বছর নয় সপ্তাহের সংবাদচক্র: এইদিন প্রতিদিন

৩৯৯ পঠিত ... ১২:৪৮, ডিসেম্বর ৩১, ২০২১

Year-End 2021 bangladesh

সম্পাদক সাহেব ডেকে নির্দেশ দেন ২০২১ সালের একটা সালতামামি লেখার জন্য। সম্পাদকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে সিনিয়র সাব এডিটর মাথা চুলকে বসে যায় ২০২১ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী সম্পর্কে লিখতে। ঘটনাবলীর দিকে চোখ বুলিয়ে সিনিয়র সাব এডিটরের মনে হয়; সপ্তাহের ঘটনাচক্র লিখলেই সেটা সালতামামি হয়ে যাবে। আলাদা করে বছরের ঘটনা খোঁজার মানে হয় না। এইদিন প্রতিদিন যেখানে; সেখানে সপ্তাহের সংবাদচক্র লিখলেই যথেষ্ট।

যেমন ধরা যাক শনিবার একটি ধর্ষণের ঘটনা। খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিবাদে উত্তাল। বিচার চাই বিচার চাই। নানারকম স্ট্যাটাস। নানারকম মুন্সীয়ানায় লেখা প্ল্যাকার্ড। শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ প্রতিবাদের উত্তাপে মনে হয়; এটাই ধর্ষণের শেষ ঘটনা। এরপর একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। টিভি টকশোর রোজ এনে রোজ খাওয়া আলোচনায় মাতৃরূপেনো সংস্থিতারা চেহারা এমন কঠোর করে কথা বলেন যে, ধর্ষণের মড়ক আজই থেমে যাবে।

কিন্তু রবিবার আসে পুলিশ আর স্থানীয় রিপোর্টারদের চা-বিড়ি ফুঁকার আসর থেকে উত্থিত 'ধর্ষিতার চরিত্র ব্যবচ্ছেদ' প্রতিবেদনে। ধর্ষিতাই খারাপ মেয়ে ছিলো এমন ইঙ্গিতে ভরপুর আলোচনায় রবিবারের বাতাস শনিবারের ঠিক উলটো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবার বলবানদের কড়া কড়া স্ট্যাটাস। ভাবখানা এমন, নারী ঘরের মধ্যে থাকবে, পর্দা-পুসিদা সহকারে মেহরাম সহযোগে বাইরে যাবে; যদি একান্ত দরকার হয়। তালেবানরা যেমন বলেছে, নারী ৭২ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে যেন ভ্রমণ না করে। বলবানদের স্থানীয় প্রশাসন তখন গোলাপী বেলুন উড়িয়ে নারীর জন্য ৭২ ফুটের নিরাপদ ভ্রমণ কেন্দ্র চালু করে। মাতৃরূপে সংস্থিতারা আবার ফিরে আসে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস নিয়ে। এরকম ছোট ছোট প্রতিবাদে জ্বালাময়ী হলে তা নিরাপদ। ছোট ছোট প্রতিবাদে বিজয় অর্জনে এটাও বলা যায়, দ্যাখো কত বড় জবাবদিহির এক স্বচ্ছ সরকার।

সোমবার এলিট ফোর্স তার সংবাদ সম্মেলনে আবার বদলে দেয় সংবাদ ধারা। ধর্ষিতা নয় আবার ধর্ষকের দায় এসে পড়ে তৃতীয় দিনে। ধর্ষক নিশ্চিতভাবে সরকারি দলের লোক। ফেসবুকে স্থানীয় এমপির সঙ্গে ধর্ষকদের দাঁত কেলানো সেলফি ভাসতে থাকে। ধর্ষক ধনধান্যপুষ্পভরা বসুন্ধরার মালিকের ছেলে হলে, নো ওয়ান রেপড দ্য ধর্ষিতা। আর ধর্ষক বসুন্ধরার সহমত ভাই হলে তাকে গ্রেফতার। তখন অন্য সহমত ভাইদের দায়িত্ব ধর্ষককে সরকারি দলে পরাজিত শক্তির অনুপ্রবেশকারী রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করণ। সহমত দাদা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ধর্ষককে তালেবান হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে যায়।

শনি-রবি-সোমবারের ধর্ষণকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করলে; পরিসংখ্যান ব্যুরো ব্যস্ত সমস্ত হয়ে উন্নয়নের নতুন সূচক প্রকাশের পায়তারা  করে। মেট্রোরেল নড়ে উঠে উত্তরা থেকে বনানী ট্রায়াল রান করে। পদ্মাসেতুর চূড়ান্ত ঢালাই-এর দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে শশব্যস্ত হয় বাতাবী টিভির দল। ফলে মঙ্গলবার সকাল আসে, উনিই পারেন উনিই পারবেন এমন রবে; উনিই রব উনিই পরওয়ারদিগার এমন আনন্দে হুটোপুটি খায় সাইবদরেরা। শনিবার ধর্ষণের ঘটনায় যে প্রগতিশীল বলবানেরা সরকারের একটু বেশি সমালোচনা করে ফেলেছেন; তারা মঙ্গলবারের উন্নয়ন সংবাদ পেয়েই প্রশংসায় ভেসে মেক আপ সেশানে চলে যান। দিনের শেষে সরকারি পদক-টদকগুলোও তো পেতে হবে।

মঙ্গলবারের বাতাস অনুকূল পেয়ে সরকারি রাজনীতিকদের পিছে ফেলে পুলিশের কর্তা গর্জে ওঠেন, দেশের বাইরে থেকে টাকা এনে সরকার বিরোধী 'যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্র' করে যারা, তাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া হবে। এ খবরের মন্তব্যে সাধারণ জনতা বলে, যাক বাবা তাও তারা টাকা দেশের বাইরে থেকে দেশে এনেছে; সহমত ভাইদের মতো দেশের বাইরে পাচার করে নাই। মঙ্গলবারের বাতাস অনুকূল থাকায় সরকারি নেতারা পান-সুপারী চিবাতে চিবাতে প্রতিপক্ষের নেতা-নেত্রীদের নিয়ে রগড় করে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা সংস্কৃতি মামা প্রতিপক্ষের নেত্রীকে নিয়ে আকারে ইঙ্গিতে স্বভাবসুলভ ধর্ষকামী কথাবার্তা বলে।

মঙ্গলবারের সুখ বুধবারে এসে যেন আর সয়না। লঞ্চে আগুন, বাস দুর্ঘটনা, অগণন মানুষের মৃত্যুর খবরে বুধবারের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মন্ত্রীরা ঢেউটিন-ছাগল-নগদ অর্থের ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে। সহমত ভাইদের দায়িত্ব তখন, ইংল্যান্ড-এমেরিকার দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রোডিউস করা। সুরটা এমন, উন্নত দেশেও এমন হয়। সহমত দাদা পাকিস্তানের রুপির তুলনার বাংলাদেশের টাকা দ্বিগুন  শক্তিশালী এই মিম ঘাড়ে নিয়ে ইতস্তত দৌড় ঝাঁপ শুরু করে। বুধবার ভারাক্রান্ত হয় দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলে; আর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট চলে 'উন্নত দেশেও এমন হয়' ভাটিয়ালী গানের সুরে।

বৃহস্পতিবার 'মন্দিরের মূর্তি' ভাঙ্গার খবরে আবার বাতাস ভারাক্রান্ত হয়। বলবানেরা তখন 'ভারতেও সংখ্যালঘুরা কষ্টে আছে' এমন ওয়াজ নসিহতের সুরে আকুল হয়। মন্দিরের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের হলেও; সংস্কৃতি মামারা তখন ক্ষমতায় যেন 'গোপালী নয় গোলাপী' এমন পুরোনো অভ্যাসে সে অনেক অনেককাল আগের কথা, নির্বাচনে জিতে গোলাপীরা মন্দির ভেঙ্গেছিলোর গল্প নিয়ে টিভি টকশোতে হাজির হয়ে যায় বাঘ ও সিংহবদনে। ফেসবুকে মৌলবাদ নিয়ে বিশ্লেষণ হাজির করে সংস্কৃতি মামারা। পরকালশীল বলবানেরা শুক্রবারের নামাজের পরে উচ্ছৃখল হয়ে উঠতে পারে; এই আশংকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। মুরাদ টাকলা জাতীয় কেউ বিবৃতি দেয়, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনবো ইনশাল্লাহ। ইসলাম গেলো গেলো রব ওঠে শোকরানা মেহেফিল শিবিরে।

আশংকা থাকলেও শুক্রবারটা কিছুটা শান্তিপূর্ণ কেটে গেলে, বিকেলের দিকে উনি পান-সুপারী চিবুতে চিবুতে প্রতিপক্ষকে টিকাটিপ্পনী দিয়ে 'ওদেরকে জনগণ কেন ভোট দেবে' জাতীয় মশকরা করেন। ফেসবুকে সহমত ভাইয়েরা আনন্দে হুটোপুটি খায়। বাতাবি লেবুর সুঘ্রানে টিভিগুলো মৌ মৌ করে।

পাখিরা কিচির মিচির করে, হোয়াট ইজ ভোট!

৩৯৯ পঠিত ... ১২:৪৮, ডিসেম্বর ৩১, ২০২১

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top