ঘোরা রজনী, এ মোহঘনঘটা–
কোথা গৃহ হায়।
পথে ব’সে… সারাদিন করি, খেলা।
খেলা যে ফুরাইল–গৃহ চাহিয়া প্রাণ কাঁদে…
উপরের পংক্তিখানা লিখিয়া যে নিজের বিপদ নিজেই ডাকিয়া আনিবো, উহা আমি বুঝিতে পারি নাই। ঘটনাবলী আপনাদের বুঝাইয়া বলি।
টিএসসির পথের ধুলায় দাঁড়াইয়া আপন মনে এই ভুবনের আনন্দধারা অনুধাবন করিতেছিলাম। অন্য আট দশটা রজনীর মতো উহাও ছিলো একটি অন্ধকার অমানিশা।
হঠাৎ দেখিলাম, রজনীর অন্ধকারকে ভেদ করিয়া একটি সাদা আলোকবিন্দু আমার পানে আগাইয়া আসিতেছে।
তবে কি প্রভাত নামিবার ক্ষণ আসিয়াছে?
‘শুভ্র প্রভাতে পূর্বগগনে উদিল কল্যাণী শুকতারা’
ঐ আলোকবিন্দু কি তবে পূর্ব গগনের সেই কল্যানী শুকতারা যার কথা আমি লিখিয়াছিলাম আজি হতে শতবর্ষ পূর্বে!
খানিক পরে সম্বিত ফিরিলো। উহা একটি সাদা মাইক্রো। কিছু বুঝিয়া উঠার পূর্বেই সাদা মাইক্রো থেকে দুটি ষণ্ডামার্কা বালক নামিয়া আসিলো। আমাকে বলিলো, ‘গুরুদেব, চলেন।‘
আমি খানিক ইতস্তত করিলাম। বলিলাম, ‘কোথাও যাওয়ার কথা বলিতেছো, হে?’
একজন উত্তর দিলো, ‘কেন? আপনিই তো লিখিয়াছেন, গৃহ চাহিয়া প্রাণ কান্দে’। তাই আপনাকে গৃহে নিতে আসিয়াছি।
আমার ইতস্তত ভাব দেখিয়া বোধ হইলো, বালকরা রাগান্বিত হইয়াছে। একজন তো বলিয়াই ফেলিলো, ‘যাবেন, নাকি জোর করিয়া নিতে হইবে?’
আমি বুঝিয়া গেলাম, উহারা সহজ জিনিস নহে। আমার আর ভুল করা চলিবে না।
‘ভুল করেছিনু ভুল ভেঙেছে।
জেগেছি, জেনেছি-- আর ভুল নয়, ভুল নয়॥
মায়ার পিছে পিছে -- ফিরেছি, জেনেছি স্বপনসম সব মিছে--
বিঁধেছে কাঁটা প্রাণে-- এ তো ফুল নয় ফুল নয়॥‘
আমি নিজের ইচ্ছাতেই গাড়িতে উঠিলাম।
২.
আমি ভাবিয়াছিলাম, উহারা হয়তো আমাকে আমার বাটিতে নামাইয়া দিবে। মৃনালীনি হয়তো আমাকে দেখিয়া ব্যকুল হইয়া পড়িবে। আমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করিবে – ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
আমি উত্তরে বলিবো, ‘রবীন্দ্রনাথের পত্নি হইয়া তুমি জীবনানন্দের ভাষায় কথা বলিতেছ কেন? দুই মাস বাটি ছাড়িয়া টিএসসিতে ছিলাম। দুই মাসে আমাকে ভুলিয়ে এখন জীবনানন্দ ধরিয়াছো? এ কেমন বৃথা অভিসার তোমার আমার!’
কিন্তু কিছুই হইলো না। বালকরা আমাকে নিয়া গেলো অন্য আরেক বাটিতে। আমাকে রাখিলো বদ্ধ এক গৃহে। আমি অনেকক্ষণ খোঁজাখোঁজি করিয়া দেখিলাম, এই গৃহখানায় কোনো জানালা নাই, দরজা নাই, এমনকি ভ্যেন্টিলেটরও নাই।
সর্বনাশ! আমি এখন বিশ্বব্রম্মাণ্ডের সৌন্দর্য দেখিবো কী করিয়া! আমি গুরুদেব মানুষ, জগত সংসার না দেখিলে আমার চলিবে কেমনে?!
যা-ই হোক। আমাকে উহারা আটকাইয়া রাখিলো পাঁচদিন। এই পাঁচদিন আমার সাথে যা যা ঘটিয়াছে তাহার মধ্যে দুটি ঘটনা আলাদা করিয়া বলা যাইতে পারে।
ক.
বালকগুলোকে আর খুব একটা দেখা যায়নি। তবে বালকদিগের এক সর্দার প্রায়ই আমার নিকট আসিতেন। আসিয়া জিজ্ঞেস করিতেন – ‘আমি কাহার লোক?’
আমি বলিতাম, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক। আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।‘
আমার কথা শুনিয়া সর্দার হতাশ চিত্তে ফিরিয়া যাইতেন।
খ.
আরেকদিন আসিলেন বালদিগের মহাসর্দার। তিনি আসিয়া রাগিয়া মাগিয়া বলিলেন, আমি মুখ না খুলিলে উহারা নাকি আমাকে আঘাত করিবে।
আমি বলিলাম, ‘আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো। আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো…’
আমার কথা শুনিয়া এই সর্দারও ব্যর্থ মনোরথ নিয়া ফিরত গেলেন।
৩.
পঞ্চম দিন সকালে উহারা বলিলেন, আমি নাকি মুক্ত।
কিছু বালক আমাকে আবার সেই সাদা গাড়িতে চড়াইলো। লম্বা ভ্রমণ শেষ আমাকে উহারা আমার বাটির পাশেই নামাইয়া দিলো। প্রিয় মৃনালীনির সাথে আমার কতদিন পর যে দেখা হইবে! আসন্ন প্রণয়ের ক্ষনগুলির কথা ভাবিয়া আমার হৃদয় পূলকিত হইলো।
এতদিন জগত সংসারে কী ঘটিয়াছে তাহা জানিবার জন্য একটি পত্রিকা কিনিলাম। পত্রিকা কিনিয়া বাটির পানে হাঁটা দিলাম।
কিন্তু পত্রিকাখানা খুলিয়া আমার চক্ষু চড়কগাছ হইয়া গেলো। দেখিলাম, আমি নাকি এতদিন ছিলাম আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাটিতে!
এই খবর কে ছড়াইলো! কাহারা ছড়াইলো! কী উদ্দেশ্যে ছড়াইলো!
নিশ্চয়ই এই খবর এতক্ষণে মৃনালীনির কাছেও পৌছাইয়াছে। এই খবর পাইয়া সে কী অবস্থায় আছে ভাবিয়া আমার হৃদয় ভয়ে জড়সড় হইয়া গেলো! আমি বুঝিয়া গেলাম, আমার খবর আছে।
আমি গুনগুন করিয়া উচ্চারণ করিলাম, ‘কী ভয় অভয়ধামে, তুমি মহারাজা-- ভয় যায় তব নামে॥‘
আমি মহারাজের নাম লইয়া বাটির পানে আগাইতে লাগিলাম।
বাটির সামনে দাঁড়াইয়া অনেক আগে লেখা দুইটি লাইন বদলাইয়া ফেলিলাম, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, ইহাই আমার প্রার্থণা, ইহাই আমার প্রার্থনা, ইহাই আমার প্রার্থনা।’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন