পরশুরামের রম্যগল্প 'উৎকণ্ঠা স্তম্ভ'

৫৬১ পঠিত ... ১৯:০৫, জুলাই ২৭, ২০১৯

 

বিলিতি খবরের কাগজে যাকে এ্যাগনি-কলম বলা হয় তাতে এক শ্রেনীর ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বহুকাল থেকে ছাপা হয়ে আসছে। ত্রিশ চল্লিশ বৎসর আগে বাঙলা কাগজে সে রকম বিজ্ঞাপন কদাচিৎ দেখা যেত, কিন্তু আজকাল ক্রমেই বাড়ছে। ‘হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ’ শীর্ষক স্তম্ভে তার অনেক উদাহরণ পাবেন। ইংরাজীতে যা এ্যাগনি কলম বাংলায় তারই নাম উৎকণ্ঠা স্তম্ভ। 

কয়েক মাস আগে দৈনিক যুগান্তর পত্রের উৎকণ্ঠা স্তম্ভে উপরি উপরি দু দিন এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গিয়েছিল–

বাবা পানু, যেখানেই থাক এখনই চলে এস, টাকার দরকার হয় তো জানিও। তোমার মা নেই, বুড়ো বাপ আর পিসীমাকে এমন কষ্ট দেওয়া কি উচিৎ? তুমি যাকে চাও তাঁর সঙ্গেই যাতে তোমার বিয়ে হয় তাঁর বযবস্থা আমি করব। কিচ্ছু ভেবো না, শীঘ্র চলে এসো।

-তোমার পিসীমা।

চারদিন পরে উক্ত কাগজে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল-

এই পেনো, পাজী হতভাগা শুয়োর, যদি ফিরে আসিস তবে জুতিয়ে লাট করে দেব। আমার দেরাজ থেকে তুই সাতশ টাকা চুরি করে পালিয়েছিস, শুনতে পাই বিপিন নন্দীর ধিঙ্গী মেয়ে লেত্তি তোর সঙ্গে গেছে। তুই ভেবেছিস কি? তোকে ফেরাবার জন্যে সাধাসাধি করবো? তেমন বাপই আমি নই। তোকে ত্যাজ্যপুত্র করলুম। তোর চাইতে ঢের ভাল ভাল ছেলের আমি জন্ম দেব, তার জন্য ঘটক লাগিয়েছি।

-তোর আগেকার বাপ। 

পানু-দা, চিঠিতে লিখে গেছ তিন দিন পরেই ফিরবে, কিন্তু আজও দেখা নেই। গেছ বেশ করেছ, কিন্তু আমার মফচেন আর ব্রোচ নিয়ে গেছ কেন? তুমি যে চোর তা ভাবতেই পারি নি। এখন তোমাকে চিনেছি, চেহারাটাই চটকদার, তা ছাড়া অন্য গুণ কিছুই নেই। অল্পদিনের মধ্যে বিদায় হয়েছে ভালোই, কিন্তু ফিরে এসো না। ভেবেছ আমার বুক ভেঙে যাবে, তোমাকে ফেরাবার জন্য সাধাসাধি করবো? সে রকম ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে আমি নই, নিজের পথ বেছে নিতে পারবো।

-লেত্তি।

উৎকণ্ঠা স্তম্ভের এই সব বিজ্ঞাপন পড়ে পাঠকবর্গ বিশেষত যাদের ফুরসত আছে, মহা উৎকণ্ঠায় পড়লো। অনেকে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে গবেষণা করতে লাগলো, ব্যাপারটা কী?

একজন বিচক্ষণ সিনেমার ঘুণ বললেন, বুঝছো না, এ হচ্ছে একটা নতুন ফিল্মের বিজ্ঞাপন, প্রথমটা শুধু পাবলিকের মনে সুরসুরি দিচ্ছে, তারপর খোলসা করে জানাবে আর বড় বড় পোস্টার সাঁটবে। আর একজন প্রবীণ সিনেমা রসিক বললেন, ছকু চৌধুরী যে নতুন ছবিটা বানাচ্ছে- কুঠো মুঠো প্রেম, নিশ্চয়ই তারই বিজ্ঞাপন। আর একজন বললেন, তোমরা কিছুই বোঝো না, এ হচ্ছে চা-এর বিজ্ঞাপন, দুদিন পরেই লিখবে- আমার নাম চা, আমাকে নিয়মিত পান করুন, তা হলেই সংসারে শান্তি বিরাজ করবে। আর একজন বললেন, চা নয়, এ হচ্ছে বনস্পতির বিজ্ঞাপন। বুড়োর দল কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত মানলেন না। তাদের মতে এ হচ্ছে মামুলি পারিবারিক কেলেঙ্কারির ব্যাপার, সিনেমা দেখা আর উপন্যাস পড়ে সমাজের যে অধঃপতন হয়েছে তারই লক্ষণ।

কয়েক দিন পরেই উৎকণ্ঠা স্তম্ভে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল-

লেত্তি দেবী, আপনার মনের বল দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার ভালো নাম লতিকা কি ললিতা তা জানি না, আমাকেও আপনি চিনবেন না, তবু সাহস করে অনুরোধ করছি, আপনার ব্যর্থ অতীতকে পদাঘাতে দূরে নিক্ষেপ করুন, প্রেমের বীর্যে অশঙ্কিনী হয়ে আমার পাশে এসে দাড়ান, আমরা দুজনে স্বর্ণময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতে অগ্রসর হব। আমি আপনার অযোগ্য সাথী নই, এই গ্যারান্টি দিতে পারি। আরও অনেক কিছু লিখতুম, কিন্তু কাগজওয়ালারা ডাকাত, এক লাইনের রেট পাঁচ সিকে নেয়, সেজন্যে এখানেই থামতে হল। উত্তরের আশায় উৎকণ্ঠিত হয়ে রইলুম, আপনার ঠিকানা পেলে মনের কথা সবিস্তারে লিখব।

-কৃষ্ণধন কুণ্ডু ( বয়স ২৬), এঞ্জিনিয়ার, গণেশ কটন মিল, পারেল, বম্বে।

দু দিন পরে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেলো-

শ্রীমান পানুর পিতা মহাশয়, আপনার বিজ্ঞাপন দৃষ্টে জানিলাম আপনি আবার বিবাহ করিবেন সে কারণে ঘটক লাগাইয়াছেন। যদি ইতিমধ্যে অন্য কাহারও সঙ্গে  পাকা কথা না হইয়া থাকে তবে আমার প্রস্তাবটি বিবেচনা করিবেন। আমি এখানকার ফিমেল জেলের সুপারইনটেন্ডেন্, বয়স চল্লিশের কম, হাজার দশেক টাকা পুঁজি আছে। চাকরি আর ভালো লাগে না, বড়ই অপ্রীতিরকর, সেজন্য সংসার ধর্ম করিতে চাই। যদি আমার পাণিগ্রহনে সম্মত থাকেন তবে সত্বর জানাইবেন, কারণ আরও দুই ব্যক্তির সাথে কথাবার্তা চলিতেছে।

-ডক্টর মিস সত্যভামা ব্যানার্জি, পিএইচডি, ফিমেল জেল, চুন্দ্রিগড়।

এরপর উৎকণ্ঠা স্তম্ভে আর কোনও বিজ্ঞাপন দেখা গেলো না কিন্তু ব্যাপারটি অনেক দূর গড়িয়েছিল। বিশ্বস্ত সূত্রে যা জানা গেছে তাই সংক্ষেপে বলছি।

বিপিন নন্দীর মেয়ে লেত্তি ( ভালো নাম লজ্জাবতী) কৃষ্ণধন কুণ্ডুকে বিয়ে করেছে। পানু অর্থাৎ প্রাণতোষের বাপ মনোতোষ ভটচাজ ডক্টর সত্যভামাকে বিয়ে করেছেন। অগত্যা পানুর পিসীমা কাশী চলে গেছেন।

বোম্বাই থেকে পানু তার বাপকে চিঠি লিখেছে –

'পূজনীয় বাবা, তোমার টাকার জন্য ভেবো না, যা নিয়েছিলুম সুদ সুদ্ধ ফেরত দেবো। আমি মোটেই কুপুত্তুর নই, ফেলনা বংশধর নই, তোমার বংশ আমি উজ্জ্বল করেছি। আমার নাম এখন প্রাণতোষ নয়, সুন্দরকুমার। নয়নসুখ ফিল্ম কোম্পানিতে জয়েন করেছি, বেশ ভালো রোজগার। এখানে আমার খুব নাম, সবাই বলে সুন্দরকুমারের মতো খুবসুরত এ্যাক্টর দেখা যায় না। শুনলে অবাক হবে, বিখ্যাত স্টার মিস গুলাবা আমাকে বিবাহ করেছেন। তাঁর কত টাকা আছে জানো? পাঁচ লাখা বাহান্ন হাজার, তাছাড়া তিনটে মোটর কার। আআমী রবিবার বম্বে মেলে আমি সস্ত্রীক কলকাতায় পৌছুব। আমাদের জন্যে দোতলার বড় ঘরটা সাহেবী স্টাইলে সাজিয়ে রেখো, ফুলদানিতে এক গোছা রজনীগন্ধা যেন থাকে। ভয় নাই, বেশী দিন থাকব না, হপ্তা খানেক পরেই বোম্বাই-এ ফিরে আসবো।'

মনোতোষ ভটচাজের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ডকটর সত্যভামা বললেন, তা ছেলেটা আসছে আসুক না, তুমি গালাগাল দিও না বাপু। পানু আমাদের বাহাদুর ছেলে।

কৃষ্ণধন কুণ্ডু ছুটি নিয়ে তার বউ লেত্তির সাথে কলকাতায় এসেছিল। পানু সস্ত্রীক বাড়ি আসছে শুনে লেত্তি চুপ করে থাকতে পারল না, মনোতোষ ভটচাজের বাড়িতে উপস্থিত হল। পাড়ার আরও অনেকে এল, সিনেমা স্টার গুলাবাকে দেখার জন্য। কিন্তু পানুকে একলা দেখে সবাই নিরাশ হল।

মনোতোষ বললেন, একা এলি যে? তোর বউ কোন চুলোয় গেল?

মাথা চুলকে পানু বললো, সে আসতে পারলো না বাবা, হঠাৎ মস্কো থেকে একটা তার এলো, তাই এক মাসের জন্যে সোবিয়েত কালচারাল টুর করতে গেছে।

লেত্তি বললো, সব মিছে কথা। আমরা সদ্য বোম্বাই থেকে এসেছি, সেখানকার সব খবর জানি। গুলাবা ভেরেন্দী তোমাকে বিয়ে করবে কোন দুঃখে? দু বছর আগে নবাবজাদা সোভানুল্লার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিলো। তাঁকে তালাক দিয়ে গুলাবা সম্প্রতি লগনচাঁদ বাজাজকে বিয়ে করেছে। তুমি তো গ্র্যান্ডরোডে একটা ইরানী হোটেলে বয়-এর কাজ করতে, চুরি করেছিলে তাই তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

মনোতোষ গর্জন করে বললেন, দূর হ জোচ্চর ভ্যাগাবন্ড, নয়তো জুতিয়ে লাট করে দেবো।

সত্যভামা বললেন, আহা, ছেলেটাকে এখনই তাড়াচ্ছ কেন? আগে একটু জিরুক। বাবা পানু, ভেবো না, তোমার একটা হিল্লে আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। আমার ফ্রেন্ড মিস্টার হায়দার মুস্তফা কলকাতায় এসেছেন। দক্ষিণ বর্মায় মৌলমিন শহরে তাঁর বিরাট পোলট্রি ফার্ম আছে, আমি তাকে বললেই তোমাকে তার ম্যানেজার করে দেবেন। তুমি তৈরি হয়ে নাও, পরশু তিনি রওনা হবেন, তারই সঙ্গেই তুমি যাবে। টাকার জন্যে ভেবো না, আমি তোমার জাহাজ ভাড়া আর কিছু হাত খরচ দেবো।  

অতঃপর সকলের উৎকন্ঠার অবসান হল। তবে পানুর হিল্লে এখনও পাকাপাকি লাগে নি। সাত দিন পরেই সে মুস্তাফা সাহেবের কিছু টাকা চুরি করে সিংগাপুর পালিয়ে গেল। সেখানে পিপলস চায়না হোটেলে একটা কাজ যোগাড় করেছে, খদ্দেরদের খাবার পরিবেশন করতে হয়। হোটেলের মালিক মিস ফুক-সান তাকে সুনজরে দেখে। পানুর আশা আছে, ভালো করে খোশামোদ করতে পারলে মিস ফুক-সান তাকে পোষ্য পতির পদে প্রমোশন দেবেন।

৫৬১ পঠিত ... ১৯:০৫, জুলাই ২৭, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top