নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালের গেটে একটা ছোট্ট জটলা। হেভি গ্যাঞ্জাম বেধেছে সেখানে। হলুদ পাঞ্জাবির হিমু গ্যাঞ্জামের হোতা। পাশে দাঁড়িয়ে রাগে গজরাচ্ছে বাদল। তার শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। সে তার হিমু ভাইয়ের নির্দেশ পাওয়ামাত্রই সিকিউরিটি গার্ডের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। ঘটনা হলো, তাদেরকে হাসপাতালে ঢুকতে দিচ্ছে না দশাশই চেহারার কালো সিকিউরিটি গার্ড।
‘আমি বলছি যে আপনি এমন খালি পায়ে হাসপাতালে ঢুকতে পারবেন না। আমাদের নিয়ম নাই। খালি পায়ে ডিজিজ স্প্রেড হওয়ার অশঙ্কা থাকে। পা ধুয়ে জুতা পায়ে আসুন।’ কড়া গলায় বলল সিকিউরিটি। নেমপ্লেটে তার নাম দেখা যাচ্ছে উইলিয়াম। হিমু উদাস ভঙ্গিতে তাকাল আকাশের দিকে। নিউইয়র্কের আকাশে তখন ঝকঝকে রোদ। এমন রোদ ঢাকায় হলে তাকে বলা যেত পিচগলা রোদ। কিন্তু নিউইয়র্কের রাস্তা মনে হয় স্পেশাল পিচে তৈরি। পিচে এরা দুই নম্বরি করেনি, তাই এত সহজে গলবে মনে হচ্ছে না।
হিমুর মনটা আজ বিশেষ খারাপ। হুমায়ূন স্যার অনেক দিন হয় অসুস্থ। গত মাসে তাকে জরুরি তলব করেছেন। আসি আসি করেও আসা হয়ে ওঠেনি এত দিন। গত একটা মাস এক গাছ বাবার সন্ধানে বাদলকে নিয়ে কড়াইল বস্তিতে ঘাপটি মেরে থাকতে হয়েছিল তার। বাদল সিকিউরিটির পণ্ডিতি আর সহ্য করতে পারছিল না। বলল, ‘হিমু ভাই, দিই একটা থাবড় ব্যাটাকে? কত বড় সাহস, স্যারকে দেখতে দেবে না। আরে হাসপাতাল কি তোর বাপের? খালি অনুমতি দেন একবার। থাবড়া দিয়ে শোয়ায়ে দেব না ব্যাটাকে।’ হিমু বলল, ‘শান্ত হ বাদল। থাপড় ট্রিটমেন্টে এর কাজ হবে না। অন্য ট্রিটমেন্ট দিতে হবে।’ বাদল বলল, ‘তাইলে হিমু ভাই একে জয়েন্ট লক ট্রিটমেন্ট দেন। এমন ট্রিটমেন্ট, যেন ব্যাটা আর কোনো দিন হাত-পায়ের জয়েন্ট না নাড়াতে পারে। লক ছুটাতে যেন ম্যাডিসন স্কয়ারে এসে আপনার পা ধরে বসে থাকে।’ হিমু আবার এগিয়ে গেল সিকিউরিটির দিকে। একটা রহস্যময় হাসি তার মুখে। বলল, ‘জনাব উইলিয়াম, আপনি কোন থানার আন্ডারে?’ উইলিয়াম বলল, ‘জ্যামাইকা থানা।’ ‘জ্যামাইকা থানার ওসি কে?’ ‘সেটা জেনে আপনার কী?’ ‘কালা আদমি তোর কত বড় সাহস। হিমু ভাইয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলিস। কোনো আদব-কায়দা নেই। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’ বলে বাদল প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সিকিউরিটির ওপর। হিমু তাকে ঠেকাল অনেক কষ্টে। একটু দূরে ঘাড় গুঁজে সিগারেট ফুঁকছিলেন খাটো করে এক মধ্যবয়সী লোক। তিনি এগিয়ে এলেন জটলার দিকে। বললেন, ‘এভাবে হবে না হিমু, তুমি রূপাকে ফোন দাও। তার বাবা প্রভাবশালী আছে। একটা ফোন করে দিলেই আমাদের ঢুকতে দেবে।’ হিমু অবাক হয়ে দেখল লোকটা তার পরিচিত। মিসির আলী। তাকেও হুমায়ূন স্যার জরুরি তলব করে পাঠিয়েছেন, ‘আর বলো না হিমু, আমি একা মানুষ, বাসার কাজের ছেলে রতনটার জ্বর। এর ভেতর হুমায়ূনের জরুরি তলব। রতনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়ে ফ্লাইট ধরতে হলো। এত লম্বা ফ্লাইট হাত-পায়ে একেবারে ঝিঁঝি ধরে গেছে। যাই হোক, সময় বেশি নাই। তাড়াতাড়ি ঢুকতে হবে। তুমি রূপাকে ফোন করার ব্যবস্থা করো।’
তিনজনের দলটি বেলভিউ হাসপাতালের সামনে থেকে নেমে এল রাস্তায়। সূর্যের আলোয় হাঁটছে তিন যুবক একটা টেলিফোনের দোকানের খোঁজে। একটু যেতেই তিনজনের এই দলটির সঙ্গে দেখা হলো মোটা ফ্রেমের চশমার এক যুবকের সঙ্গে। তার হাতে একটা মোটা বই। হন্তদন্ত হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল শুভ্র। তাদের দেখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে হিমু ভাই, বাদল ভাই। মিসির আলী স্যার, সালাম। কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?’ মিসির আলী বললেন, ‘ওয়াআলাইকুম সালাম শুভ্র। এখন কথা বলার সময় নাই। তুমি কি বলতে পার আশপাশে কোথায় ফোনের দোকান আছে নাকি?’ শুভ্র বলল, ‘জি, স্যার আছে। আমার পরিচিত একটা ওষুধের দোকার আছে। গ্রিন ফার্মেসি। তাদের ওখানে ফোন করা যায়। চলেন যাই।’ গ্রিন ফার্মেসির দিকে হাঁটতে হাঁটতে শুভ্র অনেকটা আপনমনেই বলল, ‘আমি এসেছিলাম স্ট্যানফোর্ডের একটা সেমিনারে। কোয়ান্টাম মেকানিকসের ওপর আমার একটা গবেষণা ছিল, সেটা নিয়ে। কাল বিকেলে হুমায়ূন স্যার আমাকে জরুরি তলব করেছেন। বলেছেন, আমাকে একটু দেখতে চান। যেন অবশ্যই হাসপাতালে আসি। তাই যাচ্ছিলাম।’ কথা বলতে বলতে তারা পৌঁছে গেল গ্রিন ফার্মেসির সামনে। ফার্মেসির মালিক ছেলেটি বাংলাদেশি। সে তার দোকানের সামনে হিমু আর বাদলকে দেখতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। এটা কি স্বপ্ন না সত্যি! হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল হিমুর পায়ের ওপর, ‘হিমু ভাই, আমাকে চিনতে পারেন নাই। আমি খায়ের। আমি ফকিরাপুলের খায়ের। ওই যে একবার টহল পুলিশ ধইরা ছেচনি দিল, আপনে সেদিন না থাকলে আমারে ক্রসফায়ারে দিয়ে দিত শিউর। আপনে আমার জান বাঁচাইছিলেন।’ হিমু বলল, ‘হ্যাঁ, খায়ের চিনতে পেরেছি। তুমি এখানে কী কর? আমেরিকা আসলা কবে?’ খায়ের বলল, ‘সে এক হিস্টোরি হিমু ভাই...’
তাদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিসির আলী বললেন, ‘হিমু, আগে ফোন, পরে খাজুরা আলাপ করো।’ বাম হাতের কবজিটা ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে একটু খুকখুক করে কেশে তিনি যোগ করলেন, ‘আমাদের হাতে সময় বেশি নাই।’ শুভ্র খায়েরকে বলল, ‘খায়ের ফোনটা দাও। হিমু ভাই রূপা ম্যাডামকে ফোন করবেন।’ খায়ের তাড়াহুড়া করে ফোনটা এগিয়ে দিল হিমুর দিকে। হিমু রূপার ঢাকার টিঅ্যান্ডটি নম্বরে ফোন করল। ওপাশে ফোন ধরল রূপার বাসার কাজের বুয়া, ‘আফা তো বাসায় নাই। বিদেশ গেছে কাইলকা। আম্রিকা। আর বইলা গেছে আপনে ফোন করলে যেন তার মোবাইলে ফোন করেন।’ হিমু জানে রূপার ফোন রোমিং করা থাকে। তাই ঢাকার মোবাইল ফোন নম্বরেই ডায়াল করল হিমু, ‘হ্যালো রূপা, আমি হিমু। তুমি কোথায়?’ ওদিক থেকে রূপা বলল, ‘হিমু আমি তো বেলভিউ হাসপাতালে। হুমায়ূন স্যার জরুরি আসতে বলেছেন আমাকে। তুমি কোথায়?’ ‘আমিও তো নিউইয়র্কে। স্যার আসতে বলেছেন। বেলভিউর সামনে গিয়েছিলাম। কিন্তু খালি পা দেখে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না সিকিউরিটি গার্ড। তুমি কি একটু ব্যবস্থা করবে? আমার সঙ্গে বাদল, শুভ্র আর মিসির আলী স্যারও আছেন।’ রূপা বলল, ‘ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করছি। তোমরা হাসপাতালের সামনে আস।’ চারজনের দলটি আবার হাঁটতে শুরু করল হাসপাতালের দিকে। এবার হাসপাতালের গেটে বেশ বড় একটা জটলা। দ্রুত পায়ে সবাই সেখানে পৌঁছে দেখে, সিকিউরিটি গার্ডের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে আর বদি পাশে দাঁড়িয়ে তাকে শাসাচ্ছে, ‘ব্যাটা সিকিউরিটি, দেখ মাইরের মধ্যে কেমন ভাইটামিন থাকে। বদ কোথাকার। ঢুকতে দেবে না। বাকের ভাই চলেন, ভেতরে চলেন।’
বাকের ভাই ডান হাত দিয়ে দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে চেইন ঘোরানো বন্ধ করলেন। সিকিউরিটির দিকে একটা কড়া লুক দিয়ে যেই ভেতরে ঢুকতে যাবেন, তখন পো পো শব্দ করে এনওয়াইপিডির একটা গাড়ি এসে থামল হাসপাতালের গেটে। আর ঠিক তখনই রূপা নিচে নেমে এসে একনজরে পুরো ঘটনা বুঝে ফেলল। তার সঙ্গে থাকা এফবিআইয়ের এজেন্টকে বুঝিয়ে বলল কী করতে হবে। পুলিশ আর সিকিউরিটির দায়িত্ব এজেন্টটির কাঁধে দিয়ে রূপা সবাইকে নিয়ে ঢুকে গেল হাসপাতালে। বলল, ‘স্যারের অবস্থা ভালো নয়। একটু আগে জ্ঞান ফিরে এসেছে। আপনাদের খুব করে দেখতে চাইছিল।’ এই করিডর সেই করিডর করে অবশেষে তারা পৌঁছাল আইসিইউতে। ভেতরে ঢুকেই হিমু বলে উঠল, ‘খাইছে।’ হাজার হাজার যন্ত্রপাতি, স্যারের মুখে গাদাখানের নল ঢোকানো, মনিটরে লাল-নীল নানান বাতি জ্বলছে-নিভছে। স্যারকে এ অবস্থায় দেখবে কল্পনা করেনি সে। রুমটার ভেতর ছোট-বড় ২০-৩০ জন লোক। কে নেই। ওই তো এক কোনায় একটা নীল তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে তিথি। টগর আর নিশা কাঁচি দিয়ে বেডের সাদা চাদর কাটাকুটি করছে। বিলু আর মিলু দুই বোন লাল চোখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়। বোঝাই যাচ্ছে, সারা রাত কান্নাকাটি করেছে। অনিল বাগচি কী করবে বুঝতে না পেরে পাশে রাখা সোফাটায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে। মহাবিজ্ঞানী ফিহা গভীর মনোযোগ দিয়ে বিপি মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন। মাজেদা খালা একটা প্লেটে কাউনের জাউ নিয়ে বসে আছেন। স্যার খেতে চেয়েছিলেন নাকি কয়েক দিন আগে। ফুপার চোখ লাল। মেঝেতে কাচের বয়াম হাতে বসে আছে একটা ছেলে। সে এই বয়ামে করে নাকি একটা ভূত নিয়ে এসেছে। টগর ও নিশার বাবা আনিস একটা চেয়ার টেনে স্যারের মুখের কাছে বসে কথা বলছেন। মামাও আছেন তার পাশে। বল্টু বসে আছে স্যারের পায়ের কাছে। ওই তো দেখা যাচ্ছে মীরাকে। সেও কাঁদছে। তিতলি আর কঙ্কা ভয়ে হাত ধরে বসে আছে একে অপরের। সোফায় বসে আছে টুনি, নিবারন, কাদের, হানিফ, এলাচি, লবঙ্গ ও মুনা। হিমুদের দলটা ঢুকতেই অনেক কষ্টে উঠে বসলেন হুমায়ূন আহমেদ। শরীর আর মুখ থেকে খুলে ফেললেন সব নল। বললেন, ‘তোমরা সবাই এসেছ তাহলে। হিমু কী খবর? মিসির আলী সাহেব, এরা আমাকে কী কেমো যে দিল, সব লজিক তো উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় হেলুসিনেশন হচ্ছে। বাকের, মাস্তানি কেমন চলছে? বদি, চামচামি ছেড়ে এবার একটু নিজের পায়ে দাঁড়াও। আর কত বাকেরের পিছু পিছু থাকবে? আরে শুভ্র নাকি? হাতে কী এটা? কী বই?’ শুভ্র এগিয়ে এল। বলল, ‘স্যার, সার্নের এলএসসি নিয়ে বই। আপনার জন্য এনেছি। প্রোটন কণার সংঘর্ষে কীভাবে সব উল্টেপাল্টে গেল, সেটা নিয়ে। আপনি পড়লে মজা পাবেন।’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এনেছ যখন দাও। খুবই ইন্টারেস্টিং হবে মনে হচ্ছে। তবে আমি তো পড়তে পারব না। চলে যাচ্ছি অনন্ত নক্ষত্র বীথির জগতে। সেই জগতে পড়াশোনার সিস্টেম আছে কি না জানি না। থাকলে তো ভালো। যাওয়ার আগে তোমাদের সবাইকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম, তাই এই জরুরি তলব। বিশেষ কিছু না। তোমরা সবাই ভালো থেকো।’
মহামতি ফিহা একটু চিন্তিতভাবে বললেন, ‘হুমায়ূন, আপনি কথা বলবেন না। একটু রেস্ট নিন। আপনার বিপি কিন্তু কমে যাচ্ছে।’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘ফিহা, মনিটরে না তাকিয়ে থেকে এখানে এসে একটু বসুন, কথা বলি। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এই টান কেউ আটকাতে পারবে না। আচ্ছা, আপনার সময় সমীকরণ কী বলে, দরজার ওপাশেও কি সময় এমন চলমান থাকবে, নাকি স্থির হয়ে যাবে?’ ফিহা বললেন, ‘প্লিজ, কথা বলবেন না হুমায়ূন।’ একটু চুপ থেকে হুমায়ূন আহমেদ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘যাওয়ার আগে একটা অনুরোধ করে যাই তোমাদের সবাইকে। শোনো, মৃত্যু খুবই অবধারিত একটি ঘটনা। আমি মারা যাওয়ার পর প্লিজ কেউ কান্নাকাটি কোরো না। তবে আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে। বর্ষা আসবে, জোছনা হবে। কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকবো না। জোছনা দেখার জন্য আমি থাকবো না। এই জিনিসটা আমি মোটেও নিতে পারি না। কিন্তু কি আর করা! দয়াল ডাক দিয়াছেন। যেতে আমাকে হবেই। আচ্ছা রূপা তুমি কি আমাকে একটা গান গেয়ে শোনাতে পারবে...ওই যে...মরিলে কান্দিস না আমার দায়...গানটা...’
এক অসীম হাহাকারের মাঝে বিষাদের প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল রূপার গলা। কাঁদতে কাঁদতে সে গাইতে লাগল, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়...ও জাদু ধন...মরিলে কান্দিস না আমারা দায়...’ বিপির মনিটরে উঠতে থাকল ৫০...৩০...২০...১০। তারপর একসময় সব থেমে গেল সব।
হিমু ছাড়া রুমের আর কেউ কথা রাখতে পারল না। কাঁদতে লাগল হুহু করে। হিমু আস্তে করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। না সে কাঁদছে না। হুমায়ূন স্যার তাকে কখনো কাঁদতে শেখায়নি। হিমুরা কখনো কাঁদে না।
পাঠকের মন্তব্য ( ২ )
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন