বাঙালির নাম বদলের বীরত্ব

৩০১ পঠিত ... ১৬:৪৬, মে ০২, ২০২৩

Naam-ta

মহাখালীর অদূরে একটা দ্বীপমতো জায়গা ছিলো। সভ্য মানুষ সেখানে যেতো না। সত্তর দশকেও সেখানকার বনে বাঘ চড়তো, নাজির হোসেন সাক্ষী। গরীব কৃষকেরা চাষবাস করতো। জায়গাটার নাম ছিলো ভোলা। জহুরুল ইসলাম সেই গ্রামে আবাসন করলেন। করাচীর অভিজাত এলাকা গুলশানের অনুসারে সে জায়গার নাম হলো ‘গুলশান’। ডিআইটির চেয়ারম্যান মাদানি সাহেব সেই জঙ্গল সাফ করে সাজালেন নতুন করে। গুলশান আজ সত্যিই অভিজাতদের বাসস্থল, ভোলার নাম ভুলে গেছে সবাই। মাদানী সাহেবের নামেও সড়ক আছে।

আবার এখন যেটা ভোলা, বরিশালের কাছে... তার পুরনো নাম আবার শাহবাজপুর! ভোলাগঞ্জের মানচিত্র আবার ভিন্ন।

এখন যেটা উত্তরা, বিরাট শহর... তার নাম ছিলো বাইলজুরি। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া আর কিছুই সে নাম বহন করে না এখন আর। আশেপাশে আছে আরো কতো কতো নামের জায়গা; রানাভোলা, পঞ্চবটী, বৃন্দাবন... এগুলোও হারিয়ে যাবে ‘সেক্টর এতো’এর আড়ালে। যেভাবে হারিয়ে গেছে আরো অসংখ্য নাম; যেগুলোকে এখন আমরা সেক্টর ১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদি নামে চিনি। ঠিক একইভাবে আমরা এখন নিকেতন চিনি, বসুন্ধরা আবাসিক চিনি, আফতাবনগর চিনি, পিঙ্ক সিটি চিনি, নাভানা নগর ভ্যালি চিনি, রাকিন সিটি চিনি... এরকম আরো অসংখ্য কর্পোরেট নামের আড়ালে হারিয়ে গেছে পুরনো নামগুলো। ইছাপুরা হয়ে গেছে বনানী। এই যে বিশাল ‘পূর্বাচল’হচ্ছে; এর আড়ালে হারিয়ে যাবে আরও কতো শতো জায়গার নাম! ইয়ত্তা থাকবে না।  

পুরনো শ্রীহট্ট আউলিয়ার আগমনে বদলে গেলো জালালাবাদে বা সিলেটে। ঢাকা নিজেই জাহাঙ্গীরনগর হয়ে আবার ঢাকায় ফিরেছে। এঁদো গ্রামগুলো আইউবনগর হয়ে শেরেবাংলায় ঠেকেছে। পালংকী বা ফালকিন গোড়াসাহেব হিরাম কক্সের নামে কক্সবাজার হয়ে গেলো। পেন্টাপোলিশ, পোর্ট গ্র্যাণ্ড, সাত আল-গুঞ্জ বা শাতিলগঞ্জ, ইসলামাবাদ ইত্যাদি বহু নাম পেরিয়ে চট্টগ্রাম থিতু হয়েছে। জয়দেবপুর বদলে গাজীপুর হয়েছে, জয়দেবপুরও বিদ্যমান। বাউলার চর নিঝুম দ্বীপ হয়ে গেছে বলে ভবিষ্যতে মানুষ মনে করবে নিঝুম মজুমদারের কারনেই বুঝি এ নাম হয়েছে! যেমন অনেকে ভাবে ইন্দিরা রোডের নাম হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর নামে! আর ভাবে ইন্দিরা বুঝি বাপুজী গান্ধীর কন্যা!

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সিরাজের নামে হৃদের নাম রাখা হলো শহীদ সিরাজ লেক। পাকনা পর্যটকদের সেটা পছন্দ না, তারা সেলফি তুলে চেকইন দেয় নিলাদ্রী লেক নামে। ওদিকে হরিকেল হয়ে যায় রাঙামাটি আর বিক্রমপুর হয় মুন্সীগঞ্জ। আমরা যাকে গণ্ডমূর্খ বলি, সেই গণ্ডদের বাস ছিলো বলে জায়গাটার নাম হয়েছিলো গণ্ডোয়ানাল্যান্ড। এখন আর তারা গণ্ডমূর্খ না, তাই জায়গার নাম বদলেছে দিনাজপুর হয়ে। ওদিকে গণ্ডোয়ানাল্যান্ড আবার সেই অতি প্রাচীন এক ভীষণ মহাদেশ, যা ভেঙে তৈরি হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা আর ভারতবর্ষ!

চন্দ্রদ্বীপের নাম তো বরিশাল হয়েছে, সুধারামের নাম নোয়াখালী, পুণ্ড্রবর্ধন হয়েছে মহাস্থানগড়, সুবর্ণগ্রাম হয়েছে সোনারগাঁও, শমসের নগর হয়েছে ফেনী, সিংহজানী হয়েছে জামালপুর, ভবানীগঞ্জ হয়েছে গাইবান্ধা, রোহিতগিরি হয়েছে ময়নামতি, নদীয়া হয়েছে কুষ্টিয়া, জাহানবাদ হয়েছে খুলনা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আইউব বিরোধী আন্দোলনে শহীদ আসাদের নামে আইউব গেইটের নাম বদলে আসাদ গেইট হলো আর কবি ইকবালের নামাঙ্কিত হলের নাম হলো সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। কিন্তু কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে বড়লাট মিন্টোর নামে মিন্টোরোড, আর পাশ দিয়ে বইছে ছোটোলাট জোসেফ বাম্পফিল্ড ফুলারের নামে ফুলার রোড।

নাম বদলের এই খেলাটা সেই আদিকাল থেকে চলছে, চলবেও। অনেক পরিবর্তন আমরা সাদরেই গ্রহণ করি। ঢাকা শহরের রাস্তার নামগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা হলে কেউ প্রতিবাদ করতে আসেনি। বৈদ্যনাথ তলার নাম বদলে মুজিবনগর হলো, তাতেও কারো আপত্তি হয়নি, গর্ব আর ইতিহাস হয়েছে কেবল।

কিন্তু নাম বদলের খেলাটা যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদীত হয়, তখন খটকা লাগে। যে ফুলারের নামে ফুলার রোড, সেই ফুলার তুলে নিয়েছিলেন ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’পলিসি। সেই যে মুসলিমদেরকে সনাতনপন্থীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললেন; দুই সম্প্রদায়ে বিভক্তি বাড়লো, হানাহানি বাড়লো, জ্বললো আগুন। সেই আগুনে দেশভাগ হলো, দাঙ্গা হলো, হাজার হাজার মৃত্যু হলো, কোটি কোটি হলো উদ্বাস্তু...। সেই আগুন এখনো নেভেনি, ধিকিধিকি জ্বলছেই কেবল। আমরা ফুলার রোডের নামটা বহাল রাখি, বদলে দিতে চাই অন্য অসংখ্য নাম... এই আমাদের বীরত্ব

বি:দ্র: সাম্প্রতিক কোনো ঘটনার সঙ্গে এই লেখার কোনো সম্পর্ক নাই

৩০১ পঠিত ... ১৬:৪৬, মে ০২, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top