‘‘ওরা মাংস দিয়ে তৈরি।’’
‘‘মাংস?’’
‘‘হুম, মাংস। ওরা মাংসেরই তৈরি।’’
‘‘মাংস।’’
“কোনো সন্দেহ নাই। আমরা গ্রহটির ভিন্ন ভিন্ন অংশ থেকে ওদের বেশ কয়েকজনকে আমাদের জরিপ করার জলযানে তুলে এনে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। ওরা সম্পূর্ণটাই মাংস।”
“অসম্ভব! রেডিও সিগনাল কিভাবে আসে? মহাশূন্যে বার্তাগুলা কিভাবে আসল?”
“কথা বলার জন্য রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করেছিল, কিন্তু ঐ সিগনালগুলো ওদের কাছ থেকে আসছিল না। সেগুলো এসেছিল কোনো মেশিন থেকে।”
“তাহলে সেই মেশিনগুলো কে বানালো? তাদের সাথেই তো আমরা যোগাযোগ করতে চাই।”
“ওরাই মেশিনগুলো বানিয়েছে। এটাই তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। মাংসগুলোই মেশিন বানিয়েছে।”
“হাস্যকর ব্যাপার! মাংস কী করে মেশিন বানাবে? বুদ্ধিমান মাংসের গল্প বিশ্বাস করতে বলছো?”
“বিশ্বাস করতে তো বলছি না, যা সত্যি তাই জানাচ্ছি। এই জীবগুলোই ঐ অঞ্চলের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রজাতি এবং ওরা মাংসের তৈরি।”
“ওরা হয়তো ওরফোলেইদের মতো। তুমি তো এদেরকে চেনো, এরা কার্বন-নির্ভর বুদ্ধিমান জীব যারা জীবনে একটি মাংসীয় পর্যায় পার করে।”
“না। ওরা মাংস হয়েই জন্মে এবং মাংস হয়েই মারা যায়। আমরা ওদেরকে কয়েক প্রজন্ম ধরে পরীক্ষা করেছি, খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। মাংসের জীবনকাল কতো- এই ব্যাপারে তোমার কি কোনো ধারণা আছে?”
“ক্ষমা করো আমায়। ঠিকাছে, এমন তো হতে পারে যে- ওরা আংশিক মাংস। অনেকটা হয়তো ওয়েড্ডেলেইদের মতো। মাংসের মাথা কিন্তু ভেতরে একটি ইলেকট্রন প্লাজমার ব্রেন।”
“না। যেহেতু ওদের মাথাও ওয়েড্ডেলেইদের মত মাংসের, সেহেতু আমরাও ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখেছি। কিন্তু, তোমাকে আগেই বলেছি, আমরা বেশ ভালোমতোই ওদের পরীক্ষা করেছি। তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ সবই মাংসের।”
“নিশ্চয় ব্রেন নেই?”
“আরে, ব্রেন ঠিকই আছে। শুধু ব্যাপার হলো যে, ব্রেনও মাংসের তৈরি। এটাই তো তোমাকে এতক্ষণ বুঝানোর চেষ্টা করছি।”
“তাহলে… চিন্তাভাবনা করে কী দিয়ে?”
“তুমি আসলে ইচ্ছে করে বোঝার চেষ্টা করছো না, তাই না? আমি যা বলছি তা বারবার তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো। ব্রেন দিয়েই ওরা চিন্তাভাবনা করে। মাংস দিয়েই।”
“চিন্তক মাংস! চিন্তক মাংসের কথা বিশ্বাস করতে বলছো?”
“হ্যাঁ, চিন্তক মাংস! কনশাস মাংস! স্পর্শকাতর মাংস! স্বপ্ন দেখা মাংস! সম্পূর্ণ জিনিসটাই মাংস! তুমি কি সম্পূর্ণ ছবিটা ধরতে পেরেছো নাকি আমাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে?”
“হায় ঈশ্বর! তুমি তাহলে সত্যিই সিরিয়াস। ওরা মাংস দিয়ে তৈরি।”
“অবশেষে তোমাকে ধন্যবাদ! হ্যাঁ। ওরা আসলেই মাংস দিয়ে তৈরি। এবং ওদের সময়ের প্রায় একশ’ বছর ধরে ওরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে আসছিল।”
“হায় ঈশ্বর! মাংসগুলো কী চায় আমাদের কাছে?”
“প্রথমত, ওরা আমাদের সাথে কথা বলতে চায়। ধারণা করি, এরপর হয়তো মহাবিশ্ব সন্ধানে যেতে চায়, অন্যান্য বুদ্ধিমান জীবের সাথে যোগাযোগ করতে চায়, তথ্য ও তত্ত্ব আদানপ্রদান করতে চায়। এই ধরণের সাধারণ ব্যাপারই।”
‘‘মাংসের সাথে কথা বলবো আমরা?”
“সেটাই তো ওদের চিন্তাভাবনা। সেই বার্তাই ওরা রেডিওর মাধ্যমে পাঠিয়েছে। ‘হ্যালো। কেউ কি আছো? কেউ কি শুনছো?’- এই রকম বার্তা।”
“ওরা তাহলে সত্যিই কথা বলে। ওরা কি ওয়ার্ড, আইডিয়া, কনসেপ্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে?”
“অবশ্যই। এবং সবকিছু মাংস দিয়ে করে।’’
“তুমি তো মাত্রই বললে যে ওরা রেডিও ব্যবহার করে কথা বলে।”
“হ্যাঁ করে, কিন্তু সেই রেডিও বার্তায় কী থাকে বলে তোমার ধারণা? মাংসের ধ্বনি। মাংসে মাংসে ঝাপটা দিলে কী ধরনের ধ্বনি সৃষ্টি হয়- তা তো তুমি জানোই, তাই না? ওরা নিজেদের মাংসে মাংসে ঝাপটা দিয়ে দিয়ে কথা বলে। ওরা এমনকি তাদের মাংসের মধ্য দিয়ে সজোরে বাতাস বের করে গানও গাইতেও পারে।”
“হায় ঈশ্বর! গায়ক মাংস! এতো কিছু একসাথে মেনে নেওয়া কঠিন। তাহলে এদের ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কী?”
“আনুষ্ঠানিক নাকি অনানুষ্ঠানিক?”
“দু’টোই।”
“আনুষ্ঠানিকভাবে, সব ধরনের সংস্কার, ভয়ভীতি কিংবা পক্ষপাত একপাশে সরিয়ে রেখে মহাবিশ্বের এই অংশের যে কোনো বুদ্ধিমান প্রজাতি বা স্বত্বার সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং আমাদের তথ্যকেন্দ্রে ওদের ব্যাপারে তথ্য ঢুকিয়ে নেয়া। কিন্তু আমার অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ হলো, আমরা ওদের সব তথ্য মুছে দিয়ে পুরো ব্যাপারটাই ভুলে যাই।”
“তুমি এমনটাই বলবে, এটাই আশা করেছিলাম।’’
“কথাটা খারাপই শোনাচ্ছে, কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। আমাদেরকে কি শেষমেশ মাংসের সাথে যোগাযোগ করতে হবে?”
“তোমার সাথে শতভাগ সহমত প্রকাশ করলাম। কী বলবো ওদেরকে? ‘হ্যালো, মাংস। কেমন চলছে সবকিছু?’ কিন্তু এই বুদ্ধিটা কি কাজ করবে? এইভাবে আর কত গ্রহের সাথে ডিল করব?”
“কেবল একটাই। বিশেষ মাংসের কৌটায় করে ওরা অন্য গ্রহে যেতে পারে, কিন্তু সেখানে বসবাস করতে পারে না। এবং ওরা মাংস হওয়ার কারণে, শুধুমাত্র সি স্পেসের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে পারে, যা ওদেরকে আলোর গতিসীমার মধ্যে বেঁধে রাখে। ফলত, অন্য বুদ্ধিমান জাতির সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাবনাও খুবই কম। সত্যি বলতে, একেবারেই কম।”
“তাহলে আমরা এমন ভাব দেখাবো যেন মহাবিশ্বে আর কেউই নেই?”
“ঠিক তাই।”
“কী নিষ্ঠুর! কিন্তু তুমি নিজেই বলেছো, কে মাংসের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইবে? এবং যে মাংসগুলোকে জাহাজে তুলে এনে পরীক্ষা করা হয়েছে, তাদের কী হবে? তুমি কি নিশ্চিত যে ওরা কোনো কিছু মনে করতে পারবে না?”
“যদি মনে পড়েও, তখন তাদের পাগল বলেই গণ্য করা হবে। আমরা ওদের মাথায় ঢুকে ওখানকার মাংসগুলো এমনভাবে ঠিকঠাক করে দিয়েছি যে আমরা ওদের কাছে কেবলই একটা স্বপ্ন।”
“মাংসদের স্বপ্ন! কেমন অদ্ভুত ব্যাপার হল চিন্তা করো, আমরা শুধুমাত্র মাংসদের কাছে স্বপ্ন হয়ে থাকব।”
“এবং আমরা পুরো অঞ্চলটিকে অদখলিকৃত হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছি।”
“বেশ। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবেও তোমার সাথে একমত হলাম। মামলা খতম। আচ্ছা, আর কেউ আছে? ছায়াপথের এই প্রান্তে অনুসন্ধানী আর কারো খোঁজ মিলেছে?”
“হ্যাঁ, G445 মণ্ডলের নবম শ্রেণীর নক্ষত্রের একটি খুবই লাজুক কিন্তু মিষ্টি হাইড্রোজেন-কেন্দ্রিক গুচ্ছ-বুদ্ধিমত্তা আছে। দুই ছায়াপথীয় আবর্তনকাল পূর্বে যোগাযোগ করেছিল, এরা আবার বন্ধুত্বও করতে চায়।”
“এরা সবসময়ই ফিরে ফিরে আসে।”
“এবং ফিরবে না কেন? একবার চিন্তা করে দেখো, এই মহাবিশ্বটা কেমন অসহনীয় ও অসহ্য-রকমের বিষন্নতায ভরে থাকতো যদি আমরা সম্পূর্ণ একলা হতাম…’’
[টেরি বাইসনের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ সালে। তিনি মূলত সাইন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি ফিকশন লেখেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই ‘‘বিয়ারস ডিসকভার ফায়ার’’। বিয়ারস ডিসকভার ফায়ার গল্পগ্রন্থের জন্য উনি হিউগো অ্যাওয়ার্ড এবং নেবুলা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ‘ওরা মাংস দিয়ে তৈরি’ তার আলোচিত গল্পগুলোর একটি।]
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন