কালো বিড়াল

১২৮৫ পঠিত ... ১৭:০৬, আগস্ট ০৮, ২০২২

Kalo-biral

মূল: এডগার অ্যালান পো

অনুবাদ: অনীশ দাস অপু

 

ছেলেবেলা থেকেই আমি পশুপাখি খুব ভালোবাসি। আমার স্বভাবও ছিল শান্ত। জম্ভজানোয়ার পুষতে ভীষণ ভালোবাসতাম। বড় হলাম কিন্তু স্বভাব পালটাল না।

বিয়ে করলাম অল্পবয়সে। বেশ মনের মতো বউ পেলাম। স্বভাবটি মিষ্টি। শান্ত। জম্ভজানোয়ার পোষার শখ আমার মতোই। আমাদের শখের চিড়িয়াখানায় একটা বেড়ালও ছিল। কালো বেড়াল।

শুধু কালো নয়, বেড়ালটা বেশ বড়ও বটে। বুদ্ধিও তেমনি। বেড়ালের মগজে যে এত বুদ্ধি ঠাসা থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বউ কিন্তু কথায় কথায় একটা কথা মনে করিয়ে দিত আমাকে। কালো বেড়ালকে নাকি ছদ্মবেশী ডাইনি মনে করা হতো সেকালে। আমি ওসব কুসংস্কারের ধার ধারতাম না।

বেড়ালটার নাম পুটো। অষ্টপ্রহর আমার সঙ্গে থাকত, পায়ে পায়ে ঘুরত, আমার হাতে খেত, আমার কাছে ঘুমোত। প্লুটোকে ছাড়া আমারও একদিন চলত না।

বেশ কয়েক বছর পুটোর সঙ্গে মাখামাখির পর আমার চরিত্রের অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা গেল।

ছিলাম ধীর, শান্ত। হয়ে উঠলাম অস্থির, অসহিষ্ণু, খিটখিটে। মেজাজ এমন তিরিক্ষি হয়ে উঠল যে বউকে ধরেও মারধর শুরু করলাম। প্লুটোকেও বাদ দিলাম না।

এক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি এসে দেখি দুটো আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। আর যায় কোথা! মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। খপ করে চেপে ধরলাম। ফ্যাস করে সে কামড়ে দিল আমার হাতে। আমি রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম। পকেট থেকে ছুরি বার করে পুটোর টুটি ধরলাম এক হাতে, আরেক হাতে ধীরে সুস্থে উপড়ে আনলাম একটা চোখ।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙবার পর একটু অনুতাপ হলো বৈকি। উত্তেজনা মিলিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে কিন্তু দুটো আমার ছায়া মাড়ানো ছেড়ে দিল। চোখ সেরে উঠল দুদিনেই। কিন্তু আমাকে দেখলেই সরে যেত কালো ছায়ার মতো।

আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে পশু প্রবৃত্তি আবার জেগে উঠল। যে বেড়াল আমাকে এত ভালোবাসত, হঠাৎ আমার ওপর তার এত ঘৃণা আমার মনের মধ্যে শয়তানি প্রবৃত্তিকে খুঁচিয়ে তুলতে লাগল। সে কিন্তু কোনো দিন ক্ষতি করেনি আমার। তা সত্ত্বেও ওকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার জন্য হাত নিশপিশ করতে লাগল আমার।

একদিন সত্যি সত্যিই ফাঁসি দিলাম প্লুটোকে। বাগানের গাছে লটকে দিলাম দড়ির ফাঁসে। ও মারা গেল। আমিও কেঁদে ফেললাম। মন বলল, এর শাস্তি আমাকে পেতেই হবে।

সেই রাতেই আগুন লাগল বাড়িতে। রহস্যময় আগুন। জ্বলন্ত মশারি থেকে বউকে নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলাম পুড়ছে সারা বাড়ি।

দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল গোটা বাড়ি। খাড়া রইল শুধু একতলার একটা দেয়াল। পাড়ার সবাই অবাক হয়ে গেল সাদা দেয়ালের ওপর একটা কালো ছাপ দেখে। ঠিক যেন একটা কালো বেড়াল। গলায় দড়ির ফাঁস।

একরাতেই ফকির হয়ে গেলাম আমি। কালো বেড়ালের স্মৃতি ভোলার জন্য আবার একটা বেড়ালের খোঁজে ঘুরতে লাগলাম সমাজের নিচুতলায়। একদিন একটা মদের আড্ডায় দেখতে পেলাম এমনি একটা বেড়াল। বসেছিল পিপের ওপর-অথচ একটু আগেও জায়গাটা শূন্য ছিল। অবিকল প্লটোর মতোই বড়, মিশমিশে কালো। শুধু বুক ছাড়া। সেখানটা ধবধবে সাদা।

বেড়ালটার মালিকের সন্ধান পেলাম না। তবে আমি গায়ে হাত দিতেই যেন আদরে গলে গেল সে। বাড়ি নিয়ে আসার পরের দিন সকালবেলা লক্ষ করলাম-একটা চোখ নেই।

সেই কারণেই আরও বেশি করে আমার বউ ভালোবেসে ফেলল নতুন বেড়ালকে। মনটা ওর নরম। মমতায় ভরা-তাই।

যা ভেবেছিলাম, আমার ক্ষেত্রে ঘটল কিন্তু তার উল্টো। ভালোবাসা দূরের কথা-দিনকে দিন মনের মধ্যে ক্রোধ আর ঘৃণা জমা হতে লাগল নতুন বেড়ালের প্রতি। কোত্থেকে যে এত হিংসা-বিদ্বেষ রাগ মনে এল বলতে পারব না।

বেড়ালটার আদেখলেপনাও বাড়ল তালে তাল মিলিয়ে। যতই মাথায় খুন চাপতে লাগল আমার ওর প্রতি-ততই আমার গায়ে মাথায় কোলে চাপার বহর বেড়ে গেল হতভাগার। প্রতিবারেই ভাবতাম, দিই শেষ করে। সামলে নিতাম অতি কষ্টে।

বউ কিন্তু একটা জিনিসের প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত আমার। তা হলো কালো বেড়ালের সাদা বুক। প্লটোর সঙ্গে তফাত শুধু ঐ জায়গায়। সাদা ছোপটা দেখতে অবিকল ফাঁসির দড়ির মতো!

একদিন পুরোনো বাড়ির পাতাল ঘরে গেছি বউকে নিয়ে। অভাবের তাড়নায় গিয়ে পারতাম না। ন্যাওটা বেড়ালটা পায়ে পায়ে আসছে। পায়ে পা বেঁধে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম নিজেকে। কিন্তু সামলাতে পারলাম না মেজাজ। ধা করে একটা কুড়াল তুলে নিয়ে টিপ করলাম হতচ্ছাড়া বেড়ালের মাথা-বাধা দিল আমার বউ।

বউ বাধা না দিলে সেদিনই দফারফা হয়ে যেত নতুন বেড়ালের। কিন্তু সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল বউয়ের ওপর। অমানুষিক রাগ। কুড়ালটা মাথার ওপরে তুলে বসিয়ে দিলাম ওর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল স্ত্রী।

সমস্যা হলো লাশটা নিয়ে। অনেক ভেবেচিন্তে দেয়ালের মধ্যে রক্তমাখা দেহটা খাড়া করে দাঁড় করিয়ে ইট দিয়ে গেঁথে ফেললাম। প্লাস্টার করে দিলাম। বাইরে থেকে ধরবার কোনো উপায় রইল না।

বড় শান্তিতে ঘুমালাম সেরাত্রে-বেড়াল ছাড়া। কুড়াল নিয়ে খুঁজে ছিলাম তাকে বধ করবার জন্য-পাইনি।

দিন কয়েক পরে পুলিশ এসে সারা বাড়ি খুঁজল। আমি সঙ্গে রইলাম। একটুও বুক কাঁপল না। চার-চারবার নিয়ে গেলাম পাতালকুঠুরির সেই দেয়ালের কাছে।

তারপর যখন মুখ চুন করে ওরা চলে যাচ্ছে, বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়লাম আমি। হাতের পাটি দিয়ে খটাস করে মারলাম দেয়ালের ঠিক সেইখানে যেখানে নিজের হাতে কবর দিয়েছি বউকে।.

আচমকা একটা বিকট কান্নার আওয়াজ ভেসে এল ভেতর থেকে। সারা বাড়ি গমগম করতে লাগল সেই আওয়াজে। দেখলাম, আমার মরা বউয়ের মাথার ওপর বসে রয়েছে সেই কালো বেড়ালটা-যার বুকের কাছটা সাদা!

১২৮৫ পঠিত ... ১৭:০৬, আগস্ট ০৮, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top