এক দেশে ছিল দুই ফেসবুক ফ্রেন্ড। ওদের ভেতরে প্রচন্ড ভাব ছিলো। এক মুহূর্ত চ্যাট না করে ওরা থাকতে পারতো না। কে কখন খাওয়া-দাওয়া করলো, কে কখন ঘুমাতে গেলো সবই ছিলো একে অপরের নখদর্পণে।
দুজনের এত ফ্রেন্ডশিপ ছিল, এত ফ্রেন্ডশিপ ছিল যে, একটা দিন ইমোর ভিডিও চ্যাটে দুই বন্ধু কথা না বলে থাকতেই পারতো না। হোয়াটসঅ্যাপে তাদের এমন একটা গ্রুপ ছিল যেখানে মেম্বার শুধু তারা দুজনই! অবসরে তারা ভাইবারে স্টিকার দেয়া-নেয়া করত। ভার্চুয়ালিটির সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ছিলো তাদের বন্ধুত্বে।
একদিন দুই বন্ধু ঠিক করল তারা সামনা সামনি দেখা করবে। প্রথম বন্ধু মেসেঞ্জারে এই প্রস্তাব রাখার সাথে সাথে দ্বিতীয় বন্ধু মনে মনে লাইক দিয়ে রাজি হয়ে গেলো। সে দুটো লাভ ইমো দিয়ে লিখলো, 'আসলেই তো! দেখা করা অবশ্যই উচিৎ। এত জানের বন্ধু আমরা, দেখা তো করতেই হবে।’
প্রথম বন্ধু তো উত্তেজনায় লাইফ ইভেন্ট খুলে ফেললো। ‘ফার্স্ট মিট’। দ্বিতীয় বন্ধু আবার সেই ইভেন্ট শেয়ার করল নিজের টাইমলাইনে। একেবারে বন্ধুত্বের মাখামাখি অবস্থা। যেন পৃথিবীতে ওরাই প্রথম বন্ধু। যেন ওদের দেখেই বিজ্ঞাপন নির্মাতা আইডিয়া পেয়েছেন- 'বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল'।
মেসেঞ্জারে প্রবল চ্যাটিং এর ঝড় তুলে তারা দেখা করার দিন নির্ধারণ করল।
এর ভেতরে ঘটলো আরেক ঘটনা। প্রথম বন্ধুর নতুন প্রোফাইল পিকচারে দ্বিতীয় বন্ধু লাইক দিতে ভুলে গেলো। প্রথম বন্ধু তো প্রচন্ড অভিমান করল। সে পুরো একটা বিকেল না খেয়ে থাকলো। তারপর এই নিয়ে হল এক মান অভিমানের লম্বা চ্যাটিং।
‘তুই আমার পিপিতে লাভ তো দূরের কথা লাইকটাও দিলি না!’ প্রথম বন্ধু অভিযোগ রাখলো।
এই অভিমান ভাঙানোর জন্য পুরো এক সপ্তাহ দ্বিতীয় বন্ধু তার ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে রাখলো। এতে করে তাদের দেখা করার দিন পিছিয়ে গেলো।
এরপর দ্বিতীয় বন্ধু প্রথম বন্ধুকে সি-ফার্স্ট দিয়ে রাখলো। যেন আর একটা পোস্টও মিস না যায়। সম্পর্ক শান্ত হওয়ার পরে তারা দেখা করার দিন পুনরায় নির্ধারণ করলো।
দ্বিতীয় বন্ধু বলল, ‘ওইদিন আমরা দুজনেই লাল রঙের জামা পরে ছবি তুলে প্রোফাইল পিকচার দেবো।’
প্রথম বন্ধু বলল, ‘হুম। কিন্তু আমার একটা প্রস্তাব আছে।’
-কী?
-ওইদিন আমরা কেউ কাউকে কোনো পোস্টে ট্যাগ বা মেনশন করব না।
দ্বিতীয় বন্ধু এই প্রস্তাবেও রাজি হয়ে গেলো। সে বলল, ‘যার সাথে চব্বিশ ঘন্টা চ্যাট করা যায় তার জন্য নিজের জীবনটাও দেয়া যায়। আমি রাজি ফ্রান্স।’
অবশেষে আসলো সেই শুভ দিন। এক গহীন জঙ্গলের ভেতর শান্ত নির্জন স্থানে ওরা দেখা করলো। দেখা করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বন্ধু ঝড়ের মত ক্লিকে পঞ্চাশটা সেলফি তুললো। সেলফি তোলার পর এডিট করে একটা ছবি আপলোডও দিলো। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী সে সেলফিতে প্রথম বন্ধুকে ট্যাগ করতে পারলো না। এরপর তারা আরও সেলফি তুললো।
তবে সেলফি তোলা শেষে ঘটল এক অবাক করা ঘটনা।
ফেসবুকে ওরা সারাদিন চ্যাট করত, অথচ সামনে আসতেই তাদের মধ্যে কি এক জড়তা কাজ করতে শুরু করেছে। কোন কথাই যেন আসছে না। ওরা আরো কিছু সেলফি তুলে দুজনে জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে দ্বিতীয় বন্ধু চলে গেলো ফেসবুক লাইভে।
ঠিক তখনই, হঠাৎ সামনে আসলো বিরাট এক ভাল্লুক। ভার্চুয়াল ফেসবুক লাইভ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো দুজনেই। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে প্রথম বন্ধু বলল, ‘এখন কী হবে?’
দ্বিতীয় বন্ধু এক পলক ভেবেই দৌড়ে একটা লম্বা গাছের মাথায় উঠে বসল। প্রথম বন্ধুর কথা সে মোটেও ভাবলো না। শুধু গাছেই উঠলো না, গাছে উঠে সে আবারো ফেসবুক লাইভ অন করে ফেললো। এরকম একটা ঘটনা ফেসবুকে লাইভ শেয়ার করতে পারলে সে তো সেলিব্রেটি হয়ে যাবে!
অথচ প্রথম বন্ধু গাছে উঠতে পারতো না। প্রথম বন্ধু খুব কষ্ট পেলো। দ্বিতীয় বন্ধু এতটা স্বার্থপর হবে এটা সে কল্পনাও করেনি। সে সিদ্ধান্ত নিলে, যদি আজ তার অ্যাকাউন্টটি রিমেম্বারিং না হয়ে যায়, তবে আজকেই তাকে ব্লক করে দেবে।
তবে প্রথম বন্ধু জানতো ভাল্লুক মৃত মানুষ খায় না। তাই সে নি:শ্বাস বন্ধ করে মৃত মানুষের ভান ধরে শুয়ে থাকলো। ভাল্লুকটা এসে ঘ্রাণ নিয়ে অনেকক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গন্ধ শুঁকে-টুকে ভাবলো প্রথম বন্ধু মৃত। তারপর সে ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভিতরে চলে গেলো।
ভাল্লুক চলে যেতেই দ্বিতীয় বন্ধু গাছ থেকে নেমে এলো। এসেই কৌতুহলী চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘ শিট, এই ভাল্লুক তো পুরাই ফাউল। হুদাই লাইভে গেলাম। আচ্ছা, ভাল্লুক তোকে কী বলল রে?’
প্রথম বন্ধু মৃদু হেসে বলল, ‘ভাল্লুক বললো, মেনশন করুন আপনার সেই বন্ধুকে যে ভার্চুয়াল জগৎ-এ বন্ধু, কিন্তু বাস্তবে বন্ধু না।’
-তুই তখন কী করলি?
'কী আর করবো! আমাদের চুক্তি অনুযায়ী আজকে তো তোকে মেনশন করা নিষেধ।’ প্রথম বন্ধু ম্লান হেসে উত্তর দিলো।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন