চারুকলা কি দেশের উন্নয়নে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখছে? নাকি চারুকলার ছেলেমেয়েরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়? উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতোই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি চারুকলা পুষে যাচ্ছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন শাকিল মৃধা।
১. পোশাক শিল্প: দেশ যে পোশাক শিল্পে বিশ্বে এখন টপে আছে, এই শিল্পে মূল অবদান রেখেছে গার্মেন্টস কর্মী, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার এবং ফ্যাশন ডিজাইনার। এবং অধিকাংশ দেশীয় এবং এক্সপোর্ট ফ্যাশন ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রির ডিজাইনিং হেড যিনি, খোঁজ নিয়ে দেখেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই চারুকলার। দেশীয় ব্র্যান্ড আড়ং, সেইলর, দেশালে যে আপনারা সুন্দর ডিজাইনের জামাকাপড় কেনার জন্য ঈদের সময় মারামারি করেন, চারুকলার ডিজাইনার সব সড়ে গেলে সেই মারামারিটাও বন্ধ হয়ে যাবে।
২. গ্রাফিক ডিজাইন ও অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রি: এই যে টিভি চ্যানেল, ইউটিউবে কত রকম কার্টুন বা অ্যানিমেশন দেখেন, অধিকাংশ গ্রাফিক ডিজাইন ও অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রির হেড যিনি, তিনি চারুকলার। (আমি নিজে চারুকলার এবং একটি এনিমেশন এজেন্সির আর্ট ডিরেক্টর)
৩. এত বড় বড় সব বিল্ডিং হচ্ছে দেশে, তার ভেতরের কাজ করে মূলত ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। স্থপতিরা ছাড়াও চারুকলার প্রচুর শিক্ষার্থী এই ইন্টেরিয়র ডিজাইন সেক্টরে কাজ করে। ওয়াল পেইন্টিং থেকে শুরু করে, ম্যুরাল, টেরাকোটা, কাঠের ডিজাইন এমন অনেক অনেক ক্রিয়েটিভ কাজ আছে, যা চারুকলার ছাত্র ছাড়া আটকে থাকে।
(আমি নিজে প্রচুর রেস্টুরেন্ট/অফিসে ইন্টেরিওর ডিজাইন, ম্যুরাল ও ওয়াল পেইন্টিং এর কাজ করেছি)
৪. পাবলিকেশন: পেপার, বই, ম্যাগাজিন এর যত ইলাস্ট্রেশন/কার্টুন/প্রচ্ছদ দেখেন সকল রুচিসম্মত ডিজাইন চারুকলার। একটা রেফারেন্স দিচ্ছি: যেই হুমায়ুন আহমেদের ১০-১৫টা বই আপনার বুক শেলফে পরে আছে, তার সবগুলোই ধ্রুব এষ নামে একজন শিল্পীর করা। তিনি একাই জীবনে ২৫ হাজার বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। তাহলে তার মত পাবলিকেশন সেক্টরে চারুকলার আরও যারা যারা আছে তারা ইতিমধ্যে এই সেক্টরের রাজা।
এবং নব্য লেখক যারা বই লেখেন, তারা চারুকলার ছাত্রদের বেছে নেয়।
প্রত্যেকটা চারুকলার ছাত্র তার জীবদ্দশায় কমপক্ষে ৫০-১০০ বই করেছে/করবে।
(আমি নিজে ইতিমধ্যে ১৫-১৬ টা বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছি)
আর, পত্রিকার কার্টুন সেক্টর, ডিজাইনিং সেক্টরের কথা আর নতুন করে কী বলব।
চারুকলা না থাকলে এই সেক্টরে রাতারাতি একটা ধ্বস নাম।
৫. ট্র্যাডিশনাল আর্ট: একটা দেশকে ছবির মাধ্যমে চিনতে কি লাগে? পতাকা?
উত্তর: না। সবাই সব দেশের পতাকা চেনে না।
তাহলে কি লাগে?
উত্তর: শিল্প। আমেরিকাকে ছবির মাধ্যমে চিনতে হলে হয় আপনাকে টাইম স্কয়ার দেখে চিনতে হবে নইলে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দিয়ে চিনতে হবে।
বাংলাদেশের ঢাকাকেও চিনতে হবে, সংসদ ভবন,শাপলা চত্ত্বর, দোয়েল চত্ত্বর, কার্জন হল কিংবা রাজু ভাস্কর্য দিয়ে।
অর্থাৎ একটা দেশের স্থাপনা শিল্প এবং ভাস্কর্য শিল্পই কেবল একটা দেশকে ভিজ্যুয়ালি চিনতে সাহায্য করে।
শিল্পের কোনো দাম যদি না থাকতো, তাহলে জাতীয় যাদুঘর ফাঁকা হয়ে যেতো। একদিন সময় করে যাদুঘর ঘুরে আসবেন। এবং চিন্তা করবেন, এগুলো কারা বানালো? এত বড় বড় পেইন্টিং কারা করলো? এত ভাস্কর্য কারা বানালো?
উত্তর: চারুকলার শিল্পীরা।
শিল্পের যদি দাম না থাকতো তাহলে ব্রিটিশ রা ইন্ডিয়া থেকে এত এত শিল্প চুরি করে নিয়ে যেতো না।
(আমি নিজে একজন ট্র্যাডিশনাল আর্টিস্টও। আমার প্রচুর পেইন্টিং আমি সেল করেছি। এবং জব লাইফের পাশাপাশি এই চর্চা এখনও অব্যাহত আছে।)
৬. ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট: বাংলাদেশে যদি ১ লক্ষ কোম্পানি থাকে, তাহলে তাতে অন্ততপক্ষে ১ লক্ষ ডিজাইনারও আছে।
এবং আপনি যদি টপ ২০টা কোম্পানিকেও চিনে থাকেন, চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নেবেন যে তাদের কোম্পানিতে চারুকলার জন্য এক বা একাধিক জায়গা রাখা আছে।
৭. টিভি অ্যান্ড ফিল্ম: বাংলাদেশে যে কয়টা টিভি চ্যানেল, সব চ্যানেলের লোগো চারুকলার শিল্পীর করা, আর লোগোর কথাই যদি বলি, তাহলে বাংলাদেশের পতাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো, ইত্যাদি সমস্ত উপরমহলের লোগোর কাজ নীলক্ষেতের লোগো আর্টিস্ট টা করে না। চারুকলার শিল্পীরা করে।
লোগোর মোশন ডিজাইন চারুকলার শিল্পীর, এবং সেখানেও ডিজাইনিং হেডে যিনি বসে আছেন, তিনি চারুকলার। এবং ফিল্মিং এর কথা আলাদা বলে লাভ নাই। কারণ, চারুকলার শিল্পী ছাড়া ফিল্মিং সম্ভবই না। আর, সম্ভব হলেও সেটার রেজাল্ট হলো সাকিপ খানের সিনেমা।
যত রুচিসম্মত ফিল্ম আছে, সেখানে চারুকলার শিল্পীরা ডিরেকশন/আর্ট ডিরেকশন কিংবা অন্ততপক্ষে স্টোরিবোর্ডিং এ কাজ করে।
(আমি প্রচুর শর্ট ফিল্ম ও এডভার্টাইজিং প্রোজেক্টে স্টোরিবোর্ডিং করেছি)
সুতরাং তারা না থাকলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তে ধস নামবে।
এমন আরও অনেক সেক্টর আছে।
সবই তো বেসরকারি ক্ষেত্রগুলোর রেফারেন্স দিলাম। এমন সরকারি ক্ষেত্রও প্রচুর আছে।
কয়টা বলবো?
প্রত্যেকটা সেক্টরেই আমার নিজের একটা রেফারেন্স দিয়েছি।
চারুকলার সবাই ঠিক একই ভাবে নিজের পার্মানেন্ট জবের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স ভাবে হলেও একাধিক সেক্টরে দেশকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তো এখন যদি মনে হয় যে চারুকলা কোনো লজিক্যাল সেক্টরে কাজে লাগছে না, তাহলে সুন্দর পোশাক পরা বাদ দেন।
ডিজাইন ও এনিমেশন করাও বাদ দেন। বইও ফ্ল্যাট মলাট দিয়ে পড়েন।
সকল সুন্দরের চর্চা বাদ দেন।
সাধাসিধা লাইফ লিড করেন।
যদি মনে হয়, চারুকলা একটা অকেজো সেক্টর, তাহলে তা বন্ধ করে দেয়াই ভালো।
আন্দোলন করে এটাকে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
বাংলাদেশ চারুকলা ডিজার্ভ করে না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন