বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ফখরুল আবেদিন যারপরনাই ব্রাজিল-সমর্থক। কিন্তু তার স্ত্রী টিনা কায়মনোবাক্যে আর্জেন্টিনার একনিষ্ঠ ভক্ত। সেই ম্যারাডোনার আমল থেকেই টিনা আর্জেন্টিনার নামে পাগল। ম্যারাডোনাকে যেবার বিশ্বকাপে লাল কার্ড দেখিয়ে বহিষ্কার করা হয়েছিল, সেবার নাকি টিনা সারা রাত কেঁদেছিল। ফখরুল অবশ্য সেসব দৃশ্য দেখেনি, কারণ তখনো তাদের বিয়ে হয়নি। তাদের বিয়ের পরে তিনটা বিশ্বকাপ ফুটবল হয়েছে এবং এর মধ্যে তিনবারই ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মারাত্মক ঝগড়াবিবাদ ঘটে গেছে। তাদের ১০ বছরের মেয়ে বর্ষা অবশ্য স্পেনের সমর্থক। মা-বাবার ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে সে নেই।
এবার মেসি আর আর্জেন্টিনা আসছে ঢাকায়, নাইজেরিয়ার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলতে। টিনার ঘুম হারাম। ‘মেসি ঢাকায় আসবে, আর আমরা দেখতে যাব না, তাও কি হয়?’
ফখরুল ভাবে, আলবত হয়। কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। অগত্যা সাড়ে ২২ হাজার টাকা খরচ করে ফখরুল তিনটা টিকিট কিনে ফেলে। এটাই সবচেয়ে সস্তার টিকিট। ২২ হাজার টাকায় কত কী করা যেত, ব্যাংকার ফখরুল মনে মনে হিসাব করে। কিন্তু হিসাব করে লাভ কী! এই টাকাটা বাঁচানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যা হবে, তাতে ৪৪ হাজার টাকার মানসিক শান্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
মেসি ঢাকায় নেমেছেন। টিনা অস্থির। মেসি বাসে উঠেছেন, টেলিভিশনে লাইভ দেখাচ্ছে। টিনা ফোনেই লাইভ ধারাবিবরণী দিতে থাকে। খেলা শুরু হবে সাতটায়। ছয়টার মধ্যে গেট বন্ধ হয়ে যাবে। পত্রিকা দেখে টিনা জানায়। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে ফখরুল বাসায় চলে আসে। টিনা আর বর্ষাকে তুলে নিয়ে গাড়িতে স্টেডিয়ামের দিকে রওনা হয়।
একই দিনে আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও এসেছেন ঢাকায়। কখন যে কোন রাস্তা পুলিশ বন্ধ করে দিচ্ছে, কোনো ঠিক নেই।
পান্থপথে এসে গাড়ি আটকে যায়। বসুন্ধরা থেকে সোনারগাঁও হোটেলের দিকের রাস্তার গাড়ি একচুলও নড়ছে না। ‘সোয়া পাঁচটা বাজে। ছয়টার পর গেট বন্ধ করে দেবে।’ টিনা কেঁদে ফেলে। ফখরুল নির্বিকার। ‘ছয়টার সময় কোনো দিনও গেট বন্ধ করবে না। আমাদের কাছে টিকিট আছে না?’
‘কিন্তু এই রাস্তা সাতটার সময়ও খুলবে না। চলো, নেমে হাঁটি।’ ফখরুল আনন্দিত। হাঁটতে সে পছন্দ করে। তার মধ্যভাগ স্ফীত হচ্ছে। হাঁটলে যদি ভুঁড়িটা একটু কমে।
তারা হেঁটে সোনারগাঁও মোড় পার হয়ে একটা স্কুটার নিয়ে নিল। ভাগ্যিস সময়মতো পাওয়া গেল। প্রেসক্লাবের মোড়ে আবার যানজট। এবার স্কুটার ছেড়ে দিয়ে তারা হাঁটতে লাগল।
টিনা এমনিতে হাঁটতে চায় না। কিন্তু আজ তার উত্সাহের কমতি নেই। মেসির খেলা দেখা বলে কথা।
অনেকটা পথ হেঁটে তারা এসে পড়ল স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিকে। তাদের গেট নম্বর ৮। ৮ নম্বর গেট কোনটা? খুঁজে খুঁজে গেটের কাছে গিয়ে বুঝল, ভুল করেছে। বিশাল লাইন। সেই লাইনের মাথা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল তারা।
আধঘণ্টা ধরে তারা তিনজন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে তারা দ্বাররক্ষীর কাছাকাছি আসতে সমর্থ হলো। মেটাল ডিটেকটর পেরিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বাররক্ষী বলল, ‘আপা, আপনার ব্যাগ চেক করতে হবে।’
ব্যাগ চেক করার পর বেরোল একটা আইলাইনার।
রক্ষী বলল, ‘এটা নিয়ে যাওয়া যাবে না।’
টিনা বলল, ‘এটা হলো আইলাইনার। এটা দিয়ে চোখে কাজলের মতো দেওয়া যায়। এটা নিলে কী ক্ষতি? আমি কি মেসির চোখে কাজল এঁকে দেব?’
রক্ষীরা বলল, ‘তা জানি না। কিন্তু কোনো রকমের পেনসিল, কলম নিয়ে ঢোকা নিষেধ। দেখেন, টিকিটের পেছনে লেখা আছে।’
টিনা বলল, ‘মাথা খারাপ? আমি এই আইলাইনার ছেড়ে কিছুতেই ভেতরে ঢুকব না। এটা আমি আমেরিকা থেকে আনিয়েছি। এর দাম ৩০ ডলার। মানে প্রায় ২৪০০ টাকা।’
রক্ষীরা বলল, ‘আপনি ভেতরে যেতে না চাইলে সরে দাঁড়ান। অন্যদের যেতে দিন।’
বর্ষা বলল, ‘মা, চলো। একটা আইলাইনার ফেলে দিলে কী হয়?’
টিনা বলল, ‘মাথা খারাপ? আমি এই আইলাইনার ফেলে দিলে মরেই যাব।’
ফখরুল বলল, ‘তাহলে কী করব? আমি না হয় আইলাইনার নিয়ে বাড়ি চলে যাই।’
টিনা বলল, ‘মাথা খারাপ? এই ভিড়ের মধ্যে আমরা দুটো মেয়ে একা একা ঢুকব নাকি গ্যালারিতে?
শেষে রফা হলো একটা। দ্বাররক্ষীর কাছেই আইলাইনারটা থাকবে। তার নাম আর মোবাইল নম্বর টুকে নেওয়া হলো। ফেরার পথে আইলাইনারটা তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে।
ভেতরে লোক গিজগিজ করছে। খুঁজে-পেতে তারা তাদের আসনে বসে পড়ল।
টিনা পরেছে নীল আর সাদার কম্বিনেশন। বর্ষার পোশাকে যথারীতি স্পেনের লাল। চারদিকে শুধু নীল আর সাদা। বড় বড় আর্জেন্টিনার পতাকা। অনেকেই আর্জেন্টিনার জার্সি পরে এসেছে। মুখে আর্জেন্টিনার পতাকাও এঁকেছে কেউ কেউ। মেসি মেসি বলে চিত্কার করে উঠছে গ্যালারি। ওই যে ওরা নামছে। গ্যালারিতে সাগরের গর্জন। খেলা শুরু হলো।
কোনটা মেসি—খালি চোখে দেখা মুশকিল। ওই যে হলদে কমলাটে জুতাজোড়া, ওইটা মেসি। ওই রঙের জুতা পরেছে দুজন।
ফখরুলের মনে হচ্ছে, নাইজেরিয়াই তো ভালো খেলছে। ইস, আজ যদি নাইজেরিয়া জেতে, টিনা তো তিন দিন খাওয়াদাওয়াই করবে না। আর এই গ্যালারি ভর্তি দর্শকদের কী হবে?
ফাউল!
কে ফাউল করল? রিপ্লে! রিপ্লে!
গ্যালারিতে টেলিভিশন নেই। রিপ্লে দেখা যায় না।
গোল!
মেসির চমত্কার পাস। হিগুয়েন গোল করলেন অনবদ্য। কেউ হিগুয়েনের কথা বলছে না। সবাই শুধু মেসির পাসটা দেখল। ফখরুলের মনের মধ্যে ব্রাজিলীয় প্যাঁচ। এই প্যাঁচের জবাব দেওয়ার জন্যই বোধ হয় মেসি মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে ছুটতে লাগলেন। পেছনে পেছনে তিনজন। তাঁর সামনে আরও একজন। ওই পাশে আরও একজন। কিন্তু মেসিকে ঠেকায় সাধ্য কার। মেসি গোলের কাছে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় প্লেসিং শট করলেন। গোলকিপারের এই বলে বাধা দেওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তিনি দিলেন। তাঁর গায়ে লেগে বল ফিরে আসতেই আরেকজন নীল-সাদা গোল দিয়ে দিলেন।
ফখরুল কখন দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করেছে, সে জানে না। সে চিত্কার করে উঠছে, মেসি! মেসি! নতুন শতকের সেরা গোলটাই প্রায় মেসি দিয়ে ফেলেছিল। ফখরুল এই খেলা নিজের চোখে দেখেছে। সে ইতিহাসের সাক্ষী।
ফখরুল তার ২২ হাজার টাকার দুঃখ ভুলে গেল। কিন্তু টিনা তার আইলাইনারের কথা ভুলতে পারল না। ফেরার সময় সে বলে, ‘কুদ্দুস কই?’
‘কোন কুদ্দুস?’
‘ওই যে গেটে যার কাছে আইলাইনারটা দিয়েছিলাম?’
তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
‘ফোন করো।’
রিং হচ্ছে। কুদ্দুস ফোন ধরছে না।
টিনা বলল, ‘আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না।’
ফখরুল বলল, ‘তোমাকে আমি আবার আইলাইনার কিনে দেব।’
‘না, এই শেডটা কোথাও আর পাওয়া যায় না।’
‘আচ্ছা চলো, জাহিদ মামাকে ফোন করি। জাহিদ মামা পুলিশের ডিআইজি। তিনি নিশ্চয়ই এই কুদ্দুসকে খুঁজে বের করবেন।’
তারপর কত জল ঘোলা করে যে সেই কুদ্দুসকে বের করা হয়েছিল আর আইলাইনারটা উদ্ধার করা হয়েছিল, সেটা বলতে গেলে সাত কাণ্ড হয়ে যাবে।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন