ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের আগের নাম ছিল রূপসী বাংলা। তারও আগে নাম ছিল শেরাটন হোটেল, এবং প্রাচীনে ছিল ইন্টার কন্টিনেন্টাল। হোটেলের সামনে যে ভাস্কর্যটা রাখা আছে এর নাম রাজসিক। রাজসিক কথার অর্থ রাজকীয়। ভাস্কর্যটিতে একটি ঘোড়ার গাড়ি তার ভেতরে বসে রাজপরিবারের সওয়ারিবৃন্দ। গায়ে রাজকীয় আচকান, মাথায় মিয়া টুপি। সামনে চাবুক হাতে কোচোয়ান শপাং শপাং ঘোড়ার পিঠে মেরে চলেছেন। এই ভাস্কর্যটি মোগল, সুলতানি আর ব্রিটিশ ঢাকার রাজকীয় দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সময়কার ঢাকার কোচোয়ান তথা ঘোড়ার গাড়ির কথা বলতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান তাঁর 'স্মৃতির শহর' বইতে লিখেছেন, "তখন ঢাকা ছিলো কেমন ফাঁকা ফাঁকা। এত দরদালান ছিলো না, বাস ছিলো না, মোটর ছিলো না, এমনকি রিকশাও ছিলো না। পাড়ায় পাড়ায় ঘাস-বিচালির গন্ধ ছড়ানো আস্তাবল ছিলো, আর ছিলো ঘোড়ার গাড়ি। গাড়োয়ানের চাবুক ঝিকমিকিয়ে উঠত হাওয়ায়, রোদ্দুরে। কাছে-দূরে মজাদার শব্দ করে ঘোড়া ছুটত দিগ্বিদিক- খট-খট খট, গাড়োয়ান লাগাম নেড়ে বলত হাট হাট হাট।"
সেই সময় কোথাও যাওয়ার একমাত্র পরিবহন ছিলো ঘোড়ার গাড়ি। কাজেই একমাত্র গাড়ির ড্রাইভাররা ছিলেন যারপরনাই দেমাগী। ঢাকায় এক সময় সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে আমির-ওমরাহ আর নওয়াব- জমিদারদের আভিজাত্য প্রকাশ পেত। কোম্পানি শাসনামলে ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়। প্রথমদিকে বাহনটি শাসক শ্রেণি ব্যবহার করলেও পরে আস্তে আস্তে শহরের উচ্চবিত্তরা ব্যবহার শুরু করে। তবে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে ঢাকায় এটি গণপরিবহনে রূপান্তরিত হয়। যাত্রী পরিবহনের কাজে নগরীতে গড়ে ওঠে একটি কোচোয়ান শ্রেণি। এসব কোচোয়ানরা উর্দুতে কথা বলত এবং তারা ছিলো বেশ রসিক।
ঢাকায় দুই ধরনের কোচোয়ান বা ঘোড়ার গাড়ি ছিলো। ঠিকা ও ব্যক্তিগত। ঠিকা গাড়ির কোচোয়ানরা প্রায়ই ঢাকায় আগত যাত্রীদের বিপদে ফেলে বাড়তি ভাড়া আদায় করত। তবে নবাব পরিবারের কোচোয়ানরা ছি্লো খুবই ভদ্র। বেশ পরিপাটি পোশাক, বনেদি হালচাল। তবে গণপরিবহনের কোচোয়ানরাও যাত্রী আকৃষ্ট করতে রঙিন জরিদার জামা পরে থাকত। নবাববাড়ির কোচোয়ানদের সমাজে বেশ মর্যাদা ছিলো।
উনিশ শতকের শেষদিক থেকে স্কুলে ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্যও ঘোড়াগাড়ি ব্যবহার হতে শুরু হয়। অভিজাত পরিবারের সন্তানরা ঘোড়াগাড়ি করে স্কুলে যাতায়াত করলেও ইডেন স্কুলের সাধারণ ছাত্রীদের জন্যও এই গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়।
সময়ের ব্যবধানে ঢাকার রাজপথ বর্তমানে মোটরগাড়ি আর রিকশার দখলে। এরপরও ঘোড়ার গাড়ি ঢাকার রাস্তা থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ১০-১২টি টমটম যাত্রী বহন করছে। এর বাইরেও সিদ্দিকবাজার, চানখাঁরপুল, আলাউদ্দিন রোড প্রভৃতি এলাকায় আরও ২০-২৫টি ঘোড়ার গাড়ি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিয়েশাদি ও পণ্যের প্রচার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে আলাউদ্দিন রোডের নাজির কোচোয়ানের গাড়ি হচ্ছে নামকরা। ভেটেরিনারি হাসপাতালের সামনে গেলেই লুঙ্গি পরা ভুঁড়িওয়ালা নাজির কোচোয়ানের দেখা মিলবে। জায়গার দূরত্ব বুঝে ভাড়া হাঁকেন নাজির কোচোয়ান। যদিও তিনি নিজে এখন আর গাড়ি চালান না। তবে ঢাকার মধ্যে একদিনের জন্য সাধারণত ৫,০০০ টাকা নিয়ে থাকেন তিনি।
তথ্যসূত্র: ঢাকার প্রাচীন পেশা ও তার বিবর্তন, ইমরান উজ জামান
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন