোস্বা হয়। তারা বলতে থাকে উন্নয়নের গাড়ি রাস্তা দিয়ে গেলে ধুলাবালি বেশি উড়বেই। কোন দেশে ডাকাতি নাই বলেন!

উন্নয়ন মানে সেতু, রাস্তা, মেট্রোরেল নির্মাণ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে তিনগুন খরচ করে এই যে উন্নয়ন; এটি উন্নয়ন শিল্প ও ডাকাতি শিল্প পরস্পরকে প্রবিষ্ট করে। সাধারণ মানুষ বাজার থেকে মাছের কাঁটা ও মুরগীর গিলা-কলিজা কিনে খেতে থাকে। আর ডাকাতেরা টেবিল ভর্তি খাবার খেতে খেতে ঐ টিভি রিপোর্ট দেখে বলে, মিডিয়া উন্নয়নের সঙ্গে শত্রুতা করছে।

চোরের মায়ের বড় গলা আবহমান বাংলার প্রচলিত প্রবাদ; সেটা ডাকাতের বাপের বড় নলায় পরিণত হয়। ডাকাতি শিল্পে তেলাঞ্জলি আঙ্গিক প্রতিষ্ঠিত হয়। পনেরো বছর আগে যারা চুরি শিল্পে বেঁচে ছিলো ছোট কুঁড়ে ঘরে; তারা ডাকাতি করে রাতারাতি দালান তোলে; বাসায় মুঘল আমলের বড় বড় পর্দা ঝুলায়। বৃটিশ আমলের ডাকাত জমিদারদের হাভেলির অনুসরণে তৈরি হতে থাকে বাংলাদেশ আমলের ডাকাত জমিদারদের হাভেলি।

ফেসবুকে বাইগার নদীর ধারে ডাকাতের নতুন হাভেলির সামনে স্যুট টাই পরা ছবি আর সানগ্লাস পরা বৌ-এর ছবি দেখে লোকে চিনে ফেলে, আরে তুই কে পাটগাঁতির টিক্কা না; আমি তোর কারেক্ট কারেক্ট কওয়া দেইখা চিইনা ফালাইছি!

টিক্কা ধমক দেয়, পারস নাই তো স্মার্ট হইতে; খালি হিংসা করস! এখন থেইকে আমারে স্মার্ট ভ্যাকসিন চৌধুরী কয়া ডাকবু!

১৬৩ পঠিত ... ১৬:৪৪, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top