আনসারের হৃদয়ে পুলিশি দোলা

২৫৯ পঠিত ... ১৮:৩৩, অক্টোবর ২৫, ২০২৩

8 (1)

ভোরবেলা স্ত্রীর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে। স্ত্রীর বড় ভাই এসেছে। এলাকার বালু সওদাগর। পাটগাঁতি বাজারের মাঝখানে বিরাট দালান তুলেছে। পরনে দামি কাপড়ের ধোপ-দুরস্ত পাঞ্জাবি গলায় চেইন। ছোট বোনের স্বামী ছোট চাকরি করে বলে একটু অবজ্ঞার চোখেই দেখে। আজ কী মনে করে হঠাত কে জানে!

আনসার ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে চোখে-মুখে পানির ছিটা দিয়ে এসে দাঁড়ায়, আচ্ছালামুওয়ালাইকুম শামীম ভাই! কী ব্যাপার পথ ভুল কইরে নাকি; গরীবের ঘরে হাতির পাড়া!

ওয়ালাইকুম, ওয়ালাইকুম আসসালাম, আনসারকে জড়িয়ে ধরে শামীম, কী যে কও দুলা মিয়া! আমি আর কী এমন; এখন ব্যাবাক পাওয়ার তো তুমার; তুমি চাইলেই ময়লার গাড়ি ভাঙ্গার অপরাধে মামলা দিয়া গেরেফতার করতে পারো আমারে যে কুনো সুমায়।

কে জানে কী মনে করে, হরিদাসপুরের চেয়ারম্যান সাহেব বাজারের সবচেয়ে বড় ইলিশ মাছটা পাঠিয়েছে; আনসারের স্ত্রী গর্বিত ভঙ্গিতে শামীমকে বলে, ভাইজান খাইয়া যাবেন আইজ। আপনি তো আর এই গরীব বোনডারে দেখতে আসেন না।

--কী যে কস বইন; আরেকদিন আমুনে; দুলামিয়ার ছুটির দিন। একলগে বইসা মুরগামুসাল্লাম খাইয়াম।

আনসার দ্রুত ইউনিফর্ম পরে ডিউটির জন্য রেডি হয়, ও সালমা আমার ক্যাপ কই রাখছো!

সালমা একটু রহস্য করে, আমারে একটু আদর করেন; নাইলে টুপি দিমুনা কইলাম।

আনসার বিস্মিত হয়; যে সালমার দেমাগে বাঁচা যায় না সে বালুসওদাগরের ছোট বোন বলে; যে প্রায়ই মাথা ধরার ভঙ্গি করে ঘুমিয়ে যায়, "উহ সইরা শোও"; সে আজ এমন নখরা করে কেন!

বাড়ি থেকে বের হতেই প্রতিবেশী মিঠু মিয়া লম্বা করে সালাম দেয়। মিঠু স্থানীয় হাসপাতালে বালিশ, জানালার পর্দা, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ সাপ্লাই দিয়ে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছে। সরকারি দলে কী একটা সহ সভাপতির পদ বাগিয়েছে; আগে দেখা হলে অবজ্ঞার চোখে তাকাতো। আজ হ্যান্ডশেক করছে দুই হাত দিয়ে। হাত ছাড়তেই চাইছে না।

কিছু একটা হয়েছে, কিছু একটা বদলেছে; নইলে আজকের দিনটা অন্যদিনগুলো থেকে আলাদা হলো কী করে! রিক্সাওয়ালা আজ স্যার বলে ডাকছে, ভাড়াডা বাড়ায়ে দিতে বলছে না; ভাড়া নিতে কাঁচু মাঁচু করছে লাজুক কিশোরির মতো।

অথচ এই দশবছরের চাকরি জীবনে আনসার প্রতিটিদিন কর্তব্য পালন করেছে; যখন যেখানে ডিউটি পড়ে; সময় মতো যায়, দেরি করে ফেরে; আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে ডিউটিতে ফাঁকি দিয়েছে। কিন্তু এর পরিবর্তে সে সবার অবহেলাই কেবল পেয়েছে। পথে কোন পুলিশের সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতো, অই আনসার তোমার থ্রি নট থ্রি দিয়া গুলি বাইর হয় নাকি এমনিই রাখছো!

পথে জগলু পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়; তার মন মরা; সে নিজে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে করমর্দন করে, ভাই আনসার অনেক সময় দুষ্টামি কইরা অনেক কিছু কইছি; মনে কিছু রাইখো না গো ভাই।

আনসার ফাঁড়িতে প্রবেশের মুখে গণেশ মুদির দোকান। গণেশ ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে চট করে একটা কাঁসার প্লেটে লাড্ডু পরিবেশন করে, ও দাদা পূজার সময় অনেক ডিউটি দিছেন; ঠিক মতো খাতির যত্ন করতে পারলাম কীনা!

ফাঁড়িতে আজ সাজ সাজ রব; সামনে অনেক মোটর বাইক দাঁড়িয়ে; এলাকার ইমাম, পুরোহিত, নেতা, হাতা, ছাতা সারা ইঞ্জিনিয়ার সবাই হাজির রীতমত ফুল মিষ্টি নিয়ে। ফাঁড়ির গেটের কাছ থেকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া তিনটে পুলিশ টুল টুল করে আনসার ফাঁড়ির দিকে তাকায়।

গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা সুপার দোয়া-কালাম পড়ে মুনাজাত ধরেন, হে আল্লাহ, আনসার ভাইয়েদের দেশের ও জনগণের খেদমতের যে সুযোগ কইরে দিলে; তাতে শোকর গুজার করি। হে আল্লাহ আনসার বেরাদার্ন্দের যে শৌর্য-বীর্য তুমি উপহার দিয়াছ; তাহারা যেন উহার মর্যাদা রক্ষা করিতে পারে। আমিন।

স্থানীয় কামারশালার মালিক গৌতম বাবু এসেছেন, হ্যান্ডকাফ, শেকল, বেড়ির অর্ডার নিতে। তিনি ছবি এঁকে দেখাচ্ছেন কেমন সুন্দর আর মজবুত হবে সেগুলো। ফাঁড়ি প্রধান, ফাঁড়িতেই ছোট খাটো কারাগার তৈরির লোহার গরাদের পেছনে কেমন খরচ হবে জানতে চান। গৌতম বাবু হেসে বলেন, কইরে দেবানে স্যার, অত্যন্ত কম খরচে কইরা দেবানে; খালি একটাই আরজি, আমগে যেনো আবার গরাদে ঢুকাইয়েন না।

ফাঁড়ি প্রধান বলেন, ফাইনাল কিছু হয়নি; এমনি আলোচনাটা উঠেছে। লোকজন তা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে। গুজবে কান দেবেন না।

পাটগাঁতি বাজারের চায়ের স্টলে, মনোহারি দোকানের টুলে, খাবার হোটেলে খবরের কাগজ হাতে আজ শুধু একটাই আলাপ, রাহো মিয়া তুমার রেব- পুলিশ; অহন আনসারের -দন দেকপানি। ইলেকশন আসতিছে কৈল।

সরকার দলের সমর্থকেরা চোখ টিপে বলে, আগের ইলেকশনে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের উপহার আসছিল; এইবারের উপহার স্মার্ট আনসার। ভোটটা ঠিকঠাক দিয়েন; নিজেও ভালো থাহেন, আমগেরো ভালো রাহেন।

আনসার বন্দুক হাতে বাজার এলাকার ডিউটিতে এলে একটা ধেড়ে ইঁদুর এসে জোর করে পকেটে টাকা গুঁজে দিতে চায়, রাহেন স্যার; আমরা তো পাটগাতি বাজার ডাইকা নিছি; এতোদিন পুলিশরে চা-মিষ্টি খাওনের টেকাটুকা তুইলা দিতাম। অহন আপনেরেও দিতি হপে; ওস্তাদের অর্ডার।

আনসার ধমক দেয়, রাহো তো মিয়া তুমার চা-মিষ্টি।

ধেড়ে ইঁদুর ঘাবড়ে যায়, স্যার কী মাইন্ড করলেন! আমি তো হুকুমের গুলাম। ওস্তাদ কইছে অহন থিকা আনসাররে সালাম ও সালামি দিয়া চলতি। পাঁটগাতির দুই নয়ন, পুলিশ আর আনসার।

মধুমতীর ঘাটের কাছে আসতে সূর্যটা ঢলে আসে। অন্ধকার নামে ঘন হয়ে। ঘাটের পন্টুনে দাঁড়িয়ে রাশি রাশি ঢেউয়ের দিকে তাকাতেই একটা পুষ্প-অলংকরা পীতেল বর্ণের তীক্ষ্ণ নাকের মেয়ে এসে ডাকে, স্যার ও স্যার; মেয়েটির বুক ভয়ে দুরু দুরু করে কাঁপছে, স্যার গায়ে খেইটে দুটো পয়সা যা পাই, তাদিয়ে মা-ছোট ভাইকে নিয়ে কোন মতে খেয়ে বাঁচি। পুলিশ মাঝে মইদ্যে ভয় দেখায়, অই বে আইনি কাজ করস; জেলে দিমু তরে।

মেয়েটা ভাসা ভাসা চোখে তাকায়, যে দৃষ্টির অর্থ কূল নাই কিনার নাই, স্যার ও স্যার কথা কন না ক্যান! লাল গোলাপের ছোয়া নেবে কাছে এসো!

আনসার ভূতগ্রস্তের মতো দ্রুত পায়ে হেঁটে পন্টুন ছেড়ে ঘাটের পাশের রাস্তায় ওঠে। হন হন করে হেঁটে চলে যায়; পেছনে তাকায় না।

২৫৯ পঠিত ... ১৮:৩৩, অক্টোবর ২৫, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top