যে দেশে একটি পুরস্কারের জন্য বিবেক বাজি রেখে দিনমান তেলাঞ্জলি দিয়ে চলে বুদ্ধিজীবীর দল; সেইখানে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরত পাঠালেন; এ খবরটা আসার পর সাধারণ মানুষ; যারা কখনও বুদ্ধিজীবী হতে চান না; তারা অকুন্ঠভাবে তাকে অভিনন্দিত করলো। আপোষের মজাপুকুরে নিরাপোষ দ্রোহ; তরুণদের মনে আনন্দ সঞ্চার করে। যাক বাবা এখনো এ সমাজে কারও কারও মেরুদণ্ড আছে তাহলে।
‘বিরোধিতা নয় কদমবুচি করতে এসেছি’-র আসরে যেখানে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সরকারি দলে ফিরে আসতে উন্মুখ; তাদের সান্ত্বনা দিতে বলতে হচ্ছে; এ টিমও আমার বি টিমও আমার, তোমরা ঘরের ছেলে ঘরেই থাকবে; শুধু সংসদে একটু সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে কেমন।
যেখানে সরকারের সবমতের সঙ্গে সহমত হওয়াই লাইফস্টাইল; যেখানে এপলজিস্ট বুদ্ধিজীবীরা গোলটেবিল করে একদলীয় শাসনের ফজিলত বোঝাতে ঘেমে নেয়ে একাকার; যেখানে একটি পদ-পদক-প্লটের জন্য পড়িমরি করে দৌড়াচ্ছে সবাই; সেইখানে জাকির তালুকদার! কে তুমি; বলছ ‘বাংলা একাডেমিতে গণতন্ত্র নেই!’
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বেশ অবাক হন। তিনি তো জানেন; এই যে এতোবছর আগে জন্মেছেন তিনি; কবিতা লিখছেন; তখন কোনো জন্মদিনে ব্যক্তিগত বন্ধুরা ছাড়া আর কেউ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়নি। অথচ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হতেই তার জন্মদিনে কবিরা কবিতা লেখে, কথা সাহিত্যিকেরা কত খেলিয়ে গুণগান করে, প্রাবন্ধিকেরা তার কবিতা কী কারণে একুশ শতককে গর্বিত করেছে তার জাস্টিফিকেশন লেখে রবার্ট ফ্রস্ট কিংবা টি এস এলিয়টের কবিতার সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করে।
যে সমাজে একটা বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য প্রবাসী সাহিত্যিকেরা ফরাসী সৌরভ নিয়ে আসে; দেশি সাহিত্যিকেরা নিয়ে আসে শাহবাগের ফুল; বর্ধমান হাউজের বারান্দায় ঢেলে দেয় সুরেশের খাঁটি সরিষার তেল; সেইখানে আবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরত দেয়া যায় কি!
এককালে মোজাফফর আহমেদ, বদরুদ্দীন ওমর কিংবা ওমর শামসের মতো একগুয়ে লোকেরা পুরস্কার প্রত্যাখান করেছিলেন। কিন্তু সে তো ছিলো মেরুদণ্ড যুগ; এখন এই অ্যামিবা যুগে এ কী করলেন জাকির তালুকদার!
কিন্তু যা হয়; অযুত প্রশংসার মাঝে ঠিকই সহমত ভাইয়েরা জাকিরের প্রতিবাদের লুপহোল নিয়ে হাজির হয়। কেউ প্যাঁচ মেরে বলে, দশ বছর আগে যখন পুরস্কার নিছিলেন, বাংলা একাডেমি কী তখন গণতান্ত্রিক ছিলো! তখন ঠিকই পুরস্কার নিছিলো; এখন ফিরিয়ে দিয়ে প্রশংসা নিচ্ছে; এসবই পাবলিসিটি স্টান্ট! সার্কাস!
গরুর মাংস বিক্রেতা ঢুকে পড়ে বিতর্কে। পুরস্কারের এক লাখ টাকা ফেরত দিতেছে কেন! দশ বছর আগে পাওয়া এক লাখ টাকা সুদে আসলে এখন কত টাকা হইবো তার হিসাব আছে কী!
মাংস বিক্রেতার বউ বলে, দশ বছর আগে বিয়া করনের সময় যে দেন মোহর ধার্য হইছিল; এখন ডিভোর্স হইলে কি সুদে-আসলে ঐ টাকা বাড়াইয়া দিবা আমারে?
আরেকটি অংশ আছে বিখ্যাত হতে চাওয়া কবি-সাহিত্যিক; তারা হচ্ছে দোজখের কড়াইয়ের কাঁকড়ার মতো। কেউ একটু সুনাম করে ফেললেই; তার ঠ্যাং ধরে নীচে নামাতে হবে! ঠিকই তারা জাকিরের সাহিত্যের দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করে; যেন নিজেরা এক একজন জর্জ অরওয়েল অথবা আলবেয়ার ক্যামু! তাদের নিজেদের সাহিত্যগুলো বুকার প্রাইজের জন্য অপেক্ষা করছে যেন!
কে একজন খুঁজে নিয়ে আসে জাকির তালুকদারের অতীত জীবনে ফেসবুকে করা ভুল মন্তব্যের রেফারেন্স, ঐ যে উনি বলছিলেন, ব্লগারেরা দেশের কাঁচা পায়খানা ফেলে বিদেশের পাকা পায়খানার লোভে রাজনৈতিক আশ্রয়ের চেষ্টা করছে।
বিপন্ন ব্লগারদের নিয়ে জাকিরের ঐ বক্তব্যটি কর্কশ ও অমানবিক ছিলো। তবে দেশে নিরাপত্তা নেই বলে পশ্চিমে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে যেসব সহমত ভাই ব্লগার বিদেশে বসে দেশের ক্রসফায়ার সমর্থন করে অমানবিক ভঙ্গিতে বলেছে, চলো অস্ত্র উদ্ধারে যাই; কিংবা ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টকে সমর্থন করেছে; সরকারের সমস্ত অগণতান্ত্রিক কাজের জাস্টিফিকেশন দিয়েছে কর্কশভাবে; তখন মনে হয়েছে; কাঁচা পায়খানা থাকে মনে। পাকা পায়খানা সেই মনের কোন রুপান্তর ঘটাতে পারে না।
আধাখ্যাঁচড়া মেট্রোপলিটানের গর্বে গর্বিত কেউ কেউ বলেছে, জাকিরের প্রতিবাদ নাটোরের মত ছোট শহরে বসে প্রতিবাদ। এ এক আজগুবি ছোট শহরের তকমাধর্মী বয়ান। মার্কেজের কথা কেউ কী কখনো বলেছে, বোগোতার মত ছোট শহর থেকে এসে উপন্যাস লিখছেন; মিলান কুন্ডেরাকে কি কেউ কখনও প্যারিসের লোকেরা বলেছে, আপনি চেকোশ্লাভাকিয়ার ছোট শহর থেকে এসে লিখছেন! হারুকি মুরাকামিকে কেউ কী তকমা দিয়েছেন, উনি ছোট শহর থেকে উপন্যাস লিখে নিয়ে তারপর টোকিওতে এসেছেন! সেইখানে কী এক বিরাট মেট্রোপলিসের গর্ব; ট্রাফিকে স্থিরচিত্র হয়ে থাকা; পিঁপড়ের মতো জনঘনত্বের অপ্রমিত উচ্চারণের উন্নাসিকতা।
আসলে নিজেরাও প্রতিবাদ করবে না; কেউ প্রতিবাদ করলেও তাকে দুধভাত ও গান্ধা করে দেয়ার পিঁপড়াবিদ্যা দিয়েই চলছে আত্মসমর্পিত মনস্ত্বত্বের এই ভ্যাড়ভেড়ে কালচার!
ভারতে নরেন্দ্র মোদির দুঃশাসনের প্রতিবাদে অসংখ্য লেখক শিল্পী কবি তাদের জাতীয় পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন; পাকিস্তানে সেনা স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে অনেক লেখক শিল্পী কবি তাদের জাতীয় পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। অন্তত ‘প্রত্যাখ্যান’ কালচারটা বুদ্ধিজীবী মহলে রয়েছে।
আর আমাদের মাথার খুলি ঘরে থুয়ে এ ওর গায়ে ঠেস দিয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধিজীবীদের কাছে পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়া একেবারেই ‘অসম্ভব এক কাজ।’ এখানে শুধুই সহমত বুদ্ধিজীবীর এ টিম ও বি টিম!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন