বাংলার পুরুষেরা যে কারণে রান্নাঘর সামলাতে পারে না

৩৯২ পঠিত ... ১৭:৩৪, মার্চ ০৬, ২০২৩

Simu-naser

আমি জীবনের একটা সময় পর্যন্ত কখনো রান্না করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকি নাই। কেন ঢুকি নাই? এ নিয়ে একটু ভাবছিলাম সকাল থেকে। বিদেশে এলেই আমি খুব আগ্রহ নিয়ে রান্না করি, কিন্তু বাংলাদেশে গেলে করি না। কেন?  

****

বসবাসের জন্য বিদেশ এসে হঠাৎ করে দুঃখের সঙ্গে খেয়াল করলাম, রান্নার তেমন বিশেষ কোনো জ্ঞান আমার নেই, দিয়ারও নেই। কিন্তু খেয়ে তো বাঁচতে হবে। বাইরে বাইরে খেয়ে আর কতদিন! আমাদের তো ব্যাংক লুট করা অঢেল টাকা নাই।    

একদিন রান্না করার পরিকল্পনা করার আগে আম্মার ভাত আর ডাল রান্নার পদ্ধতিটা মনে করার চেষ্টা করলাম… ভাতের শেষ পর্যায়ে মাড় গালার একটা ব্যাপার আছে আর ডালের মাঝখানে আছে 'ছ্যাঁৎ' করে একটা আওয়াজ হওয়ার ব্যাপার। চালে পানি দিয়ে রান্না করার শেষে গিয়ে ঢাকনা দিয়ে উপুড় করে দেখি মাড় বলে কোনো বস্তু তাতে আর নাই। ওকে, সেদ্ধ যেহেতু হয়েছে তাইলে আর চিন্তা নেই। ভাত খাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক কষ্ট করেও মনে করতে পারলাম না ডাল রান্নার কোন পর্যায়ে ' ছ্যাঁৎ' করে আওয়াজ করার ব্যাপারটা করতে হবে। ঢাকা আর ইউএস টাইমের এত পার্থক্য যে রাত ৩টায় আম্মাকে ঘুম থেকে তুলে ডাল রান্নার ব্যাপারে জ্ঞান নিবো সেটাও করা ঠিক হবে না মনে হলো। তেল-লবণ-পেঁয়াজ-রসুন যা যা ঘরে ছিলো দিয়ে ডাল রান্না বসিয়ে দিলাম। খেতে মোটামুটি জঘন্য হলো। তবে সবচেয়ে বেশি রিস্ক নিলাম গরুর কলিজা (নাকি কিডনি) রান্না করতে গিয়ে। দুনিয়ার সব মসলা দিয়ে রান্না বসিয়েও দেখি উহা থেকে উৎকট হিসুর (ইউরিয়া টাইপ) গন্ধ আসছে। কোনো অবস্থাতেই সেই গন্ধ দূর করতে পারলাম না। দিয়াও বাসার চিপাচাপা থেকে আরও কিছু মশলা ঢেলে দিলো। কিন্তু পুরো বাসা দূর্গন্ধে ভরে উঠলো। শেষমেষ সেটা বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসে বাসার দরজা-জানালা খুলে দিয়ে গন্ধ দূর করলাম। এবং এই ঘটনার পর থেকে আমরা দুজন আর কলিজা খেতে পারি না। নাকের কাছে নিলেই সেই উৎকট গন্ধ পাই। রেডিমিক্স খিচুড়ি রান্না করতে গিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। ওয়েট ও স্পেস কমানোর জন্য বাইরের কাগজের প্যাকেট খুলে শুধু খিচুড়ির প্যাকেট নিয়ে এসেছি। ইন্সট্রাকশন তো নাই, সেটা ছিলো বাইরের রঙিন প্যাকেটে, যেটা ফেলে এসেছি। এখন কয় কাপ পানি দেবো, লবণ দেবো কিনা, মরিচ কি দেওয়া আছে? ফাইনালি কীভাবে সেই রেডিমিক্স খিচুড়ি রান্না হলো সেইটা আরেক কাহিনী।

দিয়া ইউটিউব খুলে বসলো। বাংলাদেশি সকল রান্নার রেসিপির ভিডিও দীর্ঘ ভিডিও। শুরুতে হাজার খানেক প্যাঁচাল, তারপর আরও প্যাঁচাল এরপর আরও প্যাঁচাল। আরে ডাল রান্নার টিউটোরিয়ালে এত প্যাঁচাল কেন ভাই? বাগাড় দেবো কখন সেইটা বলেন। সেইটার প্রিপারেশন কী? চুলা জ্বলছে, পানি গরম হয়ে গেছে, এখন কি সময় আছে আপনার প্যাঁচাল শোনার? অবশেষে খুঁজে খুঁজে দিয়া 'বাংলার রান্নাঘর' টাইপের একটা চ্যানেল বের করলো তাতে প্যাঁচাল কম, শর্টকাটে ২/৩ মিনিটে দেখিয়ে দেয় কীভাবে কী রান্না করতে হবে। আর আমি খুঁজতে বসলাম আমাদের দেশের ব্যবহৃত মসলাগুলোর আসলে কাজ কী? লবণ বুঝলাম কিন্তু আদা আসলে কী করে, জিরার কাজ কী, রসুন কেন? বুঝতে গিয়ে বুঝলাম এইটা তো একটা দারুন জিনিস। হলুদ কেন বাংলার রান্নায় খুবই অপরিহার্য একটা বিষয় সেদিন প্রথম টের পেলাম। উহা ব্যাকটেরিয়া নিরোধক। ফ্রিজ ছিলো না আমাদের বাংলাদেশে আগে। তাই মাছ বা মাংস যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য হলুদ দিয়ে জ্বাল দিয়ে রাখা হতো। কাঁচা মরিচ কী ফ্লেভার দেয় আর কোথায় শুকনা মরিচ ব্যবহার করতে হবে… ইহা তো একটা সত্যিকারের 'কেমিস্ট্রি'।   

আমি রান্নায় ব্যাপক আনন্দ খুঁজে পেলাম। দিয়াও তেহারি রান্নার একটা রেসিপি শিখে ফেললো। গ্যাসের চুলায় বেগুন পুড়িয়ে ভর্তা করার জটিল পদ্ধতির পরিবর্তে  আবিষ্কার করলাম একটা সহজ পদ্ধতি। বেগুন ছিলে কাঁটাচামচ দিয়ে অসংখ্য ফুটো করে একটা জিপলক ব্যাগে ঢুকিয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ৮/১০ মিনিট রাখলে সেদ্ধ হয়ে যায়। এরপর সেটা ভর্তা বানিয়ে সরিষার তেল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ দিয়ে ভাজলে দারুন হয় খেতে। রসুন ছেলার সহজ পদ্ধতি হাতেকলমে শিখিয়ে দিলেন সিয়ালটলের খোকন ভাই। রসুনের কোয়ার গোড়া কেটে ছুড়ি দিয়ে ডলা দিলেই হয়। এরপর তার খোসা ছড়ানো সহজ। নিউ অর্লিয়ন্সে আমাকে একটা দেশি কাঁচামরিচের গাছ উপহার দিলেন জিনিয়া আপা। প্রতিদিন সেখানে থেকে ৫/৭টা মরিচ পাওয়া যায়।   

অর্থাৎ আমি আর দিয়া তখন পুরোদমে রান্না শুরু করলাম। একসাথে রান্না করা আমরা এমন উপভোগ করা শুরু করলাম যে বলার না। প্রাথমিকভাবে গিনিপিগ হিসেবে বাসায় দাওয়াত দিতে থাকলাম আমেরিকান বন্ধু-বান্ধবদের। প্রতিটা খাবারের আমরা নতুন নাম দিলাম। খিচুড়িকে তাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলাম 'রেইনি ডে রাইস' হিসেবে। ব্যাখ্যা হিসেবে বললাম, বাংলাদেশে বৃষ্টি এলেই মানুষ ঘরের সকল রান্না রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এই 'রেইনি ডে রাইস' খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। এটা একধরনের রিচ্যুয়াল বলতে পার। সাথে আমাদের বেগুন ভাজা আর ভর্তা খেয়ে তারা মুগ্ধ। আমাদের কনফিডেন্স আরও বেড়ে গেলো। আমরা হাত দিলাম গরুর মাংস, স্যামন মাছ রান্নার দিকে। সেই প্রথম বুঝতে পারলাম, মাছ বিশেষ করে স্যামন বেশি রান্না করলে ইঁটের মতো শক্ত হতে থাকে। খেতে গিয়ে চাপা ব্যথা হয়ে যায়। রান্নার সময় তাপের বেসিক যে সূত্র অর্থাৎ জ্বাল দিলেই সবকিছু নরম হয়, সেটা নাও হতে পারে।  

আমাদের কনফিডেন্স এমন বেড়ে গেলো যে বিদেশের বিভিন্ন শহরে আমরা যেসব লোকাল হোস্টদের বাসায় 'কাউচসার্ফিং'-এর মাধ্যমে থাকতাম, তাদের একটা করে ডিশ রান্না করে খাওয়াতে শুরু করলাম। রীতিমতো স্থানীয় কাঁচাবাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে রান্না। আমরা শিখে ফেললাম মিষ্টি কুমড়ার স্যুপ কীভাবে বানাতে হয়, চিকেন যে রান্নার বদলে ভর্তা করে খেতে বেশি মজা সেটাও প্রচার করতে শুরু করলাম। আমি বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করলাম সেদ্ধ আলু, সবজি আর ডিমের একটা রেসিপিতে। একদমই আমার নিজের রেসিপি, দশে এগারো মার্ক পাওয়ার মতো রান্না।  

তো করোনায় আমরা ঢাকায় এসে আটকা পড়ে গেলাম। একটা বাসা ভাড়া নিয়ে নিজেরা রান্না করতে গিয়ে দেখি রান্নায় ঠিক সেই আনন্দ আর পাচ্ছি না। আমি আর দিয়া দুজনেই বেশ কয়েকবার ট্রাই করলাম। উঁহু হচ্ছে না। কঠোর লকডাউনের মাঝেও অর্ডার করেই খেতে হচ্ছে। হলোটা কী?

ভাবতে গিয়ে কয়েকটা জিনিস খেয়াল করলাম। বিদেশের যেসব বাসায় আমরা থেকে রান্না করা উপভোগ করেছি সবগুলোই ওপেন কিচেন ধরনের। খোলামেলা। একজন পেঁয়াজ-সবজি কাটছি তো আরেকজন নাড়া দিচ্ছি। জায়গার সমস্যা নেই। স্পিকারে বাজছে গান বা অডিও বুক বা পডকাস্ট। অথবা সামনেই টিভিতে চলছে কোনো হালকা সিরিজ। চুলার ওপরেই শক্তিশালী ভেন্ট। এসি বা ফ্যান থাকায় আরামদায়ক আবহাওয়া। উঁচু টুলে বসার ব্যবস্থা বা সোফায় গিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। এবার ঢাকার বাসার রান্নাঘরগুলোর দিকে একটু তাকাই।রান্নাঘরটা থাকে বাসার সবচেয়ে ঘুপচির মাঝে। ছোট্ট। আলাদা একটা রুম। সেখানে এসি বা ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। ড্রয়িংরুমের মূল বিনোদন কেন্দ্র থেকে দূরে। পুরাই আইসোলেটেড। উত্তর-দক্ষিমুখী বাসা হলে রান্নাঘর হয় প্রায়ই পশ্চিম দিকে। সেদিকে বাংলাদেশের সূর্য সবচেয়ে বেশি তাপ দেয়।   

মনে পড়লো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রোমেন ভাইয়ের একটা গবেষণার কথা। শহরের নারীরা গ্রামের তুলনায় রান্নাজনিত বায়ুদূষণের বেশি শিকার হয়। গ্রামের রান্নাঘরগুলো তাও একটু ভেন্টিলেশন থাকে কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের রান্নাঘরগুলোর বেশিরভাগই কিচেন হুড নাই, নাই প্রপার ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। জানালা যাও থাকে সেটাও হয়তবা ঠিকমতো খোলা যায় না। এছাড়া গরমের দিন রান্নাঘর হয়ে ওঠে একটা নরক। পাশাপাশি ফ্রিজের পেছন দিক দিয়ে বের হওয়া গরম বাতাস তো আছেই।  

আর বাসার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটা? ড্রয়িংরুম। সেখানে টিভি থাকে, থাকে সোফা। সেখানে অফিস শেষে 'ক্লান্ত পুরুষটি' বাসায় এসে একটু আরাম করে। আর এই রান্নাঘরটিতে যেহেতু পুরুষরা খুব একটা সময় কাটায় না, তাই তাদের এটার আরাম নিয়েও কোনো ভাবনা নেই। আর পুরো ব্যাপারটিরই আর্কিটেকচারাল নকশা করে থাকেন সাধারণত একজন পুরুষ আর্কিটেক্ট।

বাংলার পুরুষরা যেহেতু রান্নাঘরে সময় কাটায় না, কাটানোর সম্ভাবনাও নেই, সেখানে থাকে স্ত্রী বা সস্তা শ্রমের কোনো কমবয়সী/বয়সী নারী তাই তারা এই রুমটার ফাংশনালিটি ছাড়া কমফোর্ট নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। একজন আর্কিটেক্টের সাথে এ নিয়ে একবার কথা বলেছিলাম, তিনি বলেছিলেন, আমাদের উপমহাদেশের রান্নায় প্রচুর মসলা ব্যবহার হয় বলে রান্নার সময় প্রচুর স্পাইসিনেস ছড়িয়ে পড়ে, তাই হয়তো বা আলাদা একটা রুমে কিচেনের চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমার ধারণা বিদেশী বাসার আর্কিটেক্টরাও একসময় ভাবতো না। নিউ অর্লিয়েন্সের কিছু পুরোনো বাসায় গিয়ে আমি দেখেছি প্রায় কাছাকাছি ঘুঁপচি রান্নাঘর। তারা তো কখনোই স্পাইসি রান্না করতো না। কিন্তু যখনই পুরুষদেরও রান্নাঘরে আসার প্রয়োজন হলো তারা ওপেন ও কমফোর্ট বেজড ডিজাইনের দিকে আগাতে থাকলো নিজের কমফোর্টের জন্য। একটু বিয়ার খেতে খেতে, একটু টিভির বড় পর্দায় খেলা দেখতে দেখতে রান্না করবে ইত্যাদি।  

আরও খেয়াল করলাম দেশের রান্নাঘর-বাথরুম থেকে শুরু করে সবকিছুই তীব্রভাবে পুরুষের সুবিধার জন্য ডিজাইন করা। বিশেষ করে সুস্থ-সবল পুরুষের জন্য। আমি নিশ্চিত বাংলার পুরুষরা যেদিন থেকে আস্তে আস্তে রান্নাঘরে ঢোকা শুরু করবে সেদিন থেকে বাংলার রান্নাঘরের কমফোর্টও বাড়তে থাকবে, ডিজাইনও চেঞ্জ হবে।

আরও দ্রুত চেঞ্জ হবে যদি নারী আর্কিটেক্টদের এই পেশায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারি আমরা, তারাও যদি সমানতালে বাসাবাড়ি ডিজাইন শুরু করতে পারে।

৩৯২ পঠিত ... ১৭:৩৪, মার্চ ০৬, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top