কানে খাটো চাকর নিয়ে যেসব বিপদে পড়তে হয়

১৪৮৭ পঠিত ... ১৯:০৪, অক্টোবর ২১, ২০২০

নতুন চাকরটাকে নিয়ে ভারী মুশকিলে পড়া গেছে! হরহামেশাই এটা-সেটা ভুল করে বসছে। তার জন্যে বকুনিও খাচ্ছে খুব। কিন্তু উপায় নেই—এই কয়দিনের মধ্যেই ব্যাটা আব্বার সুনজরে পড়ে গেছে। ওর উপর আব্বার কেমন যেন একটা মায়া লক্ষ্য করছি। ওর হাবাগোবা ভাব আর গরুর মতো নিরীহ চোখ দুটোর দিকে তাকালে আমার নিজেরও খুব মায়া হয়। নেহায়েৎই গো-বেচারা! দোষের মধ্যে কেবল কানে একটু খাটো। সে জন্যেই তার উপর আমার রাগ।

পয়লা দিন ছোটো চাচা এলেন। উনি শাকেরকে (চাকর) দেখতে পেয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ও, এই ছোঁড়াটাকে বুঝি নতুন চাকর রেখেছে ভাবী?

আম্মা বললেন : হ্যাঁ, সপ্তাহ দুয়েক থেকে ও এখানে কাজে লেগেছে। মুনিম সাহেব ওকে শাঠিয়েছেন। ওর ভাই না কে যেন ওঁদের বাড়িতে কাজ করে।

বেশ তো ভালো কথা। তাতে কোনো ক্ষতি নই। তবে কথা হচ্ছে, সাবধানে থাকা ভালো। কথায় বলে, “সাবধানের মার নেই।”—ছোটো চাচা বললেন। ওর নামটা এক্ষুণি রেজিস্ট্রি করিয়ে আনো থানা থেকে। দিন কাল ভালো না। কাউকে বিশ্বাস নেই।

আম্মা আবার অত ইংরেজি কথার মানে-মতলব বোঝেন না। বললেন ও তাই-ই করাবো। তবে এত তাড়াতাড়ি কি? একটু পুরোনো-টুরোনো হোক— বছর খানেক কাজ কাম করুক তখন দেখা যাবে। হোটো চাচা বললেন : সে কি ভাবী! —পুরোনো হলেই তো ল্যাঠা চুকে গেলো। তার জন্যে আবার রেজিস্ট্রি কিসের?

আম্মা আর সে কথায় কান দিলেন না। জোরে জোরে ডাক দিলেনঃ শাকের—ও শাকের!--- শাকের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার পরনে লুঙ্গি আর কোমরে গামছা বাঁধা। আম্মা বললেনঃ বাইরে দোকান থেকে ভালো জর্দা নিয়ে আয় এক ভরি - এই পাঁচ টাকার নোট ভাঙ্গিয়ে। ছোটো চাচা ভয়ানক পান চিবোন। তার আবার ভালো জর্দা না হলে চলে না। আম্মার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে শাকের বেরিয়ে গেলো।

তারপর পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট করে সময় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু শাকেরের কোনো পাত্তাই নেই। কোথায় গেলো হতভাগা? রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা বাধিয়ে বসেনি তো! আমরা সকলেই ভাবনায় পড়লাম। আর তাছাড়া জর্দার দোকান তো কাছেই। এতক্ষণ ও কি করছে? এই সব সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় পাঁচ গজ পর্দার কাপড় কিনে হাজির হলো জনাব শাকের!

“ওরে হতভাগা! জর্দা কোথায়? তোকে পর্দার কাপড় আনতে কে বলল? গাধা কোথাকার।—ছোটো চাচা রেগে জিজ্ঞেস করেন।”

শাকের আম্মার দিকে তাকিয়ে বললঃ আপনিই তো বললেন, আম্মা। অপরাধীর মতো তার কণ্ঠস্বর।

“ও হতভাগা! আমি তোকে পাঁচ টাকার নোট ভাঙ্গিয়ে জর্দা আনতে বলেছি, না পাঁচ গজ পর্দার কাপড় আনতে বলেছি? বেআক্কেল কোথাকার!”

আমি বললামঃ যাক, যখন এনেই ফেলেছে তখন ওই কাপড়টা রেখে দাও—পরে কাজে লাগবে। তারপর শাকেরকে আবার খুচরো পয়সা দিয়ে বাইরে পাঠানো হলো। সে জর্দা নিয়ে এলো।

এই ঘটনার কিছুদিন পর। রান্নাঘরে কি করতে গিয়ে হঠাৎ পায়ের উপর গরম চায়ের কেলী উল্টে ফেলেছে ডালিয়া। ভাগ্যিস পানি খুব ফুটন্ত ছিলো না। তবুও পা-টা বেশ পুড়ে গেছে। আম্মা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেনঃ “যা তো বাবা শাকের, চট করে ওষুধের দোকান থেকে মলম নিয়ে আয়। তোর ডলি বু’র পা পুড়ে গেছে!”

হুকুম করলে সেটা আর তামিল করতে মোটেই ভুল হয় না। শাকের তাড়াতাড়ি গিয়ে মোরের দোকান থেকে ভালো দেখে একটা কলম কিনে নিয়ে এল। আম্মা তো হতভম্ব।

“হতভাগা, লোকের জান নিয়ে এদিকে টানাটানি--আর তুই কোন আক্কেলে দোকান থেকে কলম নিয়ে এলি? ফাজলামি পেয়েছিস?—”

আমি ছুটে এসে বলিঃ “আম্মা, বাড়ি থেকে কালা চাকরটাকে যত তাড়াতাড়ি পারো সরাও। তা না হলে আর চলছে না।”

তারপর ওর হাত থেকে পয়সা কেড়ে নিয়ে আমি সামনের ডিস্পেন্সারী থেকে পোড়ার মলম নিয়ে আসি। এই ধরণের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে আমাদের বাড়ি।

একদিনের ঘটনা। বৃষ্টির অবশ্য কোনো নাম-গন্ধ ছিলো না। কেননা এটা বৈশাখ মাস। প্রখর রোদ, সূর্যের তেজ খুব। হঠাৎ এরই মধ্যে কোথা থেকে কি করে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো হাওয়া আর বৃষ্টি। এই বৃষ্টি আর সেই বৃষ্টি। বনবন শোঁ-শোঁ কত রকমের আওয়াজ বাতাসের সাথে! তার সাথে আবার কড়কড়কড়াৎ মড়মড়মড়াৎ—বিদ্যুতের গর্জন।

একটু আগেই ওয়ারী থেকে খালা-আম্মা এসেছেন আমাদের বাড়ি। সঙ্গে এসেছে সুলতান, ফরিদ আর ফওজিয়া।

আমরা কয় ভাইবোন মিলে আম্মার কাছে আবদার করলামঃ এই বৃষ্টির দিনে গরম গরম পাঁপড় ভাজা খেতে খুব মন চাইছে।

আম্মা বললেনঃ “পাঁপড় তো নেই ঘরে। তবে তা করে চাল-ভাজা, মটর-ভাজা আর পেঁয়াজ কুচি তেল দিয়ে মাখিয়ে দেই- খা! --খুব ভালো লাগবে খেতে।”

 খালাতো ভাই সুলতান বললঃ “পাঁপড় আবার কি। এই সময় খিচুড়ী খেলে মন্দ হতো না।”

 এই কথায় ফওজিয়া, ডালিয়া, ফরিদ আর আমি আপত্তি জানালাম। আমরা কয়জন মিলে জিদ ধরলামঃ না, পাঁপড়ই খাবো।

অগত্যা আম্মা শাকেরকে ডাক দিয়ে বললেনঃ ছাতা মাথায় দিয়ে বাজার থেকে ভালো তেল আর কাচা পাঁপড় নিয়ে আয়। দেখ, কোননারকম ভুলচুক যেন না হয় --শাকেরকে ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

শাকের বললেঃ না, ভুলচুক কেন হবে আম্মা। যা বলবেন--তা-ই আনবো। এই বলে সে খুব দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লো।

আমরা তার কর্মতৎপরতা দেখে খুবই আনন্দিত হলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের আনন্দগুলি কর্পূরের মত উবে গেল। আম। সকলেই দেখলাম যে, শাকের একটা রঙিন ছিটের কাপড়ে বেঁধে গোটা দশেক বেল নিয়ে এসেছে। তার কাণ্ড দেখে খালা-আম্মা ততক্ষণে হাসতে আরম্ভ করেছেন।

আম্মা জিজ্ঞেস করলেনঃ কই রে গাধা তেল কই, আর পাঁপড়ই বা কোথায়? ছিটের রঙিন টুকরো আর বেল কয়টার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখাল শাকেরঃ এই যে!

আমি রেগে বলে উঠলাম : এই ঝড় বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মধ্যে বরফ দিয়ে বেলের শরবৎ করে দাও—খেয়ে সকলে নিউমোনিয়া বাধাই।

আম্মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেনঃ আল্লার নাম নে, হতভাগা। ওসব কি কুকথা মুখে আনছিস? আর এই হতভাগা চাকরটাই হয়েছে আমার যত সব অশান্তির কারণ। এই বেকুবটার জন্যেই ছেলেপিলেরা যত সব বাজে আর কুকথা মুখে আনছে। তারপর উনি বললেন হতভাগা কালা বুদ্ধু কোথাকার! সাহেব বাড়িতে আসলে তোকে কালই বের করে দেবো।

বৃষ্টি বাদল থেমে গেল। বিকেল বেলা আব্বা এলেন। রাত্রে খাওয়ার টেবিলে আম্মা শাকের সম্বন্ধে কথা তুললেন। বললেন: ওই কালাটাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। একটা বললে অন্যটা করে।

“অন্য একটা ভালো চাকর রাখো আব্বা।” আম্মার কথায় সায় দিয়ে আমি বললাম। এই কথা শুনে আব্বা ভয়ানক রেগে গেলেন। বললেন: ওকে কি আমি সাধে রেখেছি? ওর গুণের জন্যেই রেখেছি। সেটা তো আর তোমাদের মগজে ঢুকবে না। মুনিম সাহেব নিজে ওকে পাঠিয়েছেন।

আম্মা আর কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। একটু পরে আব্বা বললেন: “তোরা তো দেখতে পাস না। কালই তোদরকে চোখে গোঁজা দিয়ে দেখাবো। কই, তোর সিলভার ক্যাপ পার্কারটা কই?”

আমি তাড়াতাড়ি এনে সেটা আব্বার হাতে দেই। “আমাকে আর দিতে হবে না,”—আব্বা রেগে বলে ওঠেন, “ওটাকে আজ রাতে কল-ঘরের দরজার কাছে ফেলে আসবি। সকালে শাকের থালা-বাসন মাজতে যাবে। ওরই ভাগ্যে জুটবে কলমখানা।”

আম্মা বললেন: তা জেনে শুনে দামী কলমটা ওকে দিতে হবে?

আব্বা একটু নরম হয়ে বললেন: দিলেই বা।

যাই হোক, সেদিনকার মতো খাওয়া-দাওয়া সেরে খালা-আম্মারা চলে গেলেন। আমরাও দক্ষিণ হস্তের কার্য সমাধা করে সময় মতো ঘুমুতে গেলাম। পরদিন সকালে উঠতেই দেখি আমার ফাউন্টেন পেনটা হাতে নিয়ে শাকের হাজির: “মিয়াভাই, আপনার কলমডা যে কহন পইড়া গ্যাছে- খেয়াল রাহেন নাই। অত বেখেয়াল অইলে চলবো ক্যামনে?”

আব্বা একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলে উঠলেন: দেখলি। সাধে কি আর ওকে রেখেছি। এর আগেও একদিন মানিব্যাগ ফেলে পরীক্ষা করেছি-- তারপরে একদিন একশো টাকার নোট ফেলে পরীক্ষা করেছি। কাজেই একথা আমি জোর করেই বলতে পারি - আর যাই হোক, ছেলেটি চোর নয়। তার প্রমাণও পেয়েছি। আর মুনিম সাহেবও তাই বলছেন। আব্বা বলতে থাকেন, তবে কথা হলো যে, কানে সে একটু কালা। বেশ তো, তার জন্যে কি? ও হালেই কালা হয়েছে। চিকিৎসা করালে সেরে যাবে। ইতিমধ্যে আমি ওর কান পরীক্ষা করিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন, চিন্তার কারণ নেই। ভালো হয়ে যাবে।

আব্বা ওকে ডাকলেন। ডেকে পাঁচটা টাকা দিলেন। বললেন: এটা তোর বখশিশ। আর তুই সামনের দোকান থেকে আটা নিয়ে আয়। রুটির নাশতা খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরুবো। জরুরী কাজ আছে। শাকের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে একটা দুধ-আনা কেটলীতে কি যেন নিয়ে এলো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি অনলি রে হতভাগা?

শাকের হেসে বললে: কেন, মাঠা।

আব্বা শুনে হেসে উঠলেন: বেশ বেশ। তারপর আম্মাকে বললেন: নুন দিয়ে মাঠাটা তৈরী করে দাও। রুটি খাওয়ার আর দরকার নেই। মাঠা খেলে পেট ঠাণ্ডা হবে।

শাকের দু-পাটি দাঁত বের করে হেসে ঢুকে পড়লো রান্নাঘরে।

--

লেখক পরিচিতি- গোলাম রহমান (জন্ম: ২৮ নভেম্বর ১৯৩১ - মৃত্যু: ১২ জানুয়ারি ১৯৭২) বাংলাদেশের একজন শিশু-সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। শিশু সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

 

১৪৮৭ পঠিত ... ১৯:০৪, অক্টোবর ২১, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top