কুরিয়ারে যেবার আমি টিয়াপাখি পাঠাতে চাইলাম

৩১৮০ পঠিত ... ১৪:১৮, ডিসেম্বর ০২, ২০১৮

কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান ছেলেটা আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল, 'ভাইয়া এইটা তো নেয়া যাবে না!'

-কেন? আমি তো তোমাদের কুরিয়ার সার্ভিসে নিয়মিত পণ্য পাঠাচ্ছি। প্রতিদিনই ক্লায়েন্টের কাছে প্রডাক্ট পাঠাচ্ছি। ওগুলা নিচ্ছ, তাহলে এটা নিবা না কেন?

-ভাইয়া আপনার ব্যবসার প্রডাক্ট আর এইটা তো এক না।

-প্রডাক্ট দিয়ে তুমি কী করবা? তোমাদের প্রতিষ্ঠানের কাজ ডেলিভারি দেয়া, ডেলিভারি পৌঁছে দিবা।

-সব প্রডাক্ট তো ডেলিভারি দেই না আমরা। যেমন কেউ যদি মাদকদ্রব্য দিয়ে বলে ডেলিভারি করতে তাহলে তো আমরা করব না, তাই না?

আমি চোখ বড় বড় করে গালের পেশী শক্ত করে বললাম,

-এইটা দেখে তোমার মাদকদ্রব্য মনে হচ্ছে?

-না না ভাইয়া, উদাহরণ দিলাম আর কি।

-এমন ছাগল মার্কা উদাহরণ দাও কেন? আর এতদিন আমাদের কোম্পানির সাথে কাজ করার পরে তোমার মনে হয় যে আমি তোমাকে অবৈধ কিছু দেবো ডেলিভারি করতে?

-না ভাইয়া, আমি সেইটা বুঝাইতে চাই নাই, এমনিতেই উদাহরণ দিলাম।

-উদাহরণে কাজ হবে না। ইমার্জেন্সি ডেলিভারি এইটা, নিতে তোমাকে হবেই।

-ভাইয়া এক মিনিট অপেক্ষা করেন, আমি অফিসে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি কী করবো।

 অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

ছেলেটা আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে ফোন দিল অফিসে। আবার পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখল আমি শুনছি কি না। আমি জানি ও অফিসে আমার নামে বদনাম করছে। কিন্তু লাভ হবে না। আমি ওদের একদম শুরুর দিকের রেপুটেড ক্লায়েন্ট। ডেলিভারি ওকে নিতেই হবে।

অফিস থেকে কী বলল কে জানে। ছেলেটা অনেকটা রিল্যাক্সড হয়ে এসে মিচকা হাসি দিয়ে বলল, ভাইয়া অফিস থেকে বলছে আপনাকে ফোন দিবে এখন।

আমি ফোন হাতে একবার স্ক্রিনের দিকে তাকাই, আরেকবার মিচকার দিকে। মিচকার বয়স বিশ-একুশ বছর হবে। গত একমাস যাবত আমাদের ডেলিভারিগুলা ও নিয়ে যায়। এই বয়সের ছেলেরা ইঁচড়েপাকা হয়। ভাবখানা এমনে যে দুনিয়ার সব সে জানে। সে একজন জলজ্যান্ত উইকিপিডিয়া।

দুইদিন সিগারেট হাতে আমার সামনে পড়েছে। প্রথমদিন সিগারেট ফেলে দৌড় দিয়েছে। পরেরবার এমন একটা ভাব ধরছে যাকে বলে, সিগারেট আপনার বাবার টাকায় খাই? আমিও দেখে না দেখার ভান করে কেটে গেছি।

মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করে সুমিষ্ট গলা শুনে বুঝে ফেললাম ওপাশে সাদিয়া। আমাদের অধিকাংশ ডেলিভারিগুলো সাদিয়া ও আফরোজা হ্যান্ডেল করে। আফরোজার মেজাজ তিরিক্ষ। কথায় তেমন মাধুর্য নেই। সাদিয়া আবার খুব নরম মেয়ে। আমি গলে যাওয়া গলায় বললাম,

-হ্যাঁ সাদিয়া, কেমন আছ?

-জ্বি স্যার ভাল আছি? ডেলিভারি নিয়ে কোন সমস্যা?

-জিজ্ঞেস করলা না তো আমি কেমন আছি?

-আপনি কেমন আছেন স্যার?

-এখন ভাল আছি। দুপুরে খেয়েছ?

-জ্বি স্যার, খেয়েছি। কি সমস্যা হচ্ছে একটু খুলে বলবেন প্লিজ?

-আমিতো সব খুলেই বলতে চাই, তুমি তো ফোনে দেখতে পারবা না। হা হা হা।

-স্যার ডেলিভারিম্যান বললো, আপনি নাকি একটা টিয়া পাখি ডেলিভারি করতে চান?

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। আমি একটা পাখি ডেলিভারি করতে চাচ্ছি। ঘটনা হচ্ছে আমার ভাগ্নি থাকে চিটাগাং। কাটাবন অনলাইন গ্রুপে একটা পাখি তার খুব পছন্দ হয়েছে। বিকাশে টাকা পাঠায় আমার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। আজকে ছোকরা মতন এক ছেলে এসে সকালে পাখিটা জোর করে দিয়ে গেছে। আমি তখন দাঁত ব্রাশ করছিলাম। দরজায় ধুপধাপ আওয়াজ শুনে দরজা খুলে বললাম,

-কারে চাই?

-আঙ্কেল রিক কার নাম?

-ঐ বদমাশ, আঙ্কেল কে? আমি তোর বাপের ভাই? আমার নাম রিক। কী দরকার?

-এই টিয়া পাখিটা আপনার কাছে দিতে বলছে।

বলেই খাঁচা ছাড়া একটা আস্ত টিয়াপাখি আমার দিকে তুলে ধরল। আমি একহাত পিছনে সরে গিয়ে বললাম,

-কে দিতে বলছে?

-আপনার ভাগ্নি। চিটাগাং থেকে অনলাইনে অর্ডার করেছে।

-তো চিটাগাং নিয়া যা।

-আপনের কাছে দিতে বলছে। আপনে ফোন দিয়া জিজ্ঞেস করেন।

-আচ্ছা ঠিক আছে, খাঁচা কই?

-পাখির টাকা দিছে, খাঁচার টাকা তো দেয় নাই। খাঁচার দাম চারশো টাকা।

-যা ভাগ এখান থেকে, খাঁচা ছাড়া পাখি নিব না। আর শোন ভাইয়া ডাকবি, আঙ্কেল ডাকলে নলি ভাইঙ্গা দিব।

বলেই ঠাস করে দরজা আটকে দিলাম। ছেলেটা চলে গেছে ভেবে মিনিট দশেক পরেই দরজা খুলে দেখি টিয়া পাখি দরজার সামনে। বদমায়েশটা পাখির পা সুতা দিয়ে বেঁধে দরজার সাথে গিঁট মেরে গেছে। আমি ফোন দিলাম চিটাগাং। ফোন ধরেছে আমার বোন,

-কি রে! কী মনে করে ফোন দিয়েছিস?

-তোমার মেয়ে কোথায়?

-স্কুলে গেছে কেন?

-তোমার মেয়ে পাখি অর্ডার করছে, একটা টিয়া পাখি, জানো?

-হ্যাঁ জানি তো, দিয়ে গেছে ছেলেটা? ছেলেটা ভালই, অনলাইনে আজকাল বাটপারে ভরে গেছে।

-তুমি জানো? কেমন মা তুমি? মেয়েকে পাখি পালতে নিষেধ করো না? এখন আমি এই পাখি কি করব?

-চিটাগাং পাঠায় দে।

-আজব তো? কাজটাজ ফেলে এখন আমি চিটাগাং আসব পাখি নিয়ে? আর এই পাখিকে খাওয়াব কি?

-কেন তুই না চিটাগাং ডেলিভারি পাঠাস? ডেলিভারি সার্ভিসে দিয়ে দে।

-ধুর! আমি এই পাখি ভেজে খাব এখন।

বলেই ফোন রেখে দিলাম। টিয়া পাখি ভেজে খাওয়াটা হালাল নাকি হারাম জানি না। তবে মাথায় ঘুরছিল ডেলিভারির কথাটা। আসলেই তো, কোথাও লেখা নেই পাখি ডেলিভারি করা যাবে না। আমি নেটে ঢুকে ডেলিভারি সার্ভিসে আপার বাসার এড্রেসে কনসাইন করে দিলাম। প্রডাক্টের ওজনের ঘরে Under 500 gram এ টিক চিহ্ন দিলাম। এই বাচ্চা পাখির ওজন ৫০০ গ্রামের উপরে হবার কথা না।

বিকাল চারটার দিকে ডেলিভারিম্যান প্রডাক্ট কালেক্ট করতে চলে আসল। এরপরের ঘটনা শুরুতেই লেখা আছে।

আমি সাদিয়াকে কনফিডেন্সের সাথে উত্তর দিলাম,

-হ্যাঁ টিয়া পাখি, তো কী হইছে?

-কিন্তু স্যার টিয়া পাখি কেউ ডেলিভারিতে দেয়?

-এই যে আমি দিচ্ছি? তোমার লাগবে একটা? তুমি চাইলে কিন্তু আমাকেই পালতে পারবা বুঝলা। বড়সড় সত্তর কেজির টিয়া পাখি। মজা পাবা বুঝলা?

-স্যার আমি পাখি ডেলিভারির ব্যাপারে জানি না তো, আফরোজা ম্যাডামের কাছে ট্রান্সফার করছি, একটু হোল্ডে থাকুন।

-এই না, এই কাজ কইরো না…

বলতে বলতেই ফোন হোল্ডে চলে গেল। মিচকাটা আমার দিকে চোখ ত্যাড়া করে তাকাচ্ছে যেন আমি ওর বোনের সাথে লাইন মারছি। ওপাশের থেকে আফরোজা ম্যাডামের গলা শোনা গেল,

-স্যার আপনি সিরিয়াসলি একটা পাখি পাঠাতে চাচ্ছেন?

-আপনার কি মনে হয় আমি মজা করছি?

-কিন্তু পাখি তো পাঠানো যাবে না?

-কেন? পাখির কি দোষ?

-দোষ পাখির না, আমাদের টার্মস এন্ড কন্ডিশনে পাখি পাঠানোর নিয়ম নাই।

আমি জানতাম এরা টার্মস এন্ড কন্ডিশনের প্যাচে ফেলবে। এজন্যে কনসাইন করার আগে টার্মস এন্ড কন্ডিশন খুঁটিয়ে পড়েছি। আমি সশব্দে হেসে বললাম,

-হো হো আফরোজা ম্যাডাম, আমি জানতাম আপনি একথা বলবেন। টার্মস এন্ড কন্ডিশনের দোহাই দিয়ে আটকায় দিবেন। এজন্যে আমি একঘন্টা আপনাদের টার্মস এন্ড কন্ডিশন পড়েছি। কোথাও পাখির কথা লেখা নাই। শুধু লেখা আছে অবৈধ এবং নিষিদ্ধ জিনিস পাঠানো যাবে না। টিয়াপাখি অবৈধ না।

-বন্যপ্রাণী পরিবহন নিষিদ্ধ, সুতরাং সম্ভব হবে না স্যার।

-এটা বন্য টিয়া না ম্যাডাম। খাঁচায় ডিমে তা দিয়ে ফুটানো ব্রাজিলিয়ান সংকর। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি। কথা বলতে পারে, তবে আপনার নাম বলতে পারবে না, আপনার নাম এবং আপনি দুইটার গঠন জটিল। টিয়া পাখির ছোট ব্রেইনে চাপ পরবে।

-কিন্তু স্যার, ডেলিভারি করতে তিন থেকে চারদিন সময় লাগবে, পাখি খাবে কী?

-সেইটা আপনাদের ব্যাপার।

-পাখি মরে গেলে?

-আপনারা ১০০% ইন্স্যুরেন্স কভার করেন, নতুন পাখি কিনে দিবেন।

-স্যার আমি দেখছি কী করা যায়।

বলেই ফোন রেখে দিলেন আফরোজা ম্যাডাম। মিচকাটা আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা টিয়া পাখি কি মিচকা ডাকতে পারে? শিখালে পারবে হয়ত। কিছুক্ষণ বাদে মিচকার ফোন বেজে উঠল। আগের মত কিছুটা দূরে গিয়ে কথা শেষ করে এসে বলল, দেন, অফিস থেকে পাখি নিয়ে যেতে বলছে।

আমি পাখিওয়ালা ছোকরাটার মত দুইহাত বাড়িয়ে পাখিটা তুলে ধরলাম। মিচকা চোখ কপালে তুলে বলল,

-খাঁচা কই? খাঁচা ছাড়া পাখি নিব কিভাবে?

আমি এবার মিচকা হাসি দিয়ে বললাম, এমনেই নিতে হবে। তোমরা ওজন হিসাবে চার্জ ধরো। ৫০০ গ্রামের পাখির জন্য তিন কেজির খাঁচার চার্জ আমি কেন দেব?

৩১৮০ পঠিত ... ১৪:১৮, ডিসেম্বর ০২, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top