সিরিয়াস বাঙালির সুখী হবার টোটকা

১৭১ পঠিত ... ১৭:০৪, অক্টোবর ১৪, ২০২৩

Sukhi-hobar-totka

এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরুর দিনে আহমেদাবাদ স্টেডিয়ামে দর্শক ছিলোনা। ফ্রি টিকেট দিয়ে কিছু মহিলা দর্শককে আনা হয়েছিলো। তারা বেরিয়ে যাবার সময় সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে, চলে যাচ্ছেন কেন! তারা বলেন, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বলে ডেকেছিলো। এখন দেখছি গোরা সাহেবরা খেলছে।

বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ঘনাদা ও ট্যাপাদা ঢাক ঢোল ও কাসর নিয়ে স্টেডিয়ামে যান ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হলে। এবার ধর্মশালায় পাকিস্তান-শ্রীলংকা ম্যাচের দিন দেখি ঘনাদা ও ট্যাপাদা স্টেডিয়ামে। লক্ষ্য করলাম, এরা পাকিস্তান টিমকে সাপোর্ট করছে।

আমি অবাক হইনি। কারণ পাকিস্তানে দাড়ি-টুপিওয়ালা লোককে ভারত টিমকে সাপোর্ট করতে দেখেছি। ক্রীড়া সাংবাদিকরা পরে খুলে বললেন ব্যাপারটা। এরা আসলে অন্যটিমের সঙ্গে খেলায় ভারতকে সাপোর্ট করে; যাতে তারা ফাইনালে যেতে পারে। সেইখানে ভারত-পাকিস্তান খেলা হয়।

পাড়াতেই দুটো শক্তিশালী ক্রিকেট টিম বানাতে বিলেত থেকে পাশ থেকে ফেরা স্বদেশীরা এ দুটি দেশ সৃষ্টি করেছিলেন বলে মনে হয়।

ভারত-পাকিস্তান শত্রুতার মিথ বেশিরভাগই মিডিয়ার সৃষ্টি। উত্তর-পশ্চিম ভারতের লোক ঝগড়া করতে পারেনা একেবারেই। তারা উত্তেজনার মুহূর্তে যা বলে; একটু পরে তা ভুলে যায়। পাকিস্তানের লোকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। কোন ঝগড়া কেউ মনে নিয়ে বসে থাকে না। ভারতের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণের ও পাকিস্তানের লোকের ডিকশনারিতে অভিমান শব্দটি নেই।

এ কারণে ক্ষমতায় কংগ্রেসই থাকুক আর বিজেপিই হোক; পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজনীতিক, সাংবাদিক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এ যাবতকালের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি কাশ্মীরটাকে স্বাধীন রাষ্ট্র করে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ মনমোহনের সিদ্ধান্তের ওপর কথা বলার মতো লোক ছিলেন না। সেইখানে বাধ সেধেছিলেন প্রণব মুখার্জি। তিনি মনমোহনের পাঞ্জাবির কোণাটা চেপে ধরেছিলেন, আর গালে সুপোরি পুরে বলেছিলেন, খবরদার পাকিস্তান সফরে যাবেন না।

কারণ প্রণব জানতেন ক্ষমতায় একটু পরে মোদী আসবেন; আর মোদী এলেই তিনি শিবসেনা মন্দিরে প্রসাদ দিয়ে হিন্দু ভারত রচনার প্রার্থনা করবেন।

বাঙালি সতত গানের কবিতার সুরের মানুষ। কিন্তু তার মধ্যে অভিমান বা লালরাগ থাকে। সে একবার কারো সঙ্গে ঝগড়া হলে সারাজীবন প্রতিশোধের সংকল্প নিয়ে ঘোরে। প্রণব মুখার্জি বিয়ে করেছেন পূর্ব বঙ্গে। এ এক রাজযোটক। অভিমানের মনিকাঞ্চন যোগ।

আর আমাদের শেখ হাসিনাই ধরুন। সময় সময় মনে হবে তাঁর চেয়ে ভালো মানুষই হয়না। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি তিক্ত স্মৃতি মনের মধ্যে চর্চা করে চলেন। ঐ যে রেড এংগার বা অভিমান।

কলকাতায় যারা সেই ডিরোজিও-র ইয়াং বেঙ্গল মুভমেন্টে বখে গিয়েছিলেন, তারা আবার অত্যন্ত হাসিখুশি মানুষ। রাগ বলে কোন বস্তু তাদের মধ্যে নেই। কিন্তু একটু যারা ধর্মের ঘেরাটোপে গোঁড়াভাবে রয়ে গেলেন; তারা জাত-পাত; জাত্যাভিমান নিয়ে চিন্তা করে কপালে ভাঁজ ফেলে দিলেন।

অমিত ট্যান্ডন নামে এক পাঞ্জাবি স্ট্যান্ড আপ কমেডি অভিনেতা আছেন। তিনি তার নিজের জীবনে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে ভুল করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কী রান্না করতে পারেন! যথারীতি মেয়ে আর বিয়েতে রাজি হয়নি। অমিত মজা করছিলেন, ভাগ্যিস মেয়েটি পাঞ্জাবের ছিলো; তাই অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। বাঙালি মেয়ে হলে আমার এই প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে ব্লগ লিখে ফেলতো।

একটি বাক্যে অমিত বাঙ্গালির হাইসিরিয়াসনেস ও রেড এঙ্গার চিত্রায়িত করেছেন।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার স্টোরি আমি বিশ্লেষণ করি বন্ধুদের অনুরোধে তাদের টিভি কিংবা সংবাদপত্রে। কিন্তু আমি একে গুরুত্ব দিইনা। নরেন্দ্র মোদী যেদিন হঠাত আবেগ প্রবণ হয়ে বিমান ঘুরিয়ে লাহোরে নওয়াজ শরিফের বাসায় পৌঁছে যান; দুজন বেশ নেহারি খেতে খেতে সুখ-দুঃখের আলাপ করেন; আমি তাদের রাজনীতিটা ধরে ফেলি।

নেহাত রিপাবলিক টিভির অর্ণব গোস্বামীকে দিয়ে মোদীজি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার থিয়েটার মঞ্চস্থ করে চলেছেন। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক ক্রোধ মৌলিক; তাই অর্ণব একাই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেন। অথচ তা নিয়ে মোদীজি মুখ টিপে হাসেন।

কারণ উত্তর প্রদেশে জামায়াতে ইসলামী বিজেপির আদিত্য নারায়ণের নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। ভারতে অবস্থাপন্ন মুসলমানদের গায়ে হাত তোলার সাহস কারো নেই। ভারতে দরিদ্র মুসলমান নিঃগৃহীত হয়। সে কিন্তু দরিদ্র হিন্দুও নিঃগৃহীত হয়। দারিদ্র্যের জন্মই হয়েছে যে নিগ্রহের লক্ষ্য হতে।

মোদীজী যেহেতু অর্থনৈতিক সংস্কার ও সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন; তাই এন আর সি'র হুজ্জোতি করে হিন্দুইজমকে নাতসি চেহারা বা জায়নিস্ট চেহারা দিতে চেষ্টা করেছেন।

ওদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যেহেতু অকর্মণ্য; কোন একটা কিছু করে নিজের গুরুত্ব ও বাজেট ধরে রাখতে হবে তাই ইসলামিজমের ঝান্ডা উড়িয়ে বেশ একট বাহুবলী চেহারা নিয়ে ঘোরে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ধরুন পেটমোটা বীর কিন্তু শখ তার মোসাদ হবার। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাও পেটমোটা বীর কিন্তু শখ তার সিআইএ হবার। কিন্তু কার্যত এরা অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক লোকজন।

ফলে বীরত্ব দেখানোর একমাত্র জায়গা ক্রিকেট। ছোটবেলা থেকে হাডুডু-কুস্তি খেলে অভ্যাস ভারত-পাকিস্তানের লোকজনের। অথবা মোরগ লড়াই দেখে বিনোদনহীন জীবনে বিনোদন আনার চেষ্টা তাদের। কিন্তু এটুকু তারা জানে, খেলাটা খেলাই।

অথচ ফেসবুকে, খেলার নিউজলিংকে দেখবেন, ক্রিকেট নিয়ে ঝগড়া শুরু করে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু লোক ইতিহাস-ভূগোল হয়ে বাপ-মায়ে চলে যাচ্ছে। শিং ঘষছে স্পেনের ম্যাটাডোরের ঝাঁড়ের মতো।

আবার রাজনৈতিক আবহে দেখবেন বাংলাদেশে ক্ষমতায় সেকুলার দল আওয়ামী লীগ; পশ্চিমবঙ্গে মহা সেকুলার তৃণমূল কংগ্রেস। তার মানে বাঙ্গালির লাল রাগ- অভিমান; এগুলো কোনকিছুতে অনূদিত হয়না। নিজেই নিজের প্রেশার বাড়িয়ে ডায়বেটিস বাধিয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকে একটা বয়সের পর; আর তিক্ত স্মৃতিচারণ করে।

এই যে রেগে যাওয়া; অভিমানে গাল ফুলিয়ে দূরে থাকা; একটা কোকুনের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখা; এইসব বদ অভ্যাসের কারণে ১৯৪৭ সালের জমি ভাগাভাগির মেহেফিলে বঞ্চিত হয়েছে বাঙালি।

বাঙালি কেউ রবীন্দ্রনাথ-অমর্ত্য সেন-ইউনুস হলেও সেটা সহ্য করতে পারে না। তপন রায় চৌধুরী বাঙ্গালির ঈর্ষাকে তার জীনগত বলে বর্ণনা করেছেন। নীরদ সি চৌধুরী "আত্মঘাতী বাঙালি" বলায় উনাকে গালি দিয়ে ভূত ছুটিয়ে দিয়েছে। এইজন্য আমার মনে হয়, গালিতে বাঙ্গময় যে সেই বাঙালি। অথচ খুশওয়ান্ত সিং অবাঙ্গালিদের নিয়ে যে রসিকতাটা করেছেন তার কোন সীমা পরিসীমা নেই।

আসলে প্রয়োজনের বেশি সিরিয়াস হওয়ায় ও নিয়ত টেনশন করায়, বাঙ্গালির অনেক যোগ্যতা থাকার পরেও; পারফরমেন্স ভালো হয় না।

একটু হাসতে শিখলে; জীবনটাকে কেঁদে ভাসিয়ে না দিয়ে হেসে উড়িয়ে দিতে শিখলে; তবেই চির অসুখী বাঙালি সুখি হতে পারবে বলে মনে হয়।

১৭১ পঠিত ... ১৭:০৪, অক্টোবর ১৪, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top