আমেরিকার হোমকামিং উৎসবে চুম্বনের জন্য খোলা 'কিসিং বুথ'-এর গল্প

৩৬০২ পঠিত ... ১২:১৯, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৮

আমেরিকানদের বিচিত্র কান্ডকারখানার গল্প বলার সময় কিসিং বুথের গল্পটা আমি খুব আগ্রহ করে বলি। শ্রোতারা চোখ বড় বড় করে শোনে। যুবক বয়েসীরা গল্প শেষ হওয়ার পর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হয়তোবা ভাবে, আহা, তারা কী সুখেই না আছে!

গল্পটা বলা যাক।

আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে 'হোমকামিং' বলে একটা উৎসব হয়। এই উৎসবে আনন্দ মিছিল হয়, হইচই গানবাজনা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দরী ছাত্রীটিকে হোম কামিং কুইন নির্বাচিত করা হয়। এই হোম কামিং রানিকে ঘিরে সারা দিন ধরে চলে আনন্দ-উল্লাস।

আমার আমেরিকাবাসের প্রথম বর্ষে হোম কামিং কুইন হলো আন্ডার গ্রাজুয়েট ক্লাসের এক ছাত্রী। স্পেনিশ আমেরিকান, রূপ ফেটে পড়ছে। কিছুক্ষন এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে বুকের মধ্যে এক ধরণের হাহাকার জমে উঠতে থাকে, জগৎ-সংসার তুচ্ছ বোধ হয়। সম্ভবত এই শ্রেণীর রূপবতীদের প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে, 'মুনীগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল।'

মেয়েটিকে নিয়ে ভোর এগারোটার দিকে একটা মিছিল বের হলো। আমার ইচ্ছা করল মিছিলে ভিড়ে যাই। শেষ পর্যন্ত লজ্জা লাগল। ল্যাবরেটরিতে চলে এলাম। অনেকগুলি স্যাম্পল জমা হয়েছে। এদের এক্সরে ডিফ্রেকশান প্যাটার্ন জানাতে হবে। ডিফ্রেকশান মেশিনটা ভালো কাজ করছে না। ছবি পরিষ্কার আসছে না। দুপুর একটা পর্ক্সন্ত কাজ করলাম। ঠিক করে রাখলাম লাঞ্চ সারার জন্য আধঘন্টার বিরতি দেব।

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

মেমোরিয়াল ইউনিয়নে লাঞ্চ খেতে গিয়েছি। লক্ষ করলাম মেমোরিয়াল ইউনিয়নের দোতলায় অস্বাভাবিক ভিড়। কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেলাম।

জটলা আমাদের হোম কামিং কুইনকে ঘিরেই। এই রূপবতী বড় বড় পোস্টার সাজাচ্ছে। পোস্টারগুলিতে লেখাঃ
'নীল তিমিরা আজ বিপন্ন। নীল তিমিদের বাঁচান।'

জানা গেল এই হোম কামিং কুইন নীল তিমিদের বাঁচাও সংঘের একজন কর্মী। সে আজ নীল তিমিদের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করবে।
নীল তিমিদের ব্যাপারে আমি তেমন কোনো আগ্রহ বোধ করলাম না। মানুষই যেখানে বিপন্ন সেখানে নীল তিমি নিয়ে লাফালাফি করার কোনো অর্থ হয় না। তবু দাঁড়িয়ে আছি। রূপবতী মেয়েটির আনন্দোজ্জ্বল মূর্তি দেখতে ভালো লাগছে।

আমি লক্ষ করলাম, কাঠগড়ার মতো একটা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। সেখানে লাল কালিতে ঠোঁটের ছবি এঁকে নিচে লেখা হলো 'কিসিং বুথ' (চুম্বন কক্ষ)। তার নিচে লেখা চুমু খাওয়ার নিয়মকানুন।
১. জড়িয়ে ধরবেন না, মুখ বাড়িয়ে চুমু খান।
২. চুমু খাওয়ার সময় খুবই সংক্ষিপ্ত।
৩. প্রতিটি চুমু এক ডলার।
৪. চেক গ্রহণ করা হবে না। ক্যাশ দিতে হবে।
৫. বড় নোট গ্রহণযগ্য নয়।

ব্যাপারটা কী কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার পাশে দাঁড়ানো আমেরিকান ছাত্র বুঝিয়ে দিল।

হোম কামিং কুইন কিসিং বুথে দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্যরা তাকে চুমু খাবে এবং প্রতিটি চুমুতে এক ডলার করে দেবে। সেই ডলার চলে যাবে নীল তিমি বাঁচাও ফান্ডে।

আমি হতভম্ব।

প্রথমে মনে হলো পুরো ব্যাপারটাই হয়তো একধরনের রসিকতা। আমেরিকানরা রসিকতা পছন্দ করে। এটাও বোধহয় মজার রসিকতা।

দেখা গেলো ব্যাপারটা মোটেও রসিকতা নয়। মেয়েটি কিসিং বুথে দাঁড়িয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে লাইন। এক একজন এগিয়ে আসছে, ডলার দিচ্ছে, মেয়েটিকে চুমু খেয়ে সরে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে দ্বিতীয়জন। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি।

মেয়েটির মুখ হাসি হাসি। তার নীল চোখ ঝকমক করছে। যেন পুরো ব্যাপারটায় সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। আনন্দ ছেলেরাও পাচ্ছে। একজনকে দেখলাম দশ ডলারের একটা নোট দিয়ে পরপর দশবার চুমু খেল। এতেও তার স্বাদ মিটলো না। মানিব্যাগ খুলে বিশ ডলারের আরেকটি নোট বের করে উঁচু করে সবাইকে দেখালো। সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড হাততালি, যার মানে-চালিয়ে যাও।

ইউনিভার্সিটির মেথর, ঝাড়ুদার এরাও ডলার নিয়ে এগিয়ে এলো। এরা বেশ গম্ভীর। যেন কোনো পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে। চুমু খেল খুবই শালীন ভঙ্গিতে। মন্দিরের দেবীমূর্তিকে চুমু খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এভাবেই খাওয়া হয়তো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতীয় ছাত্ররা চলে এলো। এরা চুমু খাওয়ার লাইনে দাঁড়ালো না। এক জায়গায় দাফড়িয়ে জটলা পাকাতে লাগলো। এ ওকে ঠেলাঠেলি করছে। কেউ যেতে চাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত একজন এগিয়ে এলো, এর নাম উমেশ। বোম্বের ছেলে। মানুষ যে বানর থেকে এসেছে এটা উমেশকে দেখলেই বোঝা যায়। তার জন্য ডারউইনের বই পড়তে হয় না। উমেশ চুমু খাওয়ার পরপরই অন্য ভারতীয়দের লজ্জা ভেঙে গেল। তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। আমি ল্যাবরেটরিতে চলে এলাম। আমার প্রফেসর তার কিছুক্ষনের মধ্যেই এক্সরের কাজ কী হচ্ছে তার খোঁজ নিতে এলেন। ডিফ্রেকশান প্যাটার্ন দেখতে দেখতে বললেন, তুমি কিন ওই মেয়েটিকে চুমু খেয়েছ?

আমি বললাম, না।
না কেন? মাত্র এক ডলারে এমন রূপবতী একটি মেয়েকে চুমু খাওয়ার সুযোগ কি নষ্ট করা উচিত?
আমি বললাম, এভাবে চুমু খাওয়াটা আমাদের দেশের নীতিমালায় বাধা আছে।
বাঁধা কেন? চুমু হচ্ছে ভালোবাসার প্রকাশ। তুমি যদি তোমার শিশুকন্যাকে প্রকাশ্যে চুমু খেতে পার তাহলে একটা তরুণীকে চুমু খেতে পারবে না কেনো? মূল ব্যাপারটা হচ্ছে ভালোবাসা। 

আমি বললাম, এই মেয়েটির ব্যাপারে তো ভালোবাসার প্রশ্ন আসছে না।
তিনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, আসবে না কেন? এই মেয়েটিকে তুমি হয়ত ভালোবাসছ না, কিন্তু তার রূপকে তুমি ভালোবাসছো। বিউটি ইজ ট্রুথ। তাই নয় কি?
আমি চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন, একটি নির্জন দ্বীপে যদি তোমাকে ওই মেয়েটির সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে তুমি কী করতে?
আমি নিচু গলায় নললাম, মুনীগণ ধ্যান ভাঙি দেয় তপস্যার ফল।
অধ্যাপক বিরক্ত গলায় বললেন, এর মানে কী?

আমি ইংরেজীতে তাঁকে ব্যাখ্যা করে দিলাম। অধ্যাপক পরম প্রীত হলেন।
আমি বললাম, তুমি কি তাকে চুমু খেয়ে এসেছ?
-না। এখন ভিড় বেশি। ভিড়টা কমলেই যাবো।
-বিকেল চারটায় এক্সরে টেকনিশিয়ান ছুটে এসে বলল, বসে আছ কেন? এক্ষুনি মেমোরিয়াল ইউনিয়নে চলে যাও। কুইক কুইক।
-কেন?
-চারটা থেকে চারটা ত্রিশ এই আধাঘন্টার জন্য চুমুর দাম কমানো হয়েছে। এই আধাঘন্টার জন্যে ডলারে দুটো করে চুমু।

টেকনিশিয়ান যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল তেমন ঝড়ের গতিতেই চলে গেল। আমি গেলাম দেখতে। লাইন এখনো আছে। লাইনের শুরুতেই উমেশকে দেখা গেলো। সে মনে হয় লাইনে লাইনেই আজকের দিনটা কাটিয়ে দিচ্ছে। আমার প্রফেসরকেও দেখালাম। এক ডলারের একটা নোট হাতে দাঁড়িয়ে। তিনি আমাকে দেখে হাত ইশারা করে ডাকলেন।

গল্পটা আমি এই জায়গাতে শেষ করে দেই। শ্রোতারা ব্যাকুল হয়ে জানতে চায়, আপনি কী করলেন? দাঁড়ালেন লাইনে?
আমি তাদের বলি, আমি লাইনে দাঁড়ালাম কি দাঁড়ালাম না, তা মূল গল্পের জন্য অনাবশ্যক।

অনাবশ্যক হোক আর না হোক, আপনি দাঁড়ালেন কি না বলুন।

আমি কিছুই বলি না। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসি। যে হাসির দু’রকম অর্থই হতে পারে।

(হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'হোটেল গ্রেভার ইন' থেকে)

৩৬০২ পঠিত ... ১২:১৯, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top