কোলাবরেটর বনাম উবারম্যান: স্বদেশ বাস্তবতা

১৬১ পঠিত ... ১৭:২০, নভেম্বর ২০, ২০২৩

5

গোটা পৃথিবীতেই দেশে দেশে শাসক গোষ্ঠী ও সাধারণ নাগরিক; দুটো আলাদা এনটিটি। শাসকের ধর্ম শাসন-ত্রাসন-সংহার আর নাগরিকের ধর্ম যেন নিপীড়িত হওয়া। জগত জোড়া সাধারণ মানুষের মাঝে যেন ঐক্য গড়ে না ওঠে; এজন্য খল-শাসকেরা উগ্রজাতীয়তাবাদ ও উগ্রধর্মবাদ প্রচার করে। শাসকের এই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ প্রচারের জন্য দেশে দেশে বিদূষক বা কোলাবরেটর তৈরি হয়। এদের কাজ সারাক্ষণ ঘৃণা প্রচার; ঘৃণার বিনিময়ে প্লট-পদক-পদবী জোগাড়। কারণ ঘৃণা প্রচারে যার দক্ষতা যত বেশি; শাসকের কোলাবরেটর হিসেবে সে তত এগিয়ে।

জাত শিল্পী প্রকৃতির লোকেরা এই ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসার বারতা প্রচার করে গানে গানে। সে কারণেই নদীপথে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে একসময় বাউল ও সূফি গান পরিবাহিত হয়েছে। ভাষা আলাদা কিন্তু বাণী একই, সুর একই; কারণ বাউল ও সূফিরা নদীপথে নৌকায় চড়ে দক্ষিণ এশিয়ার জনপদগুলোতে ভালোবাসার বারতা প্রচার করেছিলো।

কৃষিনির্ভর এই বিশাল জনপদের মানুষের জীবনে তখন সমৃদ্ধি ছিলো, সুখ ছিলো। পথে কোন ভিক্ষুক ছিলো না।

বৃটিশেরা উপনিবেশ স্থাপনের পর; ধর্মের ভিত্তিতে উপমহাদেশের মানুষদের পৃথক করে ফেলার কাজ শুরু করে। অল্প কিছু সংখ্যক কোলাবরেটরকে জমিজমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী দিয়ে কৃষককে ভূমিহীন বানানোর খলপ্রক্রিয়া শুরু করে।

বলাই বাহুল্য, যারা বৃটিশের কোলাবরেটর হিসেবে ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলো; তারাই রায় বাহাদুর ও খান বাহাদুর পদবী জিতে নেয়।

মধ্যস্বত্বভোগী দালাল প্রকৃতির লোক; যার পরিশ্রম করে খাওয়ার জো নেই; সেই তো কোলাবরেটর হয়।

১৭৯৩ সালের লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী পূর্ব বঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশে নতুন জমিদার শ্রেণী তৈরি করেছিলো। এরা সেসময় গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগের সহমত ভাই হয়ে স্লামডগ বিলিওনিয়ারদের মতোই স্লামডগ কোটিপতি হয়ে ওঠে। পূর্ববঙ্গের কৃষক পীড়ন করে; তাদের শ্রম শোষণ করে, পূর্ব বাংলার সম্পদ লুট করে কলকাতায় গিয়ে সেকেন্ড হোম গড়ে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিক, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক যেরকম বাংলাদেশের সম্পদ লুট করে পশ্চিমে সেকেন্ড হোম করেছে। বৃটিশের কাছে একটু সাহেবি কেতা শিখে কর্নওয়ালিশের সহমত ভাই জমিদারেরা পূর্ব বঙ্গের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে শুরু করে। সমৃদ্ধ একটি জনপদের মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দিতে শুরু করে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মেহনতি মানুষেরা; যারা স্বশিক্ষিত-দার্শনিক বোধের উতকৃষ্ট মানুষ ছিলেন, তাদেরকে ‘হীন মানুষ আখ্যা দিয়ে’ একটি বৃটিশ কোলাবরেটর নিও এলিট বা ফিলিস্টাইন্স গ্রুপের বিকাশ ঘটতে থাকে। হিন্দু-মুসলমান বিভাজন সৃষ্টি করে মনগড়া ইতিহাস আর সাহিত্য নির্মাণ চলতে থাকে।

পূর্ববঙ্গে শেরে বাংলা ও মওলানা ভাসানির রাজনীতি ছিলো কৃষক-প্রজার স্বার্থে। তারা মানুষকে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন কৃষক হিসেবে। তারা জনমানুষকে সঙ্গে নিয়ে বৃটিশ কোলাবরেটরদের জমিদারী ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চেয়েছেন।

পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাব এলে; পশ্চিমবঙ্গের সেকেন্ড হোমে বসবাসকারী বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদারেরা পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যৌথতায় বাংলা নামে পৃথক একটি রাষ্ট্রগঠনে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা সে সময়ের যে ছবি পাই; তাতে দেখা যায়, কংগ্রেস নেতারা বলছেন, ‘কলকাতাটা আমাদের চাই।‘

ফলে পূর্ববঙ্গকে জুড়ে দেয়া হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে। ভারতের পূর্বপ্রান্তে পূর্ববঙ্গ; আর পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তান; এরকম আজগুবি রাষ্ট্রের কথা কেউ কী কখনও শুনেছে! বৃটিশ কোলাবরেটর হিন্দু জমিদারদের উপনিবেশ থেকে মুক্তির আকাংক্ষায় পূর্ববঙ্গের সরল মানুষেরা গিয়ে পড়ে পাঞ্জাবের বৃটিশ কোলাবরেটর মুসলমান জমিদারদের উপনিবেশের থাবায়। সেই যে একসময় রায় বাহাদুরেরা পূর্ববঙ্গের কৃষক প্রজাকে যেভাবে লুট করেছিলো; খান বাহাদুরেরা একইভাবে লুট করতে শুরু করে পূর্ববঙ্গের সম্পদ। সেই যে কট্টর হিন্দু জমিদারেরা  পূর্ববঙ্গের সম্পন্ন ও স্বশিক্ষিত ‘উবার ম্যান’-দের যেভাবে হীনমানুষ বলে তুচ্ছ করেছিলো; একই কাজ শুরু করে পাঞ্জাবের কট্টর মুসলমান জমিদারেরা।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানের খপ্পর থেকে বের হবার প্রাণপণ লড়াই করে পূর্ববঙ্গের মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের সেকেন্ড হোমের ভগ্ন জমিদারদের মনে আবার পূর্ববঙ্গের জমিদারি ফিরে পাবার স্বপ্ন উঁকি দেয়। তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানের খুনে সেনার গণহত্যার বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম করে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন মানচিত্র ও পতাকা জিতে নেয়। এই যুদ্ধে ভারতের সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন ছিলো মানবিক ও ভালোবাসাময়।

শেখ মুজিবের অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কারণে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অপেক্ষাকৃত সফিস্টিকেডেড দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলে; যা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বাজপেয়ী ও ড মনমোহন সিং তাদের সফিস্টিকেশনের কারণে পররাষ্ট্রনীতির প্রফেশনালিজম ধরে রাখেন।

কিন্তু প্রণব মুখার্জি তার ‘কোয়ালিশন ইয়ারস’ গ্রন্থে দ্বিতীয় লর্ড কর্ন ওয়ালিশ হয়ে ওঠেন যেন। তিনি স্পষ্ট করেই লিখেছেন, ওয়ান ইলেভেন সরকারের জেনারেল মইন উ-কে ডেকে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর বন্দোবস্তী দেন তিনি। কংগ্রেস নেতা হলেও শেষ জীবনে শিবসেনা মন্দিরে গিয়ে মি মুখার্জি তার কট্টর হিন্দু আত্মপরিচয়কে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে সফিস্টিকেশন হারায়। নরেন্দ্র মোদীর উত্থানে হিন্দু ভারত রচনা শুরু হলে; বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ভারতকে স্বামী হিসেবে বরণের ঘোষণা দেন। যতদিন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো; ততদিনই তাতে সুষমা ছিলো। বিজেপি ও আওয়ামী লীগের কথিত বিবাহের পর; দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। কারণ অনলাইনে কলকাতার ভগ্ন জমিদাররা আবার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে শুরু করে, পূর্ববঙ্গের উবারম্যানদের।

দার্শনিক ফ্রিডরিশে নিটশের ‘উবারম্যান’ হচ্ছেন শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা পেশীবহুল কৃষক, নান্দনিক মসলিন বয়ন শিল্পী, উত্তাল নদী ও সমুদ্রের পেশীবহুল জেলে, বাউল ও সূফি গায়ক, গ্রামের ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দেয়া পলান সরকার, সারাজীবন বৃক্ষরোপণ করে চলা কোন প্রকৃতিপ্রেমিক, জনগণের স্বার্থে জীবন দেয়া মুক্তিযোদ্ধা আর একালের নূর হোসেনেরা।

যেমন খুশি ইতিহাস রচনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের হিন্দু ভারত প্রকল্পে; বাংলাদেশে তৈরি হয় নতুন কোলাবরেটর। এই কোলাবরেটর গ্রুপটি বিজেপি ‘প্রগতিশীলতা’র ঝাণ্ডা নিয়ে দৌড়াতে থাকে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের জমিদার ও জমিদার গিন্নীর মতো পোশাক পরে; ভ্রান্ত অধ্যাসে স্লামডগ মিলিওনিয়াররা দৌড়াতে থাকে নিজেদের কাল্পনিক নিও এলিট ভেবে। কিন্তু আচার আচরণে ধরা পড়ে যায় কোন ক্ষেতের মূলা।

বাংলাদেশের কোন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ তার গৃহে অতিথি সেবা করে পরে খোঁটা দেয় না, তোমাকে এই খাওয়ালাম, সেই খাওয়ালাম। কিন্তু নেহাত পরিশ্রম বিমুখ পার্টির অনুগ্রহে নতুন ধনী হওয়া লোকেরাই এরকম খাওয়ার খোঁটা দিতে পারে। এর উদাহরণ আমরা ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ প্রসঙ্গে দেখেছি।

ভারতের কোন নাগরিক কক্ষনও কাউকে খাইয়ে পরে খোঁটা দেয়া প্রকৃতির নয়। কারণ ভারতের মানুষের সঙ্গে আমার কয়েক দশকের বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা আছে। তা থেকে এটুকু বুঝি, তারা ওয়ান্স ফ্রেন্ড অলওয়েজ ফ্রেন্ড প্রকৃতির। তারা মোদীর বাংলাদেশনীতিকে অপছন্দ করেন।

বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকের ভুলের জায়গাটা হচ্ছে ভারতের শাসক গোষ্ঠী ও বাংলাদেশে তাদের কোলাবরেটরদের সঙ্গে ভারতের সাধারণ মানুষকে গুলিয়ে ফেলা। মনে রাখা প্রয়োজন, সাধারণ নাগরিক দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে নিগৃহীত। আর ক্রীড়া-সঙ্গীত-কবিতা-চিত্রকর্ম; যা কিছু ভালোবাসার ও সমন্বয়ের; তার কোন ভূগোল থাকে না।

এই যে বাংলাদেশের সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদাদের সিপি গ্যাং সবাইকে শিখিয়েছে, সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতি মিশাও; এ হচ্ছে তাদের ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রকল্পের প্রচারণা। তারা পাকিস্তানের একাত্তরের খুনে সেনাদের সঙ্গে সেখানকার সাধারণ মানুষকে এক করে দিয়ে গালি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে। এমেরিকা বাংলাদেশের স্বৈরাচারি সরকারের ওপর স্যাংশন দেবার পর এমেরিকার শাসক ও সাধারণ মানুষকে এক করে দেখে গালি দিতে শিখিয়েছে। এই ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে শ্রীলংকার সাধারণ মানুষকে গালি দিতে শিখিয়েছে।

 নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী; প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ায়; ক্রিকেটে ভারতের পরাজয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ উল্লাস করায়; সেই যে হরিদাসপুরের হরেন ও ঠোঁটা বাজারের হাশেম এসে খোঁটা দিচ্ছে, ভারতের পেয়াজ খেয়েছো, ভারতের পরাজয়ে কাঁদছো না কেন; হরিদাসী এসে পয়েন্ট এগিয়ে দেয়, ভারতে গিয়ে যে হার্টে রিং লাগিয়ে  এসেছো; ঐটা খুলে দাও; আকলিমা নদী নতুন শেখা ইংরেজিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হিপোক্রেট, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।

এই যে এতো লোক সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউইয়র্কে গিয়ে হার্টের রিং পরিয়ে আসে, কোনদিন কোন জোনাথন বা সোফিয়াকে বলতে শুনেছেন, ঐ আমাদের সমালোচনা করছো কেন, হার্টের রিং খুলে দাও।

এই জায়গাতেই মনের দৈন্য স্পষ্ট হয়; বোঝা যায় কোন কাননের ফুল; কীভাবে নিও এলিট সেজে এরা লুকিয়েছে গওহরডাঙ্গার ডেড বেগারস সোসাইটির আত্মপরিচয়কে।

এইসব কোলাবরেটর সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদা অনলাইনে যা কিছু শিখিয়েছে; তা আনলার্ন করতে হবে। মোদীর কট্টরপন্থার প্রতি বিদ্বেষ, বাংলাদেশে স্বৈরাচার সমর্থনের ভিলেজ পলিটিক্স থেকে কসমোপলিটান ইন্ডিয়ার নাগরিক সমাজকে আলাদা করে দেখতে হবে।

আমাদের নিজেদের ছেলেরা যেখানে এমপি হওয়ার চিন্তায় মাঠে খেলতেই পারে না; সেখানে পাশের বাড়ির ছেলেগুলো কী নিরলস দক্ষতায় ক্রিকেট খেলেছে; অপরাজিত থেকে ফাইনালে পৌঁছেছে; সেইখানে তাদের পরাজয়ে উল্লাসের কিছু নেই। যাদের নিজের ছেলেরা ক্রিকেট ব্যাট ফেলে রাতের ভোটে ‘জিতবে এবার নৌকা’ করে বেড়ায়; কী করে এইসব সহমত ও শিবব্রতের বিষে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ক্রীড়া-বিজ্ঞানের বাতিগুলো নিভে যাচ্ছে; সমাজ প্রবেশ করছে লুন্ঠনের নেশায়, খুনের রিসংসায়; সেগুলো নিয়ে চিন্তিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যের অমঙ্গল প্রত্যাশা নয়; আমাদের কাজ করতে হবে সামষ্টিক মঙ্গলের স্বার্থে। দলান্ধতা, ধর্মান্ধতা ও ঘৃণান্ধতার বিষমুক্ত সমাজ গড়তে না পারলে; আমাদের বাংলাদেশ স্বপ্নটি অস্নাত-অভুক্ত-অতৃপ্ত রয়ে যাবে।

১৬১ পঠিত ... ১৭:২০, নভেম্বর ২০, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top