পূর্ব রেলের এক কেরাণীর কর্মজীবনের শেষ দিন। সময়টা ১৯৬০, সহকর্মীরা এই ধরনের বিদায় অনুষ্ঠানে যে প্রশ্নটা বেশিরভাগই করে থাকেন সেদিনও সেই প্রশ্নটাই করলেন, দাদা, আপনার সুদীর্ঘ কর্মজীবনের এমন কোনো একটি অভিজ্ঞতার কথা আমাদের শোনান যা আপনি ভুলতে পারেননি। কেরাণী তার গল্প বলা শুরু করলেন।
সেদিন ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই। হাওড়া স্টেশনে সেদিন সাজো-সাজো রব, রেলের বড় কর্তারা ছুটোছুটি করছেন, পুলিশ একটি বিশেষ প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হওয়ার রাস্তা নিরাপত্তার জন্য ঘিরে রেখেছে। কী ব্যাপার?
বোলপুর থেকে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে স্পেশাল সেলুনগাড়ি হাওড়ায় এসে পৌঁছেছে। অসংখ্য সাধারণ মানুষ পুলিশের কড়া নজরদারির মধ্যে তাকে একটু দেখার চেষ্টা করছে। পুলিশ সেই ভীড় ঠেলে একটু পেছনে নিলেই তা আবার দ্বিগুণ সামনে চলে আসছে।
রেলের লোক হওয়ার সুবিধায় পুলিশের বাঁধা পেরিয়ে কোনোমতে দাঁড়ানোর একটা সুযোগ মিলে গেল ।
একসময় প্ল্যাটফর্মের ভেতর থেকেই হুডখোলা গাড়ি ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল অর্ধশায়িত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। মনে হলো তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন, চোখদুটি বন্ধ।
হঠাৎ কী হল, কেমন করে জানি না একটা বাচ্চা মেয়ে, ছয়/সাত বছরেরই বলা যায়। গাড়ির একেবারে কাছে চলে গিয়ে তার হাতের ছোট্ট খাতাখানি বাড়িয়ে দিয়ে কচি গলায় বলে উঠল, ‘আমাকে একটা সই দাও না।’
ঘটনাটা এত আকস্মিকভাবে ঘটল যে কে কী করবে তা ভেবে ওঠার আগেই দেখলাম রবীন্দ্রনাথ চোখ মেলে তাকালেন, তিনি ঘুমোননি, মেয়েটির কথা তিনি শুনতে পেয়েছেন। তার ক্লান্ত মুখে ক্ষীণ একটি হাসি ফুটে উঠল, তিনি হাত বাড়ালেন।
একজন সেই খাতা মেয়েটির হাত থেকে নিয়ে তার হাতে দিল, গাড়ির ভেতর থেকেই কেউ একজন কলমও দিল।
অভিভূত হয়ে দেখলাম তিনি কিছু না ভেবেই, তক্ষুনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে খাতায় কী লিখেই খাতাটি মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আবার হাসলেন, গাড়ি চলে গেল।
মেয়েটির হাতে খাতাটি তুলে দেয়ার আগে কর্তাদের ঠিক পেছনে থাকায় আমিও সে লেখা দেখতে পেলাম, তিনটি পঙ্ক্তিতে পাঁচটি মাত্র শব্দ। সে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না:
‘সই,
চাও সই?
তাই সই।‘
তথ্যসুত্র: বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন