স্মৃতিগদ্য: জুতাকাহিনী

৩৭০ পঠিত ... ১৭:৪১, মে ০৩, ২০২৩

স্মৃতিগদ্য

আমার প্রিয় ফুটবলার সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের প্রশ্ন জর্জরিত হয়ে বলেছেন; সাংবাদিককে তার বাবার পায়ে জুতাসহ ছবি এনে তারপর উনার ইন্টারভিউ করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

আমি পড়ে গেলাম বিপদে। আমার বাবা তো সবসময় স্যান্ডেল পরতেন। বাসার পাশেই তাঁর কলেজ ছিলো। ক্লাসের ঘন্টা পড়লেই শার্টের হাতা গুটিয়ে একটা স্যান্ডেল পায়ে গুঁজে ছুটতে ছুটতে চলে যেতেন ক্লাস নিতে। শীতকালে একান্তই কোন ফর্মাল অনুষ্ঠানে কোট পরে যাবার প্রয়োজন পড়লে; তখন জুতা পরতেন। অবহেলায় আলনার পাদানিতে পড়ে থাকা জুতাগুলো যেন হেসে বলতো, কী এতোদিনে আমাদের কথা মনে পড়লো। ফলে আমার কাছে বাবার জুতা পরা কোন ছবি নেই।

একবিংশ শতকে বাবার জুতা কেন মি সালাউদ্দিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো; তার জেনেসিস খুঁজতে আমাদের যেতে হবে ইতিহাসে।

 বৃটিশ আমলে লর্ড কর্নওয়ালিশের সহমত ভাই হয়ে জমিদারি পাওয়া বাড়ুজ্যে বাবু কিংবা মির্জা সাহেব জুতা পরতেন। তারা চাইতেন, প্রজারা কেউ জুতা পরবে না।

পাকিস্তান আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র আইয়ুবশাহীর দিকে জুতা ছুঁড়ে মেরেছিলো। পাঞ্জাবের ঐ সেনাশাসক বলেছিলেন, আমি তোমাকে জুতা পরতে শিখিয়েছি; আমাকে তো জুতা মারবেই।

পাকিস্তানের এক সিএসপি অফিসার সেসময়ের ঢাকা সচিবালয়ের শৌচাগারে কমোড লাগানো প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে তো সবাই খোলাস্থানে মল ত্যাগ করে; তারা কমোড দিয়ে কী করবে!

সৌভাগ্যক্রমে সেই সিএসপির নাতির সঙ্গে একটি পার্টিতে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছিলাম; পাকিস্তানে কি সেইসময় খোলাস্থানে মলত্যাগ করতো না লোকজন? নাকি এখানে সেইকালে কমোড বিপ্লব হয়েছিলো?’

সিএসপির নাতি হেসে বলেছিলো, ‘পাঞ্জাবের সেনা আর সিএসপিরা কমোডে মলত্যাগ করতো ঠিকই; কিন্তু কথাবার্তায় যত্রতত্র এরকম মলত্যাগ করেই দেশটার বারোটা বাজিয়েছে।‘  

গম ক্ষেতে মলত্যাগ করা পাঞ্জাবিরা সরকারের সহমত ভাই হয়ে কমোড কিনেই সেসময় বলতো, ‘বাঙ্গালিরা বেঁটে কালো কদাকার, তাদের গায়ে মাছের গন্ধ।‘ তাই অনেক আলোচনাতেই পাঞ্জাবের শিক্ষিত লোকজনকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনাদের সেই উঁচা লম্বা সুদর্শন সুগন্ধী ছড়ানো পাঞ্জাবিটাকে একবার দেখাবেন ভাই? পাকিস্তান সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তো ওসব নীলপদ্ম দেখি না।‘

তো এইসব বৃটিশ ও পাকিস্তান উপনিবেশের সহমত ভাইদের রেসিজম শেষ হতেই; আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে স্বদেশী অলিগার্ক উপনিবেশের রেসিজম। একবার অবাঙ্গালির বিজ্ঞাপনী সংস্থা দখল করা এক সংস্কৃতিময় ভদ্রলোক ঢাকার জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউটে ট্রেনিং সেশানে বলেছিলেন, ‘তোমরা সিভিল সার্ভিসে যে বেতন পাও; তোমাদের জন্য দুঃখ হয়। কী করে চলো তোমরা?’

এক আমলার নৈশভোজের টেবিলে, তার মেয়েরা বাঙালি জি-যেড, ভি-ভ উচ্চারণ করতে পারে না! ‘কী কুট্টি!’ বলে হেসে কুটিপাটি হচ্ছিলো।

এরা যে ইংরেজি জানে তা দিয়ে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বা বিদেশী দূতাবাসের কেরানির চাকরিটুকুই পায়। অথচ হাসাহাসি করে বাঙালি কেরানি নিয়ে।

আর আছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পোশাক পরা সংস্কৃতি মামা-খালা; তাদের সামনে গেলে খুব সাবধানে পানিকে জল, গোসলকে স্নান, গোশতকে মাংস বলতে হয় টিপে টিপে। দোয়া করবেন না বলে, বলতে হয় আশীর্বাদ করবেন। নইলে প্রগতিশীলের পৈতে কেড়ে নিয়ে আমাকে বের করে দেবেন তাঁদের সংস্কৃতি মন্দির থেকে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ; ভারতের অবাঙ্গালি এলাকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পানি, গোসল, গোশত এসব শব্দ ব্যবহার করে। এই শব্দগুলো প্রায় ৪০০ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করে রেসিডেন্সি পেয়েছে।

ইউরোপে অপেরা আসরের পারফরমারেরা তাদের ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরে; কিন্তু দর্শকের সারিতে অপেরার কস্টিউম ফ্রক কিংবা টাকসিডো পরে কাউকে কোনদিন দেখিনি।

অথচ বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংগীত গায়ক-গায়িকার ট্র্যাডিশনাল পোশাক স্টেজেও দেখি; দর্শকের সারিতেও দেখি। ঐখানে আমি টিশার্ট-জিনস-স্যান্ডেল পরে হাজির হলেই ঘাড় বাঁকা করে বলবে সংস্কৃতিজন, দেখেছো রুচির কী দুর্ভিক্ষ!

স্বদেশী উপনিবেশে সংস্কৃতি মামার রেসিজমের পাশাপাশি ধর্মমামার রেসিজমও আছে; তাদের সামনে রমজানকে রামাদান বলতে হবে, ঈদুল আজহাকে ঈদুল আদহা বলতে হবে, বিয়েকে আকদ বলতে হবে। খোদা হাফেজকে আল্লাহ হাফেজ বলতে হবে। নইলে তাদের দেড় ইটের মসজিদ থেকে বের করে দিয়ে কেড়ে নেবে ঈমানের সনদ।

আমার আম্মা একবার শাড়ি পরে কলেজে যাচ্ছিলেন ক্লাস নিতে। আম্মাকে যতদিন দেখছি; উনি এমনি শাড়ি পরা। অথচ হিজাবি নারীরা আম্মার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন, যেন আম্মা দোজখ থেকে এসে ঢুকে পড়েছেন, তাদের স্বনির্মিত বেহেশতের বাগানে। আমার আব্বা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্যার আপনি দাড়ি রাখেন না ক্যান! এইসবই আমাদের সমাজের  ঝকঝকে রেসিজম।

ফুটবলার সালাউদ্দিন সাদাকালো টিভিতে লাইফ বয়ের বিজ্ঞাপন করতেন। আধুনিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন অলিগার্কদের সহমত ভাই হয়ে বড্ড ভি আইপি সিনড্রোমে ভুগছেন। শহীদ শেখ কামালের বন্ধু বলে বুবু তাকে ফুটবল ফেডারেশানের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ফুটবল র‍্যাংকিং-এ বাংলাদেশ নামতে নামতে বাতাবি লেবু টিমে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অলিগার্কেরা জবাবদিহিতে বিশ্বাস করে না। সে সাংবাদিককে বিদূষক হিসেবে দেখতে চায়। বাংলাদেশের এমিরেটাস সাংবাদিকেরা ঠিক যেমনটা হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সের পিকনিকে।

কিন্তু তরুণ সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করে; জানতে চায়; কেন বাংলাদেশের ফুটবল বাতাবি লেবু হয়ে গেলো!

তাতেই তেতে যান ফুটবলের হীরক রাজা সালাউদ্দিন, সাংবাদিকের বাবার পায়ে জুতা খুঁজছেন। বড্ড স্টেটাস সচেতনতা দেখাচ্ছেন।

এইসব জুতা খুঁজে পাওয়া কঠিন; কারণ সালাউদ্দিনের বাতাবি লেবু টিম এক একটা ম্যাচ গোহারা হারার পর জুতা ছুঁড়তে ছুঁড়তে; দর্শকদের খালি পায়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। খুঁজে দেখুন স্যার, জুতাগুলো ফুটবল মাঠেই পড়ে আছে।

 

৩৭০ পঠিত ... ১৭:৪১, মে ০৩, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top