আবুল মনসুর আহমদের শৈশবের একটি গল্প

১২৫৫ পঠিত ... ১৮:৩৪, মার্চ ১৮, ২০১৯

আবুল মনসুর আহমদ বাংলার রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিশের দশক থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ঢাকায় কলেজের পড়ালেখা শেষে উচ্চশিক্ষা নিতে কলকাতায় যাওয়ার পর জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রথম দিকে চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টির রাজনীতি করে এরপর যোগ দেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিতে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে কৃষক প্রজা পার্টিকে শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করায় আবুল মনসুর আহমদের অবদান অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে সংসদের সদস্য হয়েছেন একাধিকবার। পাকিস্তান আমলে কৃষক প্রজা পার্টির হয়ে মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি।

তবে এসবের চাইতেও আবুল মনসুর আহমদ অন্য অনেকের চাইতে একেবারে আলাদা তার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের জন্য। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকাকালীন সময় বাংলা তথা উপমহাদেশ কাটিয়েছে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে টালমাটাল সময়টি। বাংলার ইতিহাস বদলে দেওয়া অনেক মুহূর্তের সাক্ষী এবং পরোক্ষ প্রভাবক হিসেবে ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ, সত্যি বলতে এই অঞ্চলের প্রায় সাত দশকের রাজনীতির নানা দিকের কথা বলেছেন তিনি বইটিতে। প্রাপ্তবয়সে রাজনীতিতে এমন ভূমিকা রাখা আবুল মনসুর আহমদের ছেলেবেলাও কেটেছে কিছুটা আলাদাভাবে। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটি থেকেই তার শৈশবের একটি গল্প থাকছে eআরকির পাঠকদের জন্য।

আত্ম-মর্যাদা-বোধ

 

আমাদের পাঠশালাটা ছিল জমিদারের কাছারিরই একটি ঘর। কাছারিঘরের সামন দিয়াই যাতায়াতের রাস্তা। পাঠশালায় ঘড়ি থাকিবার কথা নয় কাছারিঘরের দেওয়াল-ঘড়িটাই পাঠশালার জন্য যথেষ্ট। কতটা বাজিল, জানিবার জন্য মাস্টার মশায় সময়-সময় আমাদেরে পাঠাইতেন। ঘড়ির কাঁটা চিনা সহজ কাজ নয়। যে দুই-তিন জন ছাত্র এটা পারিত, তার মধ্যে আমি একজন।

কিছু দিনের মধ্যে একটা ব্যাপারে আমি মনে বিষম আঘাত পাইলাম। অপমান বোধ করিলাম। দেখিলাম, আমাদের বাড়ির ও গাঁয়ের মুরুব্বিরা নায়েব-আমলাদের সাথে দরবার করিবার সময় দাঁড়াইয়া থাকেন। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝি নাই। আরও কিছু দিন পরে জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদেরে নায়েব-আমলারা 'তুমি' বলেন। নায়েব-আমলারা আমাদেরেও ‘তুই তুমি’ বলিতেন। আমরা কিছু মনে করিতাম না। ভাবিতাম, আমাদের মুরুব্বিদের মতই ওরাও আদর করিয়াই এমন সম্বোধন করেন। পরে যখন দেখিলাম, আমাদের বুড়া মুরুব্বিদেরেও তাঁরা 'তুমি' বলেন, তখন খবর না লইয়া পারিলাম না। জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদেরে ‘তুমি’ বলা ও কাছারিতে বসিতে না দেওয়ার কারণ একটাই। নায়েব-আমলারা মুসলমানদেরে ঘৃণা-হেকারত করেন। ভদ্রলোক মনে করেন না। তবে ত সব হিন্দুরাই মুসলমানদেরে ঘৃণা করে! হাতে -নাতে এর প্রমাণও পাইলাম। পাশের গাঁয়ের এক গণক ঠাকুর প্রতি সপ্তাহেই আমাদের বাড়িতে ভিক্ষা করিতে আসিত। কিছু বেশী চাউল দিলে সে আমাদের হাত গণনা করিত। আমাদেরে রাজা-বাদশা বানাইয়া দিত। এই গণক ঠাকুরকে দেখিলাম একদিন নায়েব মশায়ের সামনে চেয়ারে বসিয়া আলাপ করিতেছে। নায়েব মশাই তাকে 'আপনি' বলিতেছেন। এই খালি-পা খালি-গা ময়লা ধুতি-পরা গণক ঠাকুরকে নায়েব বাবু এত সম্মান করিতেছেন কেন? আমাদের বাড়িতে তাকে ত কোন দিন চেয়ারে বসিতে দেখি নাই। উত্তর পাইলাম, গণক ঠাকুর হিন্দু ব্রাহ্মণ । কিন্তু আমাদের মোল্লা-মৌলবীদেরেও ত নায়েব-আমলারা ‘আপনে’ বলেন না, চেয়ারে বসান না। আর কোনও সন্দেহ থাকিল না আমার মনে। রাগে মন গিরগির করিতে থাকিল।

কাছারির নায়েব-আমলাদের বড়শি বাওয়ায় সখ ছিল খুব। সারা গাঁয়ের মাতব্বর প্রজাদের বড় বড় পুকুরে মাছ ধরিয়া বেড়ান ছিল তাঁদের অভ্যাস। অধিকারও ছিল। গাঁয়ের মাতব্বরদেরও এই অভ্যাস ছিল। নিজেদের পুকুর ছাড়াও দল বাঁধিয়া অপরের পুকুরে বড়শি বাইতেন তাঁরাও। কিন্তু পুকুরওয়ালাকে আগে খবর দিয়াই তাঁরা তা করিতেন। কিন্তু নায়েব-আমলাদের জন্য পূর্ব-অনুমতি দরকার ছিল না। বিনা-খবরে তাঁরা যেদিন-যার-পুকুরে-ইচ্ছা যত-জন-খুশি বড়শি ফেলিতে পারিতেন।

একদিন আমাদের পুকুরেও এমনিভাবে তাঁরা বড়শি ফেলিয়াছেন। তাঁদের নির্বাচিত সুবিধা-জনক জায়গা বাদে আমি নিজেও পুকুরের এক কোণে বড়শি ফেলিয়াছি। নায়েব বাবুরা ঘটা করিয়া সুগন্ধি 'চারা' ফেলিয়া হরেক রকমের আধার দিয়া বড়শি বাহিতেছেন। আর আমি বরাবরের মত চিড়ার আধার দিয়া বাহিতেছি। কিন্তু মাছে খাইতেছে আমার বড়শিতেই বেশী। নায়েব বাবুদের চারায় মাছ জমে খুব। কিন্তু মোটেই খায় না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া নায়েব বাবু উচ্চসুরে আমার নাম ধরিয়া ডাকিয়া বলিলেন: তোর আধার কিরে?

‘তুই’ শুনিয়াই আহার মাথায় আগুন লাগিল। অতিকষ্টে রাগ দমন করিয়া উত্তর দিলাম: চিড়া।

নায়েব বাবু হাকিলেন: আমারে একটু দিয়া যা ত।

সমান জোরে আমি হাকিলাম: আমার সময় নাই, তোর দরকার থাকে নিয়া যা আইসা।

নায়েব বাবু বোধ হয় আমার কথা শুনিতে পান নাই। শুনিলেও বিশ্বাস করেন নাই। আবার হাকিলেন: কি কইলে?

আমি তেমনি জোরেই আবার বলিলাম: তুই যা কইলে আমিও তাই কইলাম।

নায়েব বাবু হাতের ছিপটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া লম্বা-লম্বা পা ফেলিয়া পানির ধার হইতে পুকুরের পাড়ে উঠিয়া আসিলেন। ওঁদের বসিবার জন্য পুকুর পাড়ের লিচু গাছ তলায় চেয়ার-টেয়ার পাতাই ছিল সেদিকে যাইতে-যাইতে গলার জোরে ‘ফরাযী! ও ফরাযী! বাড়ি আছ?' বলিয়া দাদাজীকে ডাকিতে লাগিলেন। আমি বুঝিলাম, নায়েব বাবু ক্ষেপিয়া গিয়াছেন। সংগী আমলারাও নিশ্চয়ই বুঝিলেন। তাঁরাও যাঁর-তাঁর ছিপ তুলিয়া নায়েব বাবুর কাছে আসিলেন। আমি নিজের জায়গায় বসিয়া রহিলাম। কিন্তু নযর থাকিল ঐদিকে। দাদাজীর ডাক পড়িয়াছে কিনা! তামেশগির পাড়ার লোকেরাও নায়েব বাবুকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে। নায়ের বাবু আবার গলা ফাটাইয়া চিৎকার করিলেন: ‘ফরাজী, তোমারে কইয়া যাই, তোমার নাতি ছোকরা আমারে অপমান করছে। আমরা আর তোমার পুকুরে বড়শি বাইমু না। মুক্তাগাছায় আমি সব রিপোর্ট করুম।’

চিৎকার শুনিয়া আমার বাপ চাচা দাদা কেউ মসজিদ হইতে কেউ বাড়ির মধ্যে হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। সকলেই প্রায় সমস্বরে বলিলেন: কেটা আপনেরে অপমান করছে? কার এমন বুকের পাটা?

নায়েব বাবু সবিস্তারে বলিলেন, আমি তাঁকে ‘তুই’ বলিয়াছি। আমার মুরুব্বিদের এবং সমবেত প্রতিবেশীদের সকলেই যেন ভয়ে নিস্তব্ধ হইয়া গেলেন। দাদাজী হুংকার দিয়া আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন: এদিকি আয়। পাজি, জলদি আয়।

আমি গিয়া দাদাজীর গা ঘেষিয়া দাঁড়াইতে চাহিলাম। দাদাজী খাতির না করিয়া ধমক দিয়া বলিলেন: ওরে শয়তান, তুই নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইছস?

আমি মুখে জবাব না দিয়া মাথা ঝুকাইয়া জানাইলাম: সত্যই তা করিয়াছি।

দাদাজী গলা চড়াইয়া আমার গালে চড় মারিবার জন্য হাত উঠাইয়া, কিন্তু না মারিয়া, গর্জন করিলেন: বেআদব বেত্তমিয, তুই নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইলি কোন্‌ আক্কেলে?

এবার আমি মুখ খুলিলাম ৷ বলিলাম: নায়েব বাবু আমারে তুই কইল কেন?

দাদাজী কিছুমাত্র ঠাণ্ডা না হইয়া বলিলেন: বয়সে বড়, তোর মুরুব্বি৷ তানি তোরে ‘তুই’ কইব বইলা তুইও তানরে তুই কইবি? এই বেত্তমিযি তুই শিখছস কই? আমরা তোরে তুই কই না? নায়েব বাবু তানার ছাওয়ালরে তুই কয় না?

আমি দাদাজীর দিকে মুখ তুলিয়া নায়েব বাবুকে এক নযর দেখিয়া লইয়া বলিলাম: আপনে বাপজী কেউই ত বয়সে ছোট না, তবে আপনেগরে নায়েব বাবু ‘তুমি’ কয় কেন?

দাদাজী নিরুত্তর। কারও মুখে কথা নাই। নায়েব-আমলাদের মুখেও না। আমার বুকে সাহস আসিল। বিজয়ীর চিত্ত-চাঞ্চল্য অনুভব করিলাম। আড়-চোখে লোকজনের মুখের ভাব দেখিবার চেষ্টা করিলাম। কারও কারও মুখে মুচকি হাসির আঁচ পাইলাম।

দাদাজী হাতজোড় করিয়া নায়েব বাবুর কাছে মাফ চাহিলেন। বড়শি বাইতে অনুরোধ করিলেন। আমাকে ধমক দিয়া বলিলেন: যা বেত্তমিয শয়তান, নায়েব বাবুর কাছে মাফ চা। বাপের বয়েসী মুরুব্বিরে তুই কইয়া গোনা করছস।

আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়াইয়া বলিলাম: আগে নায়েব বাবু মাফ চাউক, পরে আমি মাফ চামু।

মিটানো ব্যাপারটা আমি আবার তাজা করিতেছি দেখিয়াই বোধ হয় দাদাজী কুঁদিয়া উঠিলেন। বলিলেন: নায়েব বাবু মাফ চাইব? কেন কার কাছে?

আমি নির্ভয়ে বলিলাম: আপনে নায়েব বাবুর বাপের বয়েসী না? আপনেরে তুমি কইয়া তানি গোনা করছে না? তারই লাগি মাফ চাইব নায়েব বাবু আপনের কাছে।

দাদাজী আরও খানিক হৈ চৈ রাগারাগি করিলেন। আমারে ফসিহত করিলেন। উপস্থিত মুরুব্বিদেরও অনেকে আমাকে ধমক-সালাবত দেখাইলেন। আমাকে অটল নিরুত্তর দেখিয়া পাড়ার লোকসহ আমার মুরুরব্বিরা নিজেরাই নায়েব বাবু ও তাঁর সংগীদেরে জনে-জনে কাকুতি মিনতি জানাইলেন। কিন্তু নায়েব বাবু শুনিলেন না। সংগীদেরে লইয়া মুখে গজগজ ও পায়ে দম্‌ দম্‌ করিয়া চলিয়া গেলেন।

আমাদের পরিবারের সকলের ও পাড়ার অনেকের দুশ্চিন্তায় কাল কাটিতে লাগিল। আমার মত পাগলকে লইয়া ফরাযী বাড়ির বিপদই হইয়াছে। এই মর্মে সকলের রায় হইয়া গেল। বেশ কিছুদিন আমিও দুশ্চিন্তায় কাটাইলাম। প্রায়ই শুনিতাম, আমাকে ধরিয়া কাছারিতে এমন কি মুক্তাগাছায়, নিয়া তক্তা-পিষা করা হইবে। দাদী ও মা কিছুদিন আমাকে ত পাঠশালায় যাইতেই দিলেন না। পাঠশালাটা ত কাছারিতেই।

১২৫৫ পঠিত ... ১৮:৩৪, মার্চ ১৮, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top