প্রমথনাথ বিশীর রম্যগল্প 'রাশিফল'

৭৯৫ পঠিত ... ১৮:২৫, জুলাই ৩১, ২০১৯

 

ওরে বাবা অতবড় জ্যোতিষী কলকাতা শহরে আরে নেই।
কই নাম তো শুনিনি।
নামের কাঙাল তিনি নন, তাছাড়া তিনি যে প্রফেশনাল নন।
বেশ তো একদিন নিয়ে চলুন না।
যেদিন খুশি চলুন। তবে আগে নোটিশ দিয়ে না গেলে ফিরে আসতে হতে পারে।
এত ভিড়!
হবে না! মন্ত্রী, উপমন্ত্রী থেকে বড় বড় অফিসার সব কিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
বলেন কি!
যা দেখেছি তাই বলছি। যিনি যত বড়ই হোন জ্যোতিষী, ডাক্তার আর মহাজনের কাছে সবাই অসহায়।
তাহলে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন কোন ভরসায়?
আমাদের সঙ্গে তার অনেকদিনের সম্বন্ধ, বিশেষ স্নেহ করেন আমাকে।
তবে আর দেরি নয়, চলুন।
এই বলিয়া তিনজন উঠিয়া পড়িলাম।

উপরোক্ত সংলাপ হইতে বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝিতে পারিয়েছেন। আর দু’একটা কথা বলিলেই সমস্ত পরিষ্কার হইয়া যাইবে।

জ্যোতিষীর মহিলা কীর্ত্তন যিনি করিতেছেন তিনি আমাদের সঙ্গে সামাজিক সূত্রে পরিচিত, আর আমরা দুইজনে সাহিত্যিক।


তিনজনে আমরা যখন জ্যোতিষীর খাস কামরায় প্রবেশ করিলাম দেখিলাম সত্যই কয়েকজন লোক সেখানে উপবিষ্ট। তবে তাহাদের কাহাকেও মন্ত্রী বা উপমন্ত্রী বলিয়া মনে হইল না। অবশ্য তাহাদের চেহারা চরিত্র কথাবার্তা ও হাবভাব যে রকম তাহাতে অচির ভবিষ্যতে তাহাদের বা কেহ কেহ মন্ত্রীপদ পাইলে অন্ততঃ আমি তো বিস্মিত হইব না।

আর একদিকে ঐ যে একাকী যিনি নিঃসঙ্গ মহিমায় বিরাজিত তিনিই নিঃসন্দেহে কলিকাতার শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষী যাহার কাছে মন্ত্রী ও বাছা অফিসারগণ অসহায় বোধ করিয়া থাকেন। এ হেন মহিমাময় পুরুষের মুখমণ্ডলে যে দিব্য দীপ্তি সকলে আশা করিয়া থাকে তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হইলো না, কিন্তু কলিযুগের শেষ পাদে আশানুরূপ কয়টা কার্য্য হইয়া থাক?  ক্ষণকাল পরে মনে হইল তাহার মস্তকে একটা কিসের যেন আভা! না, উহা প্রচুর তৈল নিষিক্ত কেশদামে বৈদ্যুত বর্ত্তিমার প্রতিফলন মাত্র। একবার মনে হইল তাহার ত্রিকালদর্শী চক্ষুদ্বয়ে কিসের যেন দীপ্তি! না, পরে, হায় অনেক পরে বুঝিয়াছিলাম, উহা দর্শক সমাগমজনিত আনন্দ কৌতুক। এক-বার মনে হইলো- না, আর মনে হইবার সংখ্যা বাড়াইয়া লাভ নাই।

অপরেশবাবু, যাহার সঙ্গে আসিয়াছি, বলিলেন- স্যার এঁদের নিয়ে এলাম। এঁরা খুব বড় সাহিত্যিক।

এই বলিয়া এ পর্য্যন্ত যে-সব পুস্তক আমরা লিখি নাই বা কখনো লিখিব এমন ক্ষীণতম ইচ্ছাও নাই সেই সব গ্রন্থের গ্রন্থকার বলিয়া আমাদের বর্ণনা করিলেন।
নমস্কার, বসুন  বসুন।

ভাবী মন্ত্রী-উপমন্ত্রীর দল চেয়ার ছাড়িয়া দিয়া প্রস্থান করিল, আর আমরা কিনা ভাবী বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের দল উপবেশন করিলাম।

চা আনতে বলবো?
না, না, থাক।
বেশ তবে থাক। বুঝলেন অপরেশবাবু, কাল অনেক রাত্রে দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ককল এলো একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছ থেকে।
হঠাৎ?
হঠাৎ - এরই তো অপর নাম অদৃষ্ট! নেহরু নাকি তাঁকে ক্যাবিনেটে রাখতে চান না। কি হবে জানতে চান। আমি বললুম- মা ভৈঃ আপনি থাকবেনই।
আশ্চর্য্য!
এ অতি সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু আজ সকালে যা ঘটছে- তার মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।
আবার কী হলো?
এক মস্ত মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির, শেয়ারের দর পড়ছে কি করবে জানতে চায়। আমি একটু চিন্তা করে বললাম, আজ দুপুরেই দর চড়তে সুরু করবে, রামজীর নাম ক’রে বাড়ি ফিরে যান।

চড়েছে?
চড়েছে বলে চড়েছে। এই দু’ঘন্টা আগে ফোন করে হাজার হাজার শুকরিয়া জানিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীর তুলনায় নিজেদের নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বোধ হইতে লাগিল, দুইজনে হতবাক হইয়া মুঢ়ের মতো বসিয়া রহিলাম।

কিন্তু অতঃপর যে কাণ্ড আরম্ভ হইল তাহার দাপটে হতবুদ্ধি হয় না এমন লোক স্বর্গধামে থাকিলেও মর্ত্ত্যলোকে নাই। জ্যোতিষী কৃষ্ণচরণবাবু তাহার ভক্ত অপরেশবাবুকে বিশ্বের যাবতীয় সম্ভাবনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করিতে লাগিলেন, তাহারই ছিটেফোঁটাতে আমাদের সাষ্ঠাঙ্গ সিক্ত হইয়া গেল। বরাবর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করিয়াছি যে জ্যোতিষীগণ ভবিষ্যৎ গণনায় যেমন উদার ভূতকাল গণনায় ততটা উদার নহেন। এ ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম ঘটিল না। আগামী বিশ্বযুদ্ধ কবে বাঁধিবে কোন কোন পক্ষে কোন কোন রাষ্ট্র থাকিবে, ভারত নিরপেক্ষ কিংবা মুখাপেক্ষী থাকিবে দেখিলাম সমস্তই কৃষ্ণচরণ বাবুর নখদর্পণে। মনে হইলো কিছুক্ষণের জন্য বিধাতার সেক্রেটারিয়েট স্বস্থান পরিত্যাগ করিয়া তাহার চেম্বারে আশ্রয় লইয়াছে। ঘন্টাখানেক এইরূপ চলিবার পরে তিনি উঠিলেন, কাজেই আমরাও উঠিলাম।

বাহিরে আসিলে আমি অত্যন্ত সন্তোষের সঙ্গে বলিলাম- একটু চা খেলে হ’তো না?
বেশ তো চলুন।
আমরা কৃতার্থ বোধ করিলাম, বিশ্বের অন্ধিসন্ধির রহস্য যাহার নোটবুকে তিনি আমাদের নিমন্ত্রণে চা পান করিতে রাজি হইয়াছেন – এ যে মহতের লীলা।

একই আভিজাত্য সম্পন্ন রেস্তোরায় গিয়া চারজনে বসিলাম।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বুঝিতে পারিলাম যে কৃষ্ণচরণবাবুতে মহাপুরুষোচিত অনেক লক্ষণই বর্ত্তমান এবং আমি নিরামিষে সমদৃষ্টি।

উঠিলাম তখন তার উদরপূর্তি সূত্রে অনেক কয়টি রজত মুদ্রা বাহির হইয়া গিয়াছে। বৃষ্টি পরিতেছিল, এত বড় জ্যোতিষীকে তো তখন ট্রামে বাসে বিদায় করিয়া দেওয়া যায় না- তাই ট্যাক্সি ভাড়া করিয়া তাহার স্বনিকেতনে পৌছাইয়া দিলাম। বাড়ি ফিরিবার সময়ে আমাদের প্রথম সম্বিৎ ফিরিয়া আসিল, মনে হইল যে উদ্দেশ্যে গিয়াছিলাম নিজেদের ভাগ্য গণনা সে সম্বন্ধে একটি প্রশ্নও করা হয় নাই। কিছুই আশ্চর্য্য নয়। মহাপুরুষ সঙ্গ আত্ম- প্রসঙ্গ ভুলাইয়া দেয় – এইখানেই তো তাহাদের মাহাত্ম্য।

দুই বন্ধু বাড়ি ফিরিলাম। দেখিলাম যে আমার বৈঠকখানার তক্তপোষের উপরে সকালবেলাকার সংবাদপত্রখানা পড়িয়া আছে। প্রথম নজরেই চোখে পড়িল- এ সপ্তাহের ফলাফল। ‘মীন রাশির অর্থক্ষয়’, আমার মীন রাশি। মেষ রাশি ‘প্রবঞ্চকের হাতে পড়িবে’ – বন্ধুর মেষ রাশি। আমাদের দুইজনের মুখে সমস্বরে বাহির হইলো- ‘শেষ পর্য্যন্ত জ্যোতিষের গণনাই সত্যি।‘

টাকা কয়টি বৃথা খরচ হয় নাই ভাবিয়া এক প্রকার সান্ত্বনা পাইলাম।

 

 

 

 

 

 

৭৯৫ পঠিত ... ১৮:২৫, জুলাই ৩১, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top