ট্রান্সজেন্ডার বিতর্ক: স্বৈরমনের সংঘর্ষ

৩৯৭ পঠিত ... ১৪:১৬, জানুয়ারি ২৫, ২০২৪

421327279_6998568703596828_4040178155353942854_n

দেশের শিক্ষা সম্পন্ন করে গ্লাসগোতে পড়তে যাওয়া হচ্ছে বিশ্বায়নের সূচক। কাজেই গ্লাসগোতে পড়ালেখা করে দেশে ফিরে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটিকে কেবল পশ্চিমা বিশ্বের বিষয় বলে জেদ ধরা অবাস্তব। ট্রান্সজেন্ডার বিতর্কের সূত্রপাতকারী আসিফ মাহতাব ও তার সমর্থকদের ট্রান্সজেন্ডার বিরোধী মনোভাবটি একটি স্বৈরাচারী মনোভাব।

আওয়ামী লীগ যেমন মনে করে সংসদে সরকারি দলে ও বিরোধী দলে থাকবে কেবল আওয়ামী লীগ; আসিফ মাহতাব তেমনি ভাবছেন, সমাজে কেবল তার পছন্দের লোকেরা থাকবে। সমাজে বৈচিত্র্যময় মানুষের ধারণাটিকে অস্বীকার করছেন তিনি। আওয়ামী লীগ যেমন স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’-র দোহাই দেয়, আসিফ তেমনি তার চিন্তার স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘ইসলাম ধর্মে’-র দোহাই দিচ্ছেন।

প্রকৃতিগতভাবেই নারী শরীরে পুরুষ মন ও পুরুষ শরীরে নারী মনের উপস্থিতি রয়েছে। একে মানসিক বিকৃতি বলে উড়িয়ে দেয়াটা; ভোটের অধিকার চাওয়াকে মানসিক বিকৃতি বলে উড়িয়ে দেবার মতোই স্বৈরদাবী।

পশ্চিমা সমাজ গণতান্ত্রিক বলেই; তারা ট্রান্সজেন্ডারের অধিকার স্বীকার করে। আর আমাদের সমাজ স্বৈরাচারি বলে পুরুষ শরীরে নারী মন থাকার পরেও একজন মানুষকে সারাজীবন পুরুষের অভিনয় করে যেতে হয়। তাতে বিপত্তি ও বিকৃতি আরও বিস্তৃত হয়। বাস্তবতা উপেক্ষা করে করেই আমরা বাস্তবকে আরো কঠিন করে ফেলি। হিউম্যান ট্র্যাজেডির পাহাড় গড়ে তুলি।

কাজেই আসিফ মাহতাব যে বৈশ্বিক চিন্তা থেকে পশ্চিমে পড়তে যান; সেই একই চিন্তা থেকে ট্রান্সজেন্ডারের মতো বৈশ্বিক চিন্তাকে স্বীকৃতি দিতে তাকে শিখতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলপাঠ হচ্ছে বৈচিত্র্যকে বুঝতে শেখা।

আমাদের পশ্চাদপদ জীনগত আশ্লেষে গণতান্ত্রিক হওয়া খুব কঠিন। এখানে গ্রামের মাতবরি প্রথা ও পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার খোয়ারি আমাদের প্রত্যেকের মনে রয়েছে। ‘গ্রাম্যতা’ শব্দটি গ্রামীণ থেকে আলাদা। গ্রামীণ হচ্ছে গ্রামের সুন্দর যা কিছু; নিসর্গ, সরলতা, উদারতা। গ্রাম্যতা হচ্ছে গ্রামের কুসংস্কার ও বদ অভ্যাসগুলো।

যেমন, কুসংস্কার হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার বাস্তবতাটিকে অস্বীকার করা। আর বদ অভ্যাস হচ্ছে, আসিফ ট্রান্সজেন্ডার বিতর্কের সূত্রপাত করেছে বলেই, তার ফেসবুক আইডি থেকে খুঁজে খুঁজে তার নারী বন্ধুদের ছবি বের করে ভাইরাল করা কিংবা তার আড্ডার টেবিলে মদের গ্লাস প্রদর্শন। তার মানে আসিফ যেমন জেন্ডার সেনসিটিভিটির অভাবে ভুগছে; তার সমালোচকেরাও একই রকম জেন্ডার সেনসিটিভিটির অভাবে ভুগছে। বিতর্কের বিষয় ছেড়ে ব্যক্তির প্রাইভেসিতে ঢুঁশ মারা ও তার নারী বন্ধুদের গণসাইবার ধর্ষণের আয়োজন করা যে গুরুতর অপরাধ; তা বুঝতে অক্ষম এরা।

ফলে এই সমাজে বৈশ্বিক কোন ইস্যু নিয়ে বিতর্ক হওয়া কঠিন। এতো গ্রাম্য মানসিকতা নিয়ে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুর পক্ষালম্বনও বেমানান। যার বেসিক কালচারাল এনলাইটেনমেন্ট ঘটেনি; সে কী করে প্রগতির কথা বলে!

আরেকটি গোষ্ঠীকে দেখলাম ‘রামমন্দিরের শিলান্যাস’ উদযাপন করে এসে; নিজধর্মীয় চিহ্ন প্রদর্শন করে; আসিফের দাড়ি ও তার নারী বন্ধুর হিজাব নিয়ে খাট্টা-তামাশা করছে। আচ্ছা বলেন তো জয় শ্রীরাম নিজেকে প্রগতিশীল দাবী করে নারায়ে তাকবির নিয়ে কী করে হাসতে পারে! এটা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব।

আবার উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন এসে যদি বলে, সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়; মানুষ জানে এটা নিত্যসত্য। কিন্তু কিম স্বৈরাচারি বলে; বেশিরভাগ মানুষ বলবে, সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয়। ঠিক তেমনি ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটি মানবিক ও নিত্যসত্য। কিন্তু যখনই আওয়ামী লীগের সহমত ভাইয়েরা ট্রান্সজেন্ডারকে সমর্থন করবে; তখনই সাধারণ মানুষ মানসিকভাবে এর বিরুদ্ধে চলে যাবে।

আমাদের দেশে আগে অনেক বন্যা হতো; হুট করে বানের জল ঘরে ঢুকে পড়ত বলে; আমাদের জেনেটিকসে গেলো গেলো গেলো রব তোলার ব্যাপারটা রয়েছে। তাই বিতর্ককে বিতর্ক হিসেবে না নিয়ে তা নিয়ে লংকাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা অযৌক্তিক।

সেই কাজটি ঘটলো আসিফের ‘বই ছেঁড়া’-র ভিডিও ভাইরাল হওয়াতে। বই ছেঁড়াকে অনেকে গুরুতর অপরাধ ভাবছেন। দেখবেন, ডেড পোয়েটস সোসাইটি চলচ্চিত্রে একজন শিক্ষক বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন। এটা একটা অভিব্যক্তি মাত্র।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আসিফের বিভাগীয় প্রধান যদি এই ভিডিও দেখে আসিফকে ডেকে কাউন্সেলিং করতেন; শরীফ-শরীফার গল্পের সমানুভূতির ও গণতান্ত্রিক দিকটি তুলে ধরতেন; তাহলে ঘটনা এতোদূর আসত না। বই ছেঁড়াতে তো পৃথিবী ভেঙে পড়েনি। কিন্তু যেহেতু আমাদের জেনেটিকসে আছে কাজের বুয়াকে ফোন করে বলে দেয়া, মরিয়মের মা তুমার আর কামে আওনের দরকার নাই। অথবা মজুরি বৃদ্ধি দাবি করলে গার্মেন্টস কর্মী ছাঁটাই নতুন পয়সাওয়ালার জেনেটিক আশ্লেষ। তাই ফোন করে বলে দেয়া হলো, আসিফ আপনার আর ইউনিভার্সিটিতে আসার দরকার নাই।

আসিফের ছাত্রদের প্রাথমিক ক্ষোভের জায়গাটি সহজেই অনুমিত। সে খুব সম্ভব শিক্ষক হিসেবে ভালো। নইলে এত ছাত্র এভাবে জমা হতো না। নিওলিবেরেল ও জয় শ্রীরামেরা অবশ্য এখানে ইসলামপন্থার ষড়যন্ত্র খুঁজবে। ওটা স্বৈরাচার চালিয়ে যাবার জন্য খুব উপাদেয়।

আসিফের ছাত্রদের এই ট্রান্সজেন্ডার বিতর্ককে কেন্দ্র করে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও আড়ং বয়কটের ডাক অযৌক্তিক। হযরত মিয়ার সঙ্গে মতের মিল হয়নি বলে তার মুদি দোকান বয়কট; এটা খুব প্রিমিটিভ চিন্তা। স্বদেশী পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধন অগ্রহণযোগ্য। ছাত্রদের যৌক্তিক সংলাপ ও বিতর্কে ব্রতী হতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী একজন সাবেক বিতার্কিক বলে দেখবেন, অত্যন্ত যুক্তিসংগত একটি মন্তব্য করেছেন ও ব্যবস্থা নিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা শরীফ-শরীফার গল্পটি পড়ে দেখবেন ও প্রয়োজনীয় সংশোধন আনবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জেন্ডার স্টাডিজের একটি সহজ শিক্ষা গ্রন্থ ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে সম্পৃক্ত করতে পারে। তাতে জেন্ডার সংক্রান্ত সামাজিক ভ্রান্তিগুলো ধীরে ধীরে সরে যাবার আশা করা যায়।

ট্রান্সজেন্ডার যেহেতু মানবিক সংকট; একে বিবেচনা করতে হবে গণতান্ত্রিক মন নিয়ে। আমরা কেউই যতক্ষণ নিজের সন্তানের জীবনে কোন ট্র্যাজেডি ঘটেনা ততক্ষণ পর্যন্ত তা অনুভব করতে পারি না। অন্যের সন্তানের বেদনা যেদিন বুঝতে শিখব; সেদিন আমরা সম্পূর্ণ মানুষ হব।

৩৯৭ পঠিত ... ১৪:১৬, জানুয়ারি ২৫, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top