ভোটের মাঠে স্বামী ও ডামি

২৬৯ পঠিত ... ১৭:৪৩, নভেম্বর ৩০, ২০২৩

11

মনোনয়ন মানেই নির্বাচিত হবার আনন্দ; সেই আনন্দে ফুল ছোঁড়া, প্রাডো শোভাযাত্রার শো ডাউন, অত্র এলাকার পোলায় ক্ষমতাশ্বরের মন ও নয়ন জয় কইরা আসছে; দুই-চারখান গরু ফেলে দিয়ে মেজবান হয়ে যায়; ভরপেট খাওনের পর পান চিবাতে চিবাতে আক্কেল আলী এসে বলে, 'তাতো হইলো এমপি সাব, সবই তো বুঝলাম; কিন্তু ক্লাসে একটাই ছাত্র; সে ফাস্টো হইছে; এইটা কিমুন দেখায়! একটা ডামি দিয়া একটু কম্পিটিশান আনা দরকার।'

মনোনীত এমপি সাহেব সোফায় এলিয়ে বসেছিলো যুগে যুগে এমপিরা যেইরকম দেমাগ নিয়ে ক্যাতরাইয়া বসে থাকে সেই ভঙ্গিতে। আক্কেল আলীর কথা শুনে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জো। ফোন করে ভাতের হোটেল, সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স, আয়নাঘরের কাছে। সবাই ঐ এক কথা বলে, আমগো দায়িত্ব তৃণখড় জোগাড়; গৃহপালিত ন্যাশনালিস্ট মোরগ-মুরগী ডিম ফুটাইয়া বাইর করা। ডামির ব্যাপারটা দেখার দায়িত্ব মনোনীতের নিজের।

মনোনীত এমপি সাহেব আক্কেল আলীকে জিজ্ঞেস করে, 'কারে ডামি বানান যায় কন দেখি!'

: সহমত ভাই একটা দাঁড় করাইয়া দেওন যায়; কিন্তু আমগো তো আবার মুশতাকের রক্ত আর কিসিঞ্জারি বুদ্ধি; দলের কাউরে বিশ্বাস করার উপায় নাই; চান্স পাইলে চোখ উল্টাইয়া মীরজাফর-জগতশেঠ হইতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে না। এইজন্য ক্ষমতাশ্বরের বুদ্ধি অনুযায়ী সবসময় পরিবারেই ডামি খোঁজা প্রয়োজন। আল্লাহ না করুক আন্নে পটল তুললে; তখন আন্নের বিধবাই তো মনোনীত হইবো। তাই বিসমিল্লাহ কইরা ভাবী সাবরেই ডামি করে ফালান; সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবেন; মাইয়া মানুষ তো বাঁইকা যাইতে হাফ সেকেন্ডও লাগে না!

এলাকায় ডামি বনাম স্বামী ভোট যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শুক্কুর আলী জর্দা দেয়া পান খেতে খেতে ফুচুত করে পিক ফেলে বলে, স্বামীর পাঁজরের হাড় থিকা স্ত্রীর সৃষ্টি। কাজেই ডামি হিসেবে সেই যোগ্য। কোথাও যদি নারী প্রার্থী ক্ষমতাশ্বরের মন ও নয়ন জয় কইরা আসে; সেইখানে স্বামীরেই ডামি প্রার্থী করা দরকার। হাজার হোক পাঁজরের হাড়ের বন্ধন।

মনোনীত এমপি স্বামীর মাঝে মাঝেই মনে হয়; এলাকার মানুষের মন জয় করার দৌড়ে তার স্ত্রী এগিয়ে যাচ্ছে। ডামি দেখতেই লোকে বেশি ভিড় করছে। স্ত্রীর ভাই-বোন আর কিসিঞ্জার শাশুড়ি এসে হাজির হয়েছে; সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে তারা ফিসফাস ফুসুর-ফাসুর করে। স্ত্রীকে অপরিচিত মনে হতে থাকে। সে অনেকদিন ধরেই কাছে ডাকলে মাথা ধরেছে বলে প্যারাসিটামল খায়। আর এখন তো গেয়ে ওঠে, নেহি নেহি আভি নেহি থোড়া কারো ইন্তেজার।

স্ত্রীর এক ফেমিনিস্ট বান্ধবি এসেছে ঢাকা থেকে ডামি প্রচারণায় অংশ নিতে। সে ডামির প্রচারণায় গিয়ে নারী অধিকার নিয়ে আর্তনাদ করে উঠছে; আর এলাকার কন্যা জায়া জননী উচ্ছ্বাসে হাততালি দিচ্ছে। সে ডামিকে অপর্ণা সেনের মতো মেক আপ দিয়ে নারীবাদী প্রার্থী সাজিয়েছে। মিডিয়ার লোক এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্টের পর মিডিয়ায় এমনভাবে খবর প্রকাশ করে যেন শুধু মেয়েরাই পরীক্ষা পাশ করেছে। তারা সেই স্বভাব অনুযায়ী ডামি নারী প্রার্থী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে; নানান ভঙ্গিমার ছবি ছাপছে। টিভির চোঙ্গাওয়ালাওরা স্বামীকে দেখলে ক্যামেরা অফ করে দেয়। আর স্ত্রীকে দেখলেই ক্যামেরা চালু করে। এ কী বিপদ হলো!

এক জনসভায় তো ডামি বলেই ফেলে, যে লোক তার স্ত্রীকেই সুখ দিতে পারেনা; সে এলাকাবাসীকে কী সুখ দেবে! অমনি জনসভার লোকেরা হাসিতে ফেটে পড়ে।

মনোনীত স্বামী একাকীত্বে ফোন করে ঢাকায় এক রেড স্প্যারোকে, হ্যালো সিনথিয়া, আচ্ছা বলো তো; আমি কী তোমাকে সুখ দিতে পারিনি! রেডস্প্যারো খিল খিল করে হেসে বলে, কেন কী হইছে!

: বউ ডামি প্রার্থী হইয়া জনসভায় বলতেছে আমি নাকি তারে সুখ দিতে পারি নাই!

: তোমার আসলে আমাকে প্রার্থী করা উচিত ছিলো বাবু! আমি তাহলে জনসভায় গিয়া বলতাম, বাবু আমাকে যেমন সুখ দিয়েছে; এলাকাবাসীকেও তেমন সুখ দেবে। বাবু আমাকে এক লাখ টাকা বিকাশ করো; খুব আর্জেন্ট হয়ে পড়েছে।

: এমনিতেই ইলেকশনে অনেক খরচ; পরে দিলে হয় না বেবি!

: বাবু, তোমার মনে আছে আমাদের পাতায়া টুরের কথা; আমি তো রোমান্টিক সিন ভিডিও কইরা রাখছি গো! টাকাটা পাঠাও!

মন খারাপ করে মনোনীত এমপি সাহেব ইলেকশন ডামি থিয়েটারের নির্দেশক অগ্নিহোত্রীকে ফোন করে। স্যার, ভাব দেখে মনে হচ্ছে এই ডামি শামুকেও পা কাটবে! এখন করি কী!

: আপনার মনোনয়ন পত্র জমা দেবার সময় তো দেখলাম ইউএনও ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছে; আপনার আর চিন্তা কী! আপনি জনগণকে ছেড়ে দিন মশাই। তুষ্ট করুন ইলেকশন দেবতাদের। ফলাফলের সংখ্যা বসানোর শিল্পী যারা; তাদের পূজা দিন; যে দেবতা যাতে তুষ্ট তাকে তাই দিন। আমি যাই, ইলেকশন নাটকের দেবর-ভাবি চরিত্র দুটিকে একটু রিহার্স করাই। আল্টিমেটলি গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে ওদেরকে লাগবেই। আর আপনি ঘরের মামলা ঘরেই মিটিয়ে ফেলুন। দেখবেন আবার স্ক্যান্ডাল না হয়। ঝিনুক নীরবে সহো।

ডামি প্রার্থীর বান্ধবি এক জনসভায় মনোনীত এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে ‘মিসোজিনি’-র অভিযোগ তোলে। অর্থ বুঝে না বুঝে এলাকার লোকেরা ছ্যা ছ্যা করে। ঘষেটি বান্ধবি তার ফেসবুকে ‘অতীতে বান্ধবীর হাজব্যান্ডের সঙ্গে’ তার ইনবক্স চ্যাটের বানোয়াট স্ক্রিন শট ফাঁস করে। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকের সাধু-সন্ত পুরুষেরা এসে ধিক্কার দেয়। ফেসবুকের সারাক্ষণ রেগে থাকা ফেমিনিস্ট আপারা বলে, এমন দুঃশ্চরিত্র স্বামীর ঘর করাও অপমানজনক। আমাদের স্বামীরা তো আমাদের অনুমতি ছাড়া অফিসের নারী কলিগের সঙ্গে কথাটিও বলে না।

পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকে। ফেসবুকে যাদের এই স্বামী ও ডামির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নাই; তারাও কুঁচ কুঁচ করে স্টেটাস দিতে শুরু করে। ইলেকশনের আগে যে সব বিদূষক ‘গণতন্ত্র’ ‘নির্বাচন’ ইত্যাদি নিয়ে কথা বললে, চাকরি থাকবে না পরিস্থিতিতে আছে; তারা যেহেতু কথা বলতে না পেরে বুক ফেটে যাওয়া অবস্থায় ছিলো। সুতরাং এই ডামির স্বামীর চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ করতে তারা বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় কেউ কেউ জিভের নীচে ওষুধ রেখে বলে, এই পাষাণ স্বামীকে কী বলে যে ধিক্কার দেই; আমরা তো ভাবতেও পারিনা যে স্ত্রীর বান্ধবীর সঙ্গে চ্যাটিং করা যায়! লম্পট কোথাকার!

স্বামী দৃঢ়ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে, আমি কখনোই এই মহিলার সঙ্গে চ্যাটিং করিনাই; তারে তো দেইখাই ভালো লাগে না; চ্যাটিং করবো কেন!

এইবার চলে আসে রেসিজমের অভিযোগ। স্ত্রীর বান্ধবীকে ‘দেইখা ভালো লাগে না মানে।‘

ফেসবুকে মনোনীত এমপিকে নাকাল হতে দেখে তার রেড স্প্যারো বান্ধবী সিনথিয়া এসে বলে, অযথা স্ক্রিনশট বানাইয়া লোকটারে হেনস্থা করতেছে বিপক্ষ শিবির। আরে আমার মতো বান্ধবী থাকতে ঐ বেত্মোদতীর সাথে চ্যাট করবে কেন উনি!

এরপর পরিস্থিতি ক্লাইমেক্সে পৌঁছে যায়, মনোনীত এমপি সাহেবের ওপর রেগে টং হয়ে যায় স্ত্রী ডামি প্রার্থী, তাই তো বলি একটা কথা জিজ্ঞেস করলে মুখের দিকে না তাকাইয়া ফোনের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকাইয়া থাকে কেন! আমি তো আর ঐ ঠুনকি মেজাই-এর মতোন ঢং ঢাং করতে পারি না... এতোই যখন পছন্দ তখন তারে গিয়া বিয়া করো; আমি আর তোমার সংসার করুম না; আমি এখন থিকা পলিটিকসটাই করবো ফুল টাইম।

এলাকার লোকের সহানুভূতি গিয়ে পড়ে ডামির ওপর। এমনকী যে লোকেরা রেলস্টেশনের পাশের জ্যোতস্নার বালার ঝুপড়িতে যায় নিয়মিত; তারাও সবাই সাক্ষাত সাধু হয়ে, ছ্যা ছ্যা করে ওঠে। ক্ষমতাশ্বরের মন ও নয়ন জিতে আসার পর যারা ফুল ছুঁড়েছিলো তারা এখন পাথর ছুঁড়তে উদ্যত হয়।

এক মেনিমুখো সাংবাদিক ক্ষমতাশ্বরের কাছে গিয়ে মনোনীত প্রার্থীর চরিত্রের কাসুন্দি করে আসে কুঁচ কুঁচ করে। সেখানে কানকথার প্রবল প্রতাপ। ক্ষমতাশ্বর রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলেন, ‘হাজার কোটি টাকা মেরে দুবাইয়ে পাচার করে দিলেও চরিত্রের এতো ক্ষতি হয় না। যত ক্ষতি হয় নারীঘটিত দুর্নীতিতে।‘

ক্ষমতাশ্বরের রাগটাই আইন। সুতরাং এবার ইউএনও এসে ডামি প্রার্থীর পাশে দাঁড়িয়ে ‘ভি’ চিহ্ন দেখায়।

২৬৯ পঠিত ... ১৭:৪৩, নভেম্বর ৩০, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top