দাদুর কুড়িয়ে পাওয়া আদুরে বেড়ালটার শেষমেশ যা ব্যবস্থা হলো

২১৮০ পঠিত ... ১৭:৪৭, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২০

ভোরবেলা হরি-নারায়ণঅ, হরি-নারায়ণঅ, বলতে বলতে দাদু আমাদের ঘরের সামনে এসে রোজ যেমন দাঁড়ান তেমনি দাঁড়ালেন। রোজকার মতই আকাশে তখন সবে আলো ফুটছে। একটা কি দুটো পাখি ঘুমচোখে আমার পড়া মুখস্ত করার মত কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ডাকছে। দাদুর ওজন ভরা বাতাস বইছে। বাতাস অবশ্য নেই আজ। শেষ রাতে তেড়ে বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশ মেঘলা। শুয়ে শুয়ে, চোখ পিট পিট করে আমি আকাশ দেখে নিয়েছি।

চারপাশ নিস্তব্ধ গুমোট। দাদু রোজ যেমন ডাকেন সেই রকম ভারি ভাবগম্ভীর গলায় ডাকলেন, খোকা উঠে পড়। আমি এগোচ্ছি, দাদুর গলা শুনে বাবা রোজ যেমন ঘুমচোখে পাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আমার ডান কানটা ধরে বার কতক নেড়ে দেন সেই রকম নেড়ে দিলেন। আমি রোজ যেমন ধড়মড় করে উঠে বসে, দু’হাটুতে মাথা গুজে বলি, যান, আসছি ঠিক সেই রকমই বলে, সামনে পেছন দুলুনে চেয়ারের মত দুলতে লাগলুম। এই ভাবে দুললে ঘুম মাথা ছেড়ে পায়ের দিকে নেমে যায়। এই সময়টায় রোজ আমার যেমন হিংসে হয় তেমনি হল। বাবা কেমন আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবেন। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে অঙ্ক করেন, তাই দাদু তাকে ঘুমোবার অনুমতি দিয়েছেন। আমি রাতে জাগতেও পারি না, জাগার অনুমতিও নেই। দাদু বলেন, বৃদ্ধ আর শিশু হল পাখির মত। ভোরে উঠে কলরব করবে। দাদু যেমন হরি নারায়ণঅ, হরি নারায়ণঅ করছেন। আমি বলেছিলুম, তা হলে ত পাখির মত সন্ধ্যে বেলাই শুয়ে পড়া উচিত। না, তা হবে না। এ পাখি হল প্যাঁচা আর কাকের মিশ্রণ। রাত দশটা পর্যন্ত হুতোম প্যাচ। ডানা মুড়ে, লাল চোখে টেবিলের সামনে। খোলা বই। মাস্টার মশাই। কিন্তু ভোরে কাক। এ পাখি, নতুন জাতের পাখি—প্যাঁকাক ।

দাদুর পরনে ন-হাতি পট্টবস্ত্র। ধবধবে বিশাল বুকে ইয়া মোট সাদা পইতে পায়ে খটাস খটাস খড়ম। হাতে বেতের সাজি। আর এক হাতে অর্ডার দিয়ে তৈরি করানো অ্যালুমিনিয়ামের আঁকসি। বাঁশের আঁকসি রোজ রোজ খুলে যায় বলে, বাবার প্ল্যানে এটা তৈরি করে দিয়েছেন দাদুর এক মক্কেল। ইচ্ছেমত বড় ছোট করা যায়। স্বর্ণ চাপা গাছ থেকে যখন ফুল পাড়া হবে আঁকসি তখন বড় হবে। রক্তকরবীর কাছে এসে একটু ছোট হবে, টগরে এসে আরও ছোট। বাড়ি ঢোকার সময় ছাতার মাপ। আমি দাদুর ফুল তোলার সঙ্গী। ফুল তোলার পর এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দাদু আমাকে ছোটাবেন কিছুক্ষণ। তারপর কান ধরে কুড়িবার ওঠ-বোস। আমার বয়েসে দাদুর নাকি ওজন ছিল চল্লিশ সের।

আমি যখন বাগানে গেলুম দাদুর সাজিতে ততক্ষণে জবা কিছু টগর আর গুলঞ্চ মুখ বার করে বসে আছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছেলেরা যেন ফোলা ফোলা মুখে টাব-গাড়ি চেপে চলেছে। আমি যেতেই দাদু বললেন, মিলিটারিতে কি নিয়ম জানো? ফল-ইন বললেই সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। একটু দেরি হলেই সাজা । পিঠে ওজন নিয়ে সাত মাইল দৌড়। কি করছিলে এতক্ষণ?

রোজ যা হয় তাই হয়েছিল; আমি খাটের দেয়ালের দিকে, বাবা ধারের দিকে পা না সরালে নামি কি করে? গুরুজনকে ডিঙিয়ে নামতে নেই। শাস্ত্রে আছে। বললুম, পায়ে আটকে গিয়েছিলুম।

দাদু কি শুনলেন জানি না। বললেন, ‘ভেরি গুড ব্যায়ামের ফল ফলবেই; পা বড় হচ্ছে। মানুষের বাড় তো পায়ের দিক থেকেই হয়। গাছের মতো আর কি! নিচের দিক থেকে ওপর দিকে বেড়ে ওঠে। সজনে ডাঁটা, বটের ঝুরি, মাথার চুল, দাড়ি এ সব বাড়ে নিচের দিকে! মানুষ বাড়ে ওপর দিকে।

কথা বলতে বলতে দাদু আঁকসিটা বড় করে ফেললেন। তার মানে এইবার স্বর্ণ চাঁপার ওপর আক্রমণ চলবে। বাগানে পাশাপাশি দুটো চাঁপা গাছ। গেটের দু’পাশে লম্বা প্রহরীর মত সোজা দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষাকাল। তলায় বড় বড় ঘাস হয়েছে। পাত-টাতা পড়েছে অনেক । দাদু একটা কথা প্রায়ই বলেন, সাবধানের মার নেই, মারের সাবধান নেই। আজও তাই বললেন। বলে আঁকসি দিয়ে ঘাসের ঝোপ জ্বলিয়ে দিলেন। ঘাসে সাপ থাকতে পারে। খোঁচা মেরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তিনবার হরিনারায়ণঅ বলতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ। তিনি জেগে থাকলে প্রথম খোঁচাতেই ফোঁস করে বেরোবেন। ঘুমিয়ে থাকলে শেষ হরিনারায়ণেই ফণা তুলে উঠবেন।

ঘাস-ঝোঁপ তুলে উঠল আর ফোঁস শব্দ নয় অস্পষ্ট একটা মিউ ডাক শোনা গেল। দাদুর কাঁধে পালোয়ানের লাঠির মত আঁকসি, হাতে সাজি, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, কিছু শুনতে পেলে?

'আজ্ঞে হ্যা, মিউ।'

দাদু আরও ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘এদিকে এসো'!

এগিয়ে গেলুম। দাদু জিজ্ঞেস করলেন, 'ওটা কী?'

ঘাস আর পাতার আড়ালে ছোট্ট একতাল তুলোর মত একটি বেড়ালছানা। এত ছোট যেন চীনে বাদামের খোলার মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। শেষ রাতের বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।

‘তুলব দাদু!’

'নিশ্চয় তুলবে। জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর'।

'মা কিন্তু বেড়ালের নাম শুনলে তেলে বেগুনে জলে যায়। দেখলে কি হবে বুঝতে পারছেন ?'

'ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি আগে ওটাকে তোল?'

তৃণশয্যা থেকে ভিজে বেড়ালছানাটাকে বুকে তুলে নিলুম। ধবধবে সাদা। প্রায় মরেই এসেছে। ঠাণ্ডায় চোখদুটো বুজে আছে। খুলতে পারছে না। ডাকার শক্তি নেই। গায়ে ছিট ছিট কাদা লেগে আছে। দাদু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, 'শয়তান!'

'কে শয়তান দাদু?'

'যে এ বেড়াল শিশুটিকে এই ভাবে এখানে ফেলে দিয়ে গেছে। সারারাত নিজে শুয়ে রইল নরম বিছানায় পাতলা চাদর মুড়ি দিয়ে। আর এই জীবটাকে ফেলে রেখে গেল মৃত্যুর মুখে। ভগবানের আদালতে তোমার বিচার হবে । তুমিও বেড়াল হবে। তোমার মত আর এক শয়তান এই ভাবে ফেলে রেখে যাবে। আর তখন আমি তোমাকে তুলব না।’

'কি করে বুঝবেন দাদু যে, সেই বেড়ালটা বেড়াল-রূপী শয়তান?'
'দেখলেই বুঝতে পারব। ঘুটঘুটে কালো রং, বুরুশের মত লোম, কর্কশ গলা । সে আমি দেখলেই চিনব।’

‘বাবা কিন্তু ওসব একেবারেই বিশ্বাস করেন না।’

'তোমার বাবা ঘোড়ার ডিম জানে। অঙ্ক ছাড়া কিছুই জানে না। ভূত আছে কিনা তাই জানে না। বলে ভূত আবার কি আমি ম্যাথমেটিশিয়ান। প্রমাণ ছাড়া কিছু মানতে রাজি নই। তাহলে তোমার অঙ্কশাস্ত্রের শূন্যটা কি? শূন্যর কোনো প্রমাণ আছে? তুমি বড় তর্ক কর! ঠিক বাপের ধাতটি পাচ্ছ। নাও, ওর বুকের কাছে কানটা ঠেকিয়ে দেখ তো ধুকপুক করছে কিনা?'

বেড়ালটাকে এতক্ষণ বুকের কাছে চেপে ধরেছিলুম। জামাটা ভিজে উঠেছে। সামান্য নড়াচড়া করছে যখন, বোঝাই যায় বেঁচে আছে। আবার কান লাগিয়ে নোংরা করি কেন? 'বেঁচে আছে দাদু! নড়াচড়া করছে।' বেড়ালটা ঠিক এই সময় আমার বুকের কাছে আর এক বার মিউ করে উঠল। ঠাণ্ডায় চোখ জুড়ে গেছে। পৃথিবীকে দেখতেই পাচ্ছে না। আমাকে তো নয়ই। তবু মুখটা আমার মুখের দিকে তুলে এমন করুণ স্বরে মিউ করে উঠল! ভীষণ মায়া লাগল। মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে এনে বৃষ্টির রাতে আমাদের বাগানে চুপি চুপি ফেলে দিয়ে যে চলে গেছে সে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর। দাদুর আদালতে তার নামে মামলা করা উচিত। মিউ ডাকে বেড়ালটা যেন বলতে চাইছে, তোমাদের হাতেই আমার জীবন মৃত্যু-- বাঁচালে বাঁচব, মারলে মরব। ইস, রাতে কুকুরেও তো মেরে ফেলতে পারত!

দাদু বললেন, 'নাও ওকে ভেতরে নিয়ে চল। হট্ ব্যাগ দিতে হবে। হট-বাথ করাতে হবে।’

'ভেতরে নিয়ে যাব কি করে দাদু? কুকুর আছে না?'

'হ্যাঁ তাই তো! আমি তখনই তোমার বাবাকে বলেছিলুম, কুকুরটুকুর না পোষাই ভাল। এক বাড়িতে কুকুর আর বেড়াল রাখা যায় না। জন্মশত্রু!'

'না দাদু, তখন ও কথা আপনি বলেননি। বলেছিলেন, কুকুর মানুষের বেস্ট ফ্রেন্ড। প্রত্যেক সভ্য মানুষের কুকুর পোষা উচিত। আর তখন আমাদের বাড়িতে কোনও বেড়াল আসেনি।’

দাদু রেগে গিয়ে বললেন, 'তোমার সঙ্গে আমি এই জীবন-মরণ সমস্যার সময় তর্ক করতে চাই না। আমাকে একটা রাস্তা বের করতে হবে।'

'কি রাস্তা বের করবেন দাদু? একে নিয়ে বাড়ি ঢুকলেই আমাদের টম সঙ্গে সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে ফেলবে।’

‘হ্যাঁ, করলেই হল? করে দেখুক না! মেরে শেষ করে দেব।'

‘মা তো বলেন, আমরা দু’জনেই নাকি আপনার আদরে বাদর হয়ে গেছি।'

'আদরে বাদর হয় না, মানুষ হয়। তোমার মা তোমার বাবার মতই। সবজান্তা।’

রাস্তা দিয়ে ব্ৰঙ্কাইটিসের কাশি কাশতে কাশতে নেত্যকালীবাবু প্রাতভ্রমণে চলেছেন। প্রতিবার কাশির ধমক থামলে তিনি একবার ‘ওরে বাবা’ বলে গোটা কতক কথা বলেই আবার কাশিতে চলে যান।

তার মানে ব্যাপারটা এইরকম দাড়ায়, কাশি, ওরে বাবা, কথা, কাশি, ওরে বাবা, কথা।

রোজ আমাদের বাড়ির সামনে এসেই নেত্যকালীবাবুর এক কাশির দমক আসবে। আজও তাই এসেছে। সামনে ঝুঁকে পড়ে কাশছেন। দাদু যেন আশার আলো দেখলেন। অন্যদিন নেত্যবাবু কথা বলতে চাইলেও দাদু, হা, আচ্ছা, আচ্ছা করে এড়িয়ে যান। আজ নিজেই এগিয়ে গিয়ে ডাকতে লাগলেন, ও নেতা, নেতা। নেত্যবাবুর কাশি তখনও চলছে। একটা হাত তুলে বোঝাতে চাইলেন, শুনেছি, শুনেছি, উত্তর দিচ্ছি। দাদুর তো সবেতেই অধৈর্য। মুখ দেখলেই বোঝা যায় গলা টিপে কাশি থামাবার ইচ্ছে হচ্ছে। অবশেষে থামল। সোজা হয়ে নেত্যবাবু বললেন, 'ওরে বাবা, কি বল?'

'একটা বেড়াল বাচ্চা নেবে?'
'অ্যা, কী বললে?'
'তুমি কানেও কি আজকাল কম শুনছ? কি শরীরই করেছ! একটা বেড়াল বাচ্চা নেবে?'

নেত্যবাবু এই সাত সকালে এমন একটা দানের প্রস্তাব স্বপ্নেও মনে হয় ভাবেননি। নাক মুখ সিটকে বললেন, 'রামোঃ বেড়াল! বেড়াল আবার মানুষে নেয়। গরু হলে নিতে পারি।’

দাদু রেগে বললেন, 'ভাগো, ভেগে পড় স্বার্থপর । কেন, তোমার অত বড় বাড়ি, একটা বেড়ালকে মাস-খানেক আশ্রয় দিতে পার না। তারপর তো বড় হয়ে নিজের রাস্তা নিজেই দেখে নেবে।’

'সে তো তুমিও দিতে পার। তোমারও তো বেশ বড় বাড়ি, বাগান।'

'আরে মূর্খ, আমার বাড়িতে যে বাঘের মত একটা কুকুর। সাধে তোমাকে বলছি?'

'দেখ মুকুজ্যে, বয়েস তোমারও কিছু কম হল না! কুকুর, বেড়াল, পাখি! আর জড়িয়ে পড়ো না, মায়া কাটাও । মনে কর, শেষের-অ সেদিন-অ কিই ভয়ঙ্কর-অ।'

আবার কাশি দাদু মুখ ঘুরিয়ে, খড়মের খটাস খটাস শব্দ তুলে আমার দিকে সরে এসে বললেন, 'এ দেশের কোনও দিন উন্নতি হবে না। সব স্বার্থ, সব স্বার্থ।’

বাগানে এতক্ষণ আমরা কি করছি দেখার জন্য এসে হাজির । আমার কোলে বেড়ালছানাটাকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন, ‘ফেল, ফেল, ফেলে দে।'

দাদু বললেন, ‘তুই আমার মেয়ে হয়ে এমন নিষ্ঠুরের মত কথা বলতে পারলি তুলসী!'

মা বললেন, ‘তুমি ওটাকে পুষবে না কি?'

'পোষা ত পরের কথা, আগে ওটাকে বাঁচাতে হবে।’

'তোমার টম ওটাকে খেয়ে ফেলবে বাবা। তুমি ও শয়তানকে জান না। ওই দেখ ?'

ঘরের জানলায় সামনের পা দুটো তুলে জিভ বের করে দিয়ে টম ফোঁস ফোঁস করছে, আর বিস্কুট দেখে যেমন জিভ চোকায়, সেই রকম জিভ চোকাচ্ছে। দাদু টমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে টম । আমার টমবাবু, এটা বিস্কুট নয়, তোমার বন্ধু, ফ্রেণ্ড।’ আমাকে বললেন, 'একটু কাছে নিয়ে যাও, ওকে একটু দেখাও। আমি এই সেদিন একটা ইংরিজী বইয়ের ছবি দেখেছি, কুকুরের ঘাড়ে উঠে তিনটে বেড়াল নাচছে। ট্রেনিং-এ কি না হয়।'

টমের দিকে এক পা এগোতেই, ঘেউ করে অ্যায়সা এক ডাক ছাড়ল, আমার কোলে মর মর বেড়ালটাও চমকে উঠল।

মা দাদুকে বললেন, 'কি বুঝলে? ওর হিংসে তুমি জান বাবা। ঠিক মানুষের মত। সেদিন তপনের ছেলেটাকে কোলে নিতেই সে কি লাফালাফি! কোল থেকে ফেলে দেবে। রাগ করে তিন দিন কথা বলেনি। যেদিন দুধ খেতে চায় না, সেদিন যেই বলি—জলি, টমের দুধটা খেয়ে যা তো, অমনি এদিক ওদিক তাকিয়ে ল্যাজ ঝুলিয়ে, সুড় সুড় করে খেয়ে নেয়।’

আমাদের পাশের বাড়িতে একটা লোম-অলা কুকুর আছে। তার নাম জলি। টম তখনও জানলায় ফোঁস ফোঁস করছে। এত জোরে ফোঁস করছে, জানলার গ্রিল থেকে ধুলে উড়ে যাচ্ছে। দাদু বললেন, 'ম্যাথমেটিশিয়ানকে ডাক। বল আমি ক্যাবিনেট মিটিং ডেকেছি?'

মাকে আর ডাকতে যেতে হল না। দাদুর পরেই বাবা বাগানে আসেন। বাবাই বাগান-করিয়ে। আমরা কেবল ফুল তুলি। মাঝে মধ্যে ডাল ভেঙে ফেলে, ধরা পড়ে যাবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি।

বাবা সব শুনেছেন। শুনবেন না কেন? এতক্ষণ ধরে হইচই হচ্ছে! চশমা পরে এসেছেন। চশমা পরে এলেই বুঝতে হবে, কাজের কথা হবে, আমাকে বললেন, 'দেখি, ওর কনডিশানটা কি?'

বাচ্চাটাকে হাতে নিলেন। 'ইস, ভিজে চুপসে গেছে। একটা তোয়ালে চাই। চোখে ড্রপস দিতে হবে, আর চায়ের কাপের গরম সেঁক ড্রপারে করে বিশ ফোঁটা টেপিডওয়ার্ম দুধ খাওয়াতে হবে। এক ডোজ অ্যাকোনাইট সিক্স এক্স'। মাকে বললেন, 'যাও, তোয়ালে নিয়ে এস।'

মা বললেন, 'মানুষের তোয়ালে!'
‘হ্যাঁ, মানুষের, সেইটাই হয়ে যাবে বেড়ালের ।'

মা চলে যেতেই দাদু খুশি খুশি মুখে বললেন, 'সাধে তোমাকে বলি ম্যান অফ অ্যাকসান! আচ্ছা, এটা এখন থাকবে কোথায়?'

‘কামিনী গাছতলার বাধানো বেদিতে বসে বাবা বললেন, 'এ বাড়িতে না রাখতে পারলেই ভাল হয়। টমকে বিশ্বাস নেই। ধরলে, ছিড়ে দু টুকরো করে দেবে।’ বাবা খুব চিন্তিত। মা তোয়ালে এনে বাবার হাতে দিলেন। বাচ্চাটাকে তোয়ালে জড়িয়ে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘আসুন, আমরা একটু মাথা ঘামাই। মাকে আবার ফরমাশ, 'একটা খাতা আর ডট পেন নিয়ে এসো!'

বাড়িতে কিছু হলেই মাকে যা খাটতে হয়! সাজি রেখে দাদুও বসে পড়েছেন। খাতা আর ডট এসে গেল। মাকে বললেন, ‘তুমিও বস?'

কাগজে কলমে কি হবে কে জানে? বাবা বলেন, গণিতে নাকি সব সমস্যার সমাধান আছে। আমার মনে হয় সরল করায়, কি সুদ কষায় এ সমস্যার সমাধান নেই। টাইম অ্যাণ্ড মোশানে থাকতে পারে। যেমন, টম যদি এক লাফে ছ হাত যায় আর বেড়ালটাকে কতদূরে রাখলে টম জীবনেও ধরতে পারবে না। সেই শামুকটা, যে জীবনেও বাশের ডগায় উঠতে পারল না।

বেদিতে বাবা বসেছেন পা মুড়ে, আচার্যের মত। হাতে ডট পেন। সামনে খোলা খাত। বাবা বললেন, ‘আশেপাশে এই পাড়ায় কে বেড়ালটাকে রাখতে পারে? নিন ভাবুন।'

দাদু বললেন, ‘বুঝলে একজনকে আমার বড় মনে ধরেছে।'

'বলুন, বলুন !'

'তোমার জ্যাঠাই মা। আমাদের মেজ বউ খাটি হরিভক্ত। গলায় তুলসীর মালা। একটিমাত্র ছেলে । সেও পরম বৈষ্ণব। সখি গো বলে যখন কীর্তনে টান ধরে, গামছা মোচড়ানর অনুভূতি হয়।'

বাবা লাফিয়ে উঠলেন, ‘আঃ এতক্ষণে আপনি ঠিক জায়গায় এসে ঘা মেরেছেন।'

‘তা হলে তুমি তোমার জ্যাঠাতুতো ভাইকে একটা চিঠি লেখ। খোকা আগে অনুমতি নিয়ে আসুক। আমি ততক্ষণ ফাস্ট এইড দি।’

বাবা চিঠি লিখতে লাগলেন, ‘প্রতিভাজুনুষু গোপাল, পৃথিবীতে পরের জন্যে বাঁচাটাই সবচেয়ে বড় বাঁচা'। আর দাদু কোলের উপর বেড়াল ফেলে হাতে আই ড্রপসের শিশি নিয়ে বলছেন, 'দেখি, চোখ দুটো একটু মেরামত করে দি’। বাবা চিঠি লিখতে লিখতে বলছেন, 'ওষুধের গায়ে নির্দেশটা একবার পড়ে নিন। বেড়ালের চোখে দেওয়া যায় কি না!' মা একটু দুধ আর তুলো এনেছেন। এলাহি ব্যাপার! ওদিকে টম ভুকু ভুক্ করছে। বেশি জোরে ডাকতে পারছে না, পাছে আমরা ভাবি হিংসে হয়েছে। আবার চেপে রাখতেও পারছে না। কাশির মত।

বাবার জ্যাঠাইমা, মানে আমার দিদা, বৈষ্ণব হলে কি হবে, ভীষণ রাগী। সব সময় রাগ রাগ চোখে তাকান। 'অ্যাই জুতো খোল। জুতো খোল। রাস্তায় কিছু মাড়াসনি তো? গঙ্গাজল ছিটে। আ-হ-হা, বিছানার চাদরটা কুঁচকে দিলি কেন? আবার ঠাকুর ঘরে গিয়ে কি খটখট করছিস।' এই রকম একটা না একটা কিছু নিয়ে বকাবকি করবেনই। আমি অবশ্য গ্রাহ্য করি না। আমার কাজ আমি ঠিক করে যাই।

চিঠি নিয়ে যখন গেলুম, দিদা তখন রান্নাঘরের সামনে বসে নারকোল কুরছেন। একথালা সাদা সাদা ফুলের মত নারকোল হয়েছে। বেশ লোভ লাগছে। এক চামচে চিনি দিয়ে এক থাবা মুখে ফেলতে পারলে মন্দ হত না। সে হবার উপায় নেই। আমি ডাক পিওনের মত হেঁকেউঠলুম 'চিঠি'।

'কার চিঠি?...'
'বাবার। এই নিন?'
দিদা দু হাত গুটিয়ে নিয়ে, মুখ চোখ কেমন করে বললেন, 'ছুঁয়ো না, বাসী জামা কাপড় ছেড়েচো?'

'কখন, কোন সকালে।’
'দাও চিঠিটা আমার হাতে আলগোছে ফেলে দাও। দশ পা দূরে বাড়ি, চিঠি লেখার কি হল? তোমার বাবা যে কত কায়দাই জানে! যাও, ঘর থেকে চশমাটা এনে দাও। দেখো এক করতে আর-এক করে বোসো না যেন। তোমার হাত পা-কে আমার বিশ্বাস নেই।’

চশমা এনে দিদার হাতে দিতে না দিতেই কাকু বাজারের থলে হাতে বাড়ি ঢুকলেন। বেশ হাসি হাসি মুখ। মনে হয়, ভাল মোচাই পেয়েছেন। নারকোল কোরা হচ্ছে যখন।

'কি রে, সকাল বেলাই?' বাজারের থলেটা দেয়ালে কাত হল। দিদা খ্যাক করে উঠলেন— 'ওখানে কাল রাতে চটি ছেড়েছিলি, মনে আছে?'
'ওখানে কোথায় গো? সে তো ওইখানটায়।’
'তুই আমার চেয়ে ভাল জানিস?'
'আমার জুতো, আমি জানব না, তুমি জানবে?'
'হ্যাঁ, আমাকেই জানতে হয়।’
'আচ্ছা বাবা, এই নাও।' কাকু ব্যাগটা তুলে দিদার সামনে নামিয়ে দিলেন ।
‘এই নে চিঠিটা পড়। তোর দাদা লিখেছে।’

কাকু চিঠিটা নিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগলেন। 'স্নেহভাজনেষু, গোপাল, ভক্ত আর দয়ালু ব্যক্তি হিসেবে তোমার একটা পরিচয় আছে। ত্রিসন্ধ্যা না করে জল স্পর্শ কর না। শ্রীচৈতন্যের নামে তোমার চোখে জলের ধারা নামে। তোমার উদারতার পরিচয় আগেও কয়েকবার পেয়েছি। আশা করি আর একবার পাব । আমাদের বাগানে আজ কে বা কারা একটি বেড়ালছানা ফেলে দিয়ে গেছে।’

দিদা হা হা করে উঠলেন, ‘হবে না, বেড়াল-টেড়াল হবে না।’

কাকু আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'কি হবে না হবে না করছ? এখনও চিঠিটার এক প্যারা বাকি।'

ওই প্যারাতে আছে, আমাদের বাড়িতে কুকুর, বেড়ালটাকে তোমরা রাখো।
'বেড়াল বৈষ্ণব নয় । কথায় বলে বেড়াল তপস্বী। ও আপদ আমি ঢুকতে দোব না।’

‘আহা, চিঠিটা তুমি শোনোই না।'

দিদা জোরে জোরে নারকোল কুরতে লাগলেন। খুব রাগ হয়েছে। কাকু বাকি অংশ পড়ছেন, এতটুকু একটি প্রাণী। অতি অসহায়। করুণ মিউ মউ ডাকে জগতের কৃপা ভিক্ষা করছে। ওদিকে লোলুপ কুকুর অপেক্ষায় আছে, পেলেই ছিড়ে খাবে। আমার জ্যাঠাইমার দয়ার শরীর।’

সঙ্গে সঙ্গে দিদার প্রতিবাদ, ‘না, আমার দয়ার শরীর নয়।’
‘হ্যাঁ, তোমার দয়ার শরীর।’
'মুখে মুখে তক্ক করবি না গোপাল।'
‘তোমার দয়ার শরীর না হলে, আমার দয়ার শরীর হয় কি করে?'
‘তুমি দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ।'
'না আমি দেবকুলে'।

দিদা ভীষণ ধমকে উঠলেন, 'চুপ কর।'

কাকু সঙ্গে সঙ্গে পড়া শুরু করলেন, 'বেড়াল বড় হলে আর বাড়িতে থাকে না। স্বাবলম্বী সন্তানের মতই গৃহত্যাগ করে। অতএব মাত্র এক মাসের জন্যে বেড়ালটাকে তোমার নিরাপদ আশ্রয়ে রাখলে বড়ই বাধিত হব। আমি রোজ সকালে এক পোয়া পরিমাণ দুধও পাঠাব। কিংবা দুধের টিন। যেটা তোমার সুবিধে। প্রীত্যন্তে।'

কাকু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেড়ালটা কেমন দেখতে রে ?
‘দুধের মত সাদা।’
'ন্যাজ?'
‘ন্যাজটা জলে ভিজে গেছে তো সেভাবে লক্ষ্য করিনি?'
'যাক, ঠিক আছে। তুই তা হলে নিয়ে আয়। আমার অনেক দিনের বেড়ালের শখ। হ্যাঁ রে, বড় হলে ন্যাজটা বেশ মোটা হবে তো? ন্যাংলা ন্যাজের বেড়াল আমার দু চক্ষের বিষ।'
'হ্যাঁ কাকু, মোটা হবে। যেটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয় মোটা ধাতের ন্যাজ ।'
দিদা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘গোপাল!'

কাকু হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘মা'!
'তুই বেড়াল এনে দেখ?'
‘হ্যাঁ, দেখবই তো।’
আমি পালিয়ে এলুম। এসে দেখলুম সুন্দর দৃশ্য। দাদু তোয়ালে জড়ানো বেড়াল কোলে আর বাবা পেনসিল উঁচিয়ে বাগানের পথে এপাশ ওপাশ পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই দু'জনে একই সঙ্গে প্রশ্ন করলেন—
'রিপোর্ট কি? রিপোর্ট কি?'
আমি একটু চেপে-চুপেই বললুম। সবটা না বলাই ভাল।
‘কাকু বললেন, নিয়ে আয়, আমি তো একটা বেড়ালের অপেক্ষাতেই ছিলুম।'
দাদু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘দেখলে তো আমি তোমাকে কি বলেছিলুম? ভক্তরা স্বপ্ন পায়। ভগবান বেড়ালের রূপ ধরে আসছেন। নিশ্চয়ই ভোরের স্বপ্ন। তা হলে আর দেরি কেন? যাত্রা শুরু করিয়ে দি দুর্গা বলে। পুজোটুজো সব মাথায় উঠে গেছে হে। ফুল শুকিয়ে গেল।’

‘হ্যাঁ, তা হলে যাত্রা শুরু হোক৷'

আমার পিসতুতো বোন রেখা এসে গেছে। পাশেই থাকে। ঠিক হল আমরা লটবহর নিয়ে যাব। মাদ্রাজ থেকে বাবা আঙুর এনেছিলেন, সেই আঙুরের বাস্কেটটা এল। বেড়াল নাকি বাস্কেটে শুতে ভালবাসে। বাবা বিলিতি বইয়ে ছবি দেখেছেন। নরম টার্কিশ তোয়ালে তো এসেই আছে। স্টেনলেস ষ্টিলের গেলাসে আধ গেলাস দুধ এল। একটা ষ্টিলের প্লেট এল। সব রেডি। এইবার স্টার্ট । বাবা বেড়ালটার কপালে হাত রেখে বললেন, 'মানুষ হয়ে এসো মানু।'

দাদু আশীৰ্বাদ করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি অনেক বড় হবে।’
বাবা সব দেখে-টেখে বললেন, “আর একটু সাবধান হওয়া ভাল, কি বলেন?'
'অবশ্যই, অবশ্যই, সাবধানের মার নেই, মারের সাবধান নেই। কি করতে চাও বলে?'
'একটা ছাতা চাই?'
'কেন বল তো? রোদ লাগবে?'
‘রোদ নয়, যে কোন সময় কাক আর চিল ছো মারতে পারে।
'ঠিক বলেছ হে। একেই বলে অঙ্কের মাথা।'

সঙ্গে সঙ্গে ছাতা এসে গেল। রথের দিন পূর্ণ ঠাকুর যে ভাবে ছাতার তলায় নারায়ণের সিংহাসন নিয়ে হন হন করে হাঁটেন আমি সেই ভাবে হাঁটছি। বাবা আবার হিসেব করে বলে দিয়েছেন, মাথা থেকে ছাতা যেন দশ ইঞ্চির বেশি ফাঁক না হয়। তা হলে ছোঁ মারতে পারে। বেড়ালটা খুব কাবু হয়ে আছে। তা না হলে খচর-মচর করে কোল থেকে নেমে যাবার চেষ্টা করত। পেছন পেছন রেখা আসছে। হাতে লটবহর ।

রকে দিদা আর বসে নেই। কাকু এপাশে ওপাশে বাঘের মত পায়চারি করছেন। খুব রাগারগি হয়ে গেছে দু’জনে, দিদার চশমার খাপটা এক পাশে পড়ে আছে। ওপাশ থেকে এপাশে ঘোরার মুখে কাকু আমাদের দেখতে পেলেন, 'বা বাঃ এসে গেছিস?'

'কাকু, দিদা এত রেগে যান কেন?'
‘ও বয়েস হলেই মানুষের রেগে যাওয়া স্বভাব হয়। হ্যাঁ বললে না, না বললে হ্যাঁ। আমিও কি এখন কম রেগে আছি ভাবছিস ? বেরোতে দিচ্ছি না, চেপে আছি।'
'তা হলে ?'
‘তা হলে আবার কি? আমি বলেছি বেড়াল থাকবে তো থাকবে। আমি বাঘ পুষব, দেখি মা কি করে। আগে মাসীকে দিয়ে শুরু করি?'
রেখা মেঝেতে থেবড়ে বসে সঙ্গের জিনিসপত্রের হিসেব বোঝাতে লাগল, 'এই হল তোমার বেড়ালের বাড়ি । এই ছাতাটা হল ছাদ, এই হল দুধের গেলাস, এই হল তোমার গিয়ে দুধের থালা, আর তোয়ালে।’
‘ছাতাটা নয় রে রেখা। ছাতাটা নিয়ে যেতে হবে। আমরা তা হলে যাই কাকু।'
কাকু অসহায়ের মত মুখ করে বললেন, 'আমাকে একটু ট্রেনিং দিয়ে যা তরু?'

'এর আবার ট্রেনিং-এর কি আছে কাকু ? এই বাস্কেটে শুয়ে থাকবে । মাঝে মাঝে দুধ খাবে। আবার শুয়ে পড়বে। আবার দুধ খাবে। আবার শুয়ে পড়বে। মিউ করলেই বুঝবেন খিদে। ম্যাও করলেই বুঝবেন রাগ। ঘড়র ঘড়র করলেই বুঝবেন, কোলে উঠবে। আর মিঞাও করলেই বুঝবেন, পালাবার তাল খুজছে।’

‘এই তো ওদের ভাষা, ম্যাও, মিঁউ, মিঁঞাও, মাওঁ!
‘মাঁও-টা ত বললি না।’
'ওটা ত আমি ঠিক জানি না কাকু। বাবার কাছে জেনে এসে বলব।’

রেখা বললে, 'আমি জানি। মাও মানেই দুষ্টুমি করার ইচ্ছে, মাও মানে আও আর কি। টেবিলের ওপর থেকে একটা কিছু ফেলব। ফেলে ভাঙব।’
'আচ্ছা, তা হলে তোরা আয় । করুণ গলা কাকুর ।'
'আপনি কিছু ভাববেন না কাকু, আমরা মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব, খবর নিয়ে যাব?'

দাদুর আজ আর কোর্টে যাওয়া হল না। বাবা অ্যাটম নিয়ে রিসার্চ করেন। তিনি ঠিক সময়ে খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে গেলেন। পুজোটুজো সেরে দাদু সাড়ে দশটার সময় এক বাটি মুড়ি নিয়ে আরাম করে বেতের চেয়ারে বসলেন। খোলা পিঠে ইয়া মোট সাদা এক গোছা পইতে আড়াআড়ি পড়ে আছে। দাদু বলেন, 'ব্রহ্মদৈত্যের পইতে। পইতেতে চাবি বাঁধা '।

মুড়ি খেতে খেতে দাদু মাকে বললেন, ‘বুঝলি, বেড়ালটার একটা ব্যবস্থা হওয়ায় বড় আনন্দ পেলুম! ভালো ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবার মত আনন্দ ?'

মায়ের আত জীবে দয়া নেই। ‘হু” বলে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে রইলেন। দাদু আপন মনেই বক বক করে চললেন। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাটা ঘুরে দুপুরের দিকে চলে গেল। খাওয়া-দাওয়া সারার পর দাদু বললেন, 'আয় বুড়ো, ফুরফুরে হাওয়ায় একটু ঘুমোনো যাক।'

আদর এলে দাদু আমাকে বুড়ো বলেন।

দু'জনেরই ঘুম এসে গিয়েছিল। এমন সময় নিচে থেকে মা ডাকলেন, ‘জ্যাঠাইমা এসেছেন।'
নাড়া দিয়ে দাদুর ঘুম একটু পাতল করার চেষ্টা করলুম। 'দাদু, দিদা এসেছেন?'
ঘুমের ঘোরে দাদু বললেন, ‘কোন দিদা?'
‘বেড়াল দিদা?'
সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ছেড়ে গেল। উঠে বসলেন। শুনতে পাচ্ছি, দিদা ওপরে উঠতে উঠতে বলছেন, ‘সব সুখের শরীর। বেলা তিনটে অবদি পড়ে পড়ে ঘুম। রাজমিস্ত্রী হলে ভারায় উঠে এখনই ইট গাঁথতে হত।'

দাদুর মুখ দেখে মনে হল বেশ লজ্জা পেয়েছেন। পা নামিয়ে বিদ্যাসাগরী চটি পরছেন। দিদা ঘরে ঢুকলেন । সাদা ধবধবে থান কাপড়। চোখে চশমা। বেশ রাগ রাগ মুখের ভাব।

'এই যে, ঘুম ভাঙল ? বেশ আছেন যা হোক। যা শত্রু পরে পরে। আঁ! '

দাদু উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বললেন, 'কেন বলুন তো ? কেন বলুন তো?'

'কেন বলুন তো?' দিদার গলা বেশ চড়েছে। 'একটা ফাটা রেকর্ড পাঠিয়ে বেশ আরামে দিব্যি দিবানিদ্রা হচ্ছে। ওদিকে অষ্টপ্রহর মিঁউ মিঁউ করে আমাকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না।’

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘কাকু কোথায় দিদা!'

সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠলেন, 'তিনি অফিসে। তার আর কি! হাসি হাসি মুখে বলে গেলেন, একটু দেখে মা। কে দেখবে বাবা ওই জিনিসকে। একবার দুধ খাওয়াতে গেলুম। থালায় পড়ে চান হয়ে গেল। এখন আষ্টেপৃষ্ঠে লাল পিঁপড়ে ছেকে ধরেছে।'
দাদু লাফিয়ে উঠলেন, ‘অ্যা, বলেন কি! বুড়ো?'
‘আজ্ঞে দাদু ?'
‘গ্যামাকসিন I’
মা এসে দাঁড়িয়েছেন। লক্ষ্য করা হয় নি। ধীর গলায় বললেন, 'উহু, মরে যাবে। হলুদ।'
দিদা বললেন, 'হলুদ কি গ্যামাকসিন, সে তোমরা বোঝো। বেড়ালটাকে দয়া করে নিয়ে এস। আমি দায়িত্ব নিতে পারব না।’

দিদার চড়া চড়া কথায় মায়ের মনে হয় একটু রাগ হল। আমারও বেশ রাগ হচ্ছে। মা বললেন, 'আমরা লজ্জিত ; আপনার অসুবিধে করার জন্য। আমরা এখুনি নিয়ে আসছি।'

দাদু যেন বল পেলেন, ‘তুই যাবি?'

‘হ্যাঁ যাই। জীবটাকে পিঁপড়েতে মেরে ফেলবে তা ত আর হয় না।'

আমরা দু’জনে গিয়ে দেখলুম বেড়ালটার শোচনীয় অবস্থা। কোথায় তোয়ালে, কোথায় বাস্কেট। জুতোর র‍্যাকের সঙ্গে খাটো দড়ি দিয়ে বাধা। দুধে ভিজে লোম ড্যাল ড্যালা। ছোট ছোট থাবায়, নাকে, কানে মহানন্দে লাল পিঁপড়ে ঘুরছে। কিছু দূরে দেয়ালে শ্রীচৈতন্য গলায় মালা পরে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন।

মা আমাদের দলে এসে গেছেন। আর কিসের ভয়। দেখতে দেখতে পিঁপড়ের বংশ নির্বংশ। বেড়ালটাও যেন এতক্ষণে মা পেয়েছে। ঘড়ড় ঘড়ড় শব্দ করছে, আর আছরে গলায় মিউ মিউ করে ডাকছে। বেড়াল আবার ফিরে চলল। সে যেন উলটো রথ। মায়ের আঁচলের তলায় ম্যাও। কেন জানি না, বেড়াল শব্দটা মায়ের ভাল লাগে না। একটু আদরটাদর এলেই বেড়ালকে ম্যাও বলেন। ম্যাও কোলে মা চলেছেন আগে আগে। লটবহর নিয়ে আমি পেছনে ।

বাবা অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। এখনও জামা কাপড় ছাড়েন নি। দু’জনেই বেশ উত্তেজিত, আমাদের ফিরতে দেখে দু’জনেই হই হই করে বলে উঠলেন, 'ওয়েলকাম পুসী, ওয়েলকাম পুসী।’

মা ম্যাওকে আঁচলে করে টমকে ফাঁকি দিয়ে দাদুর লাইব্রেরিতে নিয়ে এসেছেন। বাবা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। টম এখন দোতলায় জানলার সামনে বসে গলা সাধছে। দাদু মায়ের কোল থেকে পুসীকে নিজের কোলে নিয়ে বললেন, 'বাঁচা গেল বাবা। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এল'। তারপর বারোয়ারি তলার পুজোর নাটকের মেনীদার মত বা হাতে বেড়াল ধরে, ডান হাতটাকে বাতাসে গোল করে ঘুরিয়ে বললেন, 'এই হল তোমার সাম্রাজ্য। অসংখ্য ইঁদুর ঘুরছে আইনের বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে। আইন বাঘা বাঘা অপরাধীদের কাত করলেও ক্ষুদ্র ইঁদুরের কিস্যু করতে পারে না। এইবার তুমি এসেছ। তুমি পারবে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও।'

মা দু'হাত তুলে দাদুকে থামালেন, 'আর হাসি নয়, আর হাসি নয়। এখনও হাসির সময় আসেনি। রাত আসছে। কে কোথায় থাকবে ঠিক করুন।'

বাবার মাথা আবার ঘামতে শুরু করল। ইউরেকার মত বাবার চিৎকার, পেয়েছি, 'পেয়েছি, ডগ গেট।’

বেড়াল কোলে দাদু র‍্যাকের কাছ থেকে উল্লাসে লাফিয়ে উঠলেন, ‘ইয়েস, ডগ গেট।'
পর মুহূর্তেই দু'জনে চুপসে গেলেন, সে তো তৈরি করাতে সময় লাগবে!
'তা হলে?'
আবার বাবার আবিষ্কার, 'পেয়েছি, পেয়েছি। আইন দিয়ে কুকুর ঠেকাব।’
‘সেকি!'
'দেখবেন, যখন করব, তখন সেটা কি ?'

দোতলায় ওঠার সিড়ির মাঝের বড় ধাপে রাত দশটার সময় কোমর উঁচু একটা বড় র‍্যাক পড়ল, দেয়ালে দেয়ালে ঠাস হয়ে। সার সার সাজান হল ল-মানুয়েলস ৷ ইয়া মোটা মোটা বইয়ের দুর্ভেদ্য দেয়াল। দোতলায় দাদু আর বেড়াল। নিচের তলায় টম। বইয়ের পাঁচিলে পা তুলে গলা বাড়িয়ে, জিভ বের করে টম হ্যা হ্যা করছে।

বাবা বললেন, 'যতই চেষ্টা কর, আইন লঙ্ঘন করার ক্ষমতা তোমার নেই। তবে তোমার আছে, কারণ তুমি বেড়াল।'
'আপনি ওকে ঘরে বন্ধ করে রাখুন। কাল সকালে মিস্ত্রী ডেকে গেট তৈরি করান হবে।’

নিচে থেকে আমরা দু’জনে দাদু আর দাদুর বেড়ালকে, ‘গুড নাইট’ করলুম। টম ভুকু করল ।

দাদু বললেন, ‘কাল সকালে তোমরা আমাকে গুড-মর্নিং না করালে এই আইন টপকে আমার পক্ষে বাগানে যাওয়া সম্ভব হবে না যে!'

বাবা বললেন, 'আমাকে তা হলে কাল একটু বে-আইনী করে ভোরে উঠতে হবে। শুভরাত্রি।'

টম এতক্ষণ ছোট ছোট ঢেঁকুরের ভুকু ভুকু তুলছিল। আর সামলাতে পারল না। এবার উদাত্ত ভেউ-উ-উ।

২১৮০ পঠিত ... ১৭:৪৭, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top