শুধু তুলির আঁচড়ে প্রতিবাদের ভাষা নয়, সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক কার্টুন হয়ে উঠেছে গণযোগাযোগের অন্যতম শক্তিশালী ভাষা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্টুনের ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বাধীন ভারত আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন; প্রতিটি রাজনৈতিক বাঁকে কার্টুন হয়ে উঠেছিলো গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক কার্টুনকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছে দেশের গণমাধ্যম। অনুপ্রেরণায় শুধু প্রথম পাতায় ছাপানোই নয়, ছিল নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতাও। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্টুনের অনন্য সমৃদ্ধ যাত্রাকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো তিনদিনব্যাপী (২৭-২৯ মার্চ) রাজনৈতিক কার্টুন প্রদর্শনী ও ওয়ার্কশপ। বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ও ইএমকে সেন্টারের সহযোগিতায় প্রদর্শনী ও কর্মশালাটির আয়োজন করেছে eআরকি।
সবাই যখন এক ফ্রেমে
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রকর ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী (রনবী), সাড়া জাগানো চিন্তাবিদ ও ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী, খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট ও চিত্রশিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য, সাহিত্যিক ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক, কার্টুনিস্ট মেহেদী হক, কার্টুনিস্ট নাসরীন সুলতানা মিতু ও পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট ও আরকি সম্পাদক সিমু নাসেরসহ আরও অনেকে।
প্যানেল ডিসকাশনে আলোচকগণ
প্যানেল আলোচনায় তরুণ কার্টুনিস্টদের উদ্দেশ্যে নানান পরামর্শ, দিক-নির্দেশনা ও নিজেদের জীবনের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেন রফিকুন নবী, আফসান চৌধুরী, শিশির ভট্টাচার্য, মেহেদী হক ও নাসরীন সুলতানা মিতু। রফিকুন নবী বলেন, ‘আমরাও নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে কার্টুন করেছি। টোকাইয়ের মাধ্যমে সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরেছি। কার্টুনিস্টদের তার নিজস্ব সময়ের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রধান কাজ এঁকে যাওয়া। কার্টুনিস্ট নিজেই উপলব্ধি করবেন কোন বার্তাটি দিতে চান, কীভাবে দিতে চান।’
কথা বলছেন রফিকুন নবী
আফসান চৌধুরী বলেন, 'খবরের কাগজই এখন আর কার্টুনিস্টদের কাজ করার একমাত্র মাধ্যম নয়। কার্টুন মানুষের মাঝে আসতে পারে নানান মাধ্যমে। কার্টুনিস্ট নিজেই হয়ে উঠতে পারেন একটি মাধ্যম।‘
আফসান চৌধুরীর মতে, কার্টুনিস্ট নিজেই হয়ে উঠতে পারেন একটি মাধ্যম
শিশির ভট্টাচার্য্য স্বৈরশাসনের সময় তার কার্টুন নিয়ে কাজ করতে ঝুঁকে পড়া ও ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক কার্টুনের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করেন। তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, 'সময়ের আঙ্গিকে ভাবতে হবে, সময়কে তুলে ধরতে হবে। আমি আমার কাজে সবসময় যে বিষয়টি খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছি, ভিকটিমের বদলে যে হোতা তাকে তুলে ধরতে। এবং কার্টুন সবসময় হাসির হবে এমন কোনো কথা নেই। গভীর কোনো সমবেদনার কথাও কার্টুন বলতে পারে।'
সময়ের আঙ্গিকে ভাবতে হবে, সময়কে তুলে ধরতে হবে: শিশির ভট্টাচার্য্য
আনিসুল হক বলেন, 'আমি আমার গদ্য কার্টুনে না এঁকে লেখার মাধ্যমেই কীভাবে কার্টুন আঁকা যায়, কার্টুনের হিউমারটা তৈরি করা যায় সেই চেষ্টা করি। মানুষকে বার্তা দিতে হবে, তবে তার মাঝে আনন্দের যোগ হলেই মানুষ সেটা আগ্রহের সাথে গ্রহণ করে। আর সেজন্য স্যাটায়ার, কার্টুনের চেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম হয় না।'
প্যানেল আলোচনার পর অংশগ্রহণকারীদের একাংশের সাথে
কার্টুনিস্ট মেহেদী হক বলেন, 'কার্টুনিস্টকে কার্টুন আঁকার আগে তথ্যের গভীরে যেতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে শুধু চটুল তথ্যের উপর ভর করলে চলবে না। যে বিষয়ে আঁকবো সে বিষয়ে পুরোটা জানার পর কার্টুনিস্ট নিজেই বুঝতে পারবেন, কীভাবে ভাবতে হবে, কোন অ্যাঙ্গেলে আঁকতে হবে। এটা সব সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
কার্টুনিস্টকে কার্টুন আঁকার আগে তথ্যের গভীরে যেতে হবে: মেহেদী হক
কার্টুনিস্ট নাসরীন সুলতানা মিতু বলেন, 'সম্পাদনার চাপে পড়ে অনেক সময় খুব ভালো একটা কার্টুনও হয়তোবা প্রকাশ না হতে পারে। তখনই আসলে কার্টুনিস্টদের বুদ্ধিমত্তা দেখানোর জায়গা, আরও কত সুক্ষ্মভাবে আমি আমার কথাটা আঁকার মাধ্যমে বলতে পারছি।'
সম্পাদনার চাপে পড়ে অনেক সময় খুব ভালো একটা কার্টুনও হয়তোবা প্রকাশ না হতে পারে: নাসরীন সুলতানা মিতু
পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট সিমু নাসের বলেন, 'আমাদের অগ্রজ কার্টুনিস্ট ও তাদের কাজের সাথে নতুন কার্টুনিস্টদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই আয়োজন। অনেকেই মনে করে বর্তমান সময়টাই বোধহয় সবচেয়ে প্রতিকুল সময়, কিন্তু আমরা জানি বর্তমান কখনোই মনের মতো হবে না, হয় না। সবাইকে সবকিছু নিয়ে লিখতে হবে না, আঁকতে হবে না, ঠিক যেই জিনিসটা মানুষ হিসেবে আমাকে-আপনাকে যন্ত্রনা দেয় সেটা নিয়েই প্রতিবাদ জারি রাখার জন্য আঁকতে হবে, লিখতে হবে।'
আমরা জানি বর্তমান কখনোই মনের মতো হবে না, হয় না: সিমু নাসের
প্যানেল সঞ্চালনে ছিলেন আফসান চৌধুরী। আলোচনার পর বক্তারা উপস্থিত তরুণ কার্টুনিস্টদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং ইজেলে সাক্ষরের মাধ্যমে প্রদর্শনীর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। কর্মশালায় কার্টুনিস্টদের নানান প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পাশাপাশি তরুণ কার্টুনিস্টদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনা ও নানা পরামর্শও দেন গুণীজনেরা।
প্যানেল আলোচনার একাংশ
সমাপনি অনুষ্ঠানে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে সার্টিফিকেট ও পুরস্কার বিতরণ করেন কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্য, কলামিস্ট আফসান চৌধুরী, জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভী রাখসান্দ ও আমেরিকান সেন্টারের পাবলিক এনগেইজমেন্ট স্পেশালিস্ট ফারাহ নাজ মেহেরিন। প্রদর্শনী ও কর্মশালায় প্রথম হয়েছেন জাহিদ জামিল, দ্বিতীয় হয়েছেন দুরন্ত শাহাদাত মাহবুব এবং তৃতীয় হয়েছেন অরিন্দম কুন্ড।
পুরস্কার গ্রহণ করছেন তৃতীয় স্থান অধিকার করা অরিন্দম কুন্ড
পুরস্কার গ্রহণ করছেন দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা দুরন্ত শাহাদাত মাহবুব
পুরস্কার গ্রহণ করছেন প্রথম স্থান অধিকার করা জাহিদ জামিল
কার্টুনিস্ট হওয়ার পথটা সহজ নয় বলে জানিয়েছেন দ্য নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর। তিনি বলেন, ‘কার্টুনের ভাবনা ও আঁকায় আসতে হবে প্যাশন থেকে। ভালো কাজ করতে গেলে অবশ্যই লেগে থাকতে হবে।' কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রে আইন জানাটাও জরুরী বলে জানিয়েছেন নূরুল কবির।
ভালো কাজ করতে গেলে অবশ্যই লেগে থাকতে হবে: নূরুল কবীর
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরাও নিজেদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। কুড়িগ্রামের অংশগ্রহণকারী মিথিলা জানান, 'তিনদিনের এই কর্মশালা কার্টুন বিষয়ে আমার ভাবনা ও জানাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। আইডিয়া, আঁকাসহ নানান বিষয়ে আগ্রহ বেড়েছে।‘
সমাপনি অনুষ্ঠানে কার্টুনিস্টদের উদ্দেশ্যে eআরকি সম্পাদক সিমু নাসের বলেন, ‘তথ্য ঠিক থাকা জরুরি। কোনো ধরনের মিস ইনফরমেশন যেন কার্টুনের মাধ্যমে না ছড়ায়। সেজন্য প্রচুর জানতে হবে। যে বিষয়ে কার্টুন করা হচ্ছে সে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও তথ্য থাকাও জরুরী।‘
অংশগ্রহণকারীদের নানান প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, সিমু নাসের ও মেহেদী হক
শুধু প্রদর্শনীর কার্টুন দেখাই নয়, দর্শকদের ঝোঁক দেখা গেছে eআরকি আয়োজিত 'আপনি যখন মিমার' কিংবা 'কে থাকবে আপনার পছন্দের রাজনৈতিক দলে' শীর্ষক গেমগুলোতে অংশগ্রহণেও। কর্মশালা ও প্রদর্শনীটি শেষ হয় শায়ানের লাইভ মিউজিক পরিবেশনের মাধ্যমে।
মিম বানানোয় মত্ত প্রতিযোগী
টিশার্ট বুঝে নিচ্ছেন কার্টুনিস্টরা
শেষটা হলো শায়ানের লাইভ মিউজিকের মূর্চ্ছ্নায়
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন