দানের হিসাব

২৩৪৮ পঠিত ... ১৬:০২, অক্টোবর ৩০, ২০১৭

এক ছিল রাজা। রাজা জাঁকজমকে পোশাক পরিচ্ছদে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেন, কিন্তু দানের বেলায় তাঁর হাত খোলে না।
রাজার রাজ্যে দুর্ভিক্ষ লাগল, পূর্ব সীমানার লোকেরা অনাহারে মরতে বসল। রাজার কাছে খবর এল, রাজা বললেন, ‘এ সমস্ত দৈবে ঘটায়, এর ওপর আমার কোনো হাত নেই।’
লোকেরা বলল, ‘রাজভাণ্ডার থেকে সাহায্য করতে হুকুম হোক, আমরা দূর থেকে চাল কিনে এনে এ-যাত্রা রক্ষা পেয়ে যাই।’
রাজা বললেন, ‘আজ তোমাদের দুর্ভিক্ষ, কাল শুনব আরেক জায়গায় ভূমিকম্প, পরশু শুনব অমুক লোকেরা ভারি গরিব, দুবেলা খেতে পায় না। সবাইকে সাহায্য করতে হলে রাজভাণ্ডার উজাড় করে রাজাকে ফতুর হতে হয়!’
শুনে সবাই নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।
ওদিকে দুর্ভিক্ষ বেড়েই চলেছে। দলে দলে লোক অনাহারে মরতে লেগেছে। আবার দূত এসে রাজার কাছে হাজির। সে রাজসভায় গিয়ে বলল, ‘দোহাই মহারাজ, আর বেশি কিছু চাই না, ১০টি হাজার টাকা দিলে লোকগুলো আধপেটা খেয়ে বাঁচে।’
রাজা বললেন, ‘অত কষ্ট করে বেঁচে থেকেই বা লাভ কি? আর ১০টি হাজার টাকা বুঝি বড় সহজ মনে করেছ?’
দূত বলল, ‘দেবতার কৃপায় কত কোটি টাকা রাজভাণ্ডারে মজুদ রয়েছে, যেন টাকার সমুদ্র! তার থেকে এক-আধ ঘটি তুললেই বা মহারাজের ক্ষতি কি?’
রাজা বললেন, ‘দেদার থাকলেই কি দেদার খরচ করতে হবে?’
দূত বলল, ‘প্রতিদিন আতরে, সুগন্ধে, পোশাকে, আমোদে আর প্রাসাদের সাজসজ্জায় যে টাকা বেরিয়ে যায়, তা খানিকটা পেলে লোকগুলো প্রাণে বাঁচে।’
শুনে রাজা রেগে বললেন, ‘ভিখারি হয়ে আবার উপদেশ শোনাতে এসেছ? আমার টাকা আমি সিদ্ধ করে খাই আর ভাজা করেই খাই, সে আমার খুশি! তুমি বাপু বেশি জ্যাঠামি করলে শেষে বিপদ ঘটতে পারে। সুতরাং এই বেলা মানে মানে সরে পড়।’
দূত বেগতিক দেখে সরে পড়ল।
দিন দুই বাদে কোথা থেকে এক বুড়ো সন্ন্যাসী এসে রাজসভায় হাজির; সন্ন্যাসী এসেই রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘দাতাকর্ণ মহারাজ! ফকিরের ভিক্ষা পূর্ণ করতে হবে!’

রাজা বললেন, ‘ভিক্ষার বহরটা আগে শুনি। কিছু কমসম করে বললে হয়তো বা পেতেও পারেন।’
সন্ন্যাসী বললেন, ‘আমি ফকির মানুষ, আমার বেশি নিয়ে দরকার কি? আমি অতি সামান্য ভিক্ষা রাজভাণ্ডারে একটি মাস ধরে প্রতিদিন পেতে চাই। আমার ভিক্ষা নেওয়ার নিয়ম এই—প্রথম দিন যা নিই, দ্বিতীয় দিন তার দ্বিগুণ, তৃতীয় দিন তার দ্বিগুণ, আবার চতুর্থ দিন তৃতীয় দিনের দ্বিগুণ। এমনি করে প্রতিদিন দ্বিগুণ করে নিই, এই আমার ভিক্ষার রীতি।’
রাজা বললেন, ‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু প্রথম দিন কত চান, সেইটাই হলো আসল কথা। দু-চার টাকায় পেট ভরে তো ভালো কথা, নইলে একেবারে ২০-৫০ হেঁকে বসলে সে যে অনেক টাকায় গিয়ে পড়তে হবে!’
সন্ন্যাসী একগাল হেসে বললেন, ‘মহারাজ, আমি ২০, ৫০ চাইনে, দুই-চার টাকাও চাইনে। আজ একটি পয়সা দিন, তারপর ২৯ দিন দ্বিগুণ করে দেওয়ার হুকুম দিন।’
শুনে রাজা, মন্ত্রী, পাত্র-মিত্র সবাই প্রকাণ্ড দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অমনি হুকুম হয়ে গেল, সন্ন্যাসী ঠাকুর মহারাজের জয়-জয়কার করে বাড়ি ফিরলেন।
রাজার হুকুমমতো রাজভাণ্ডারী প্রতিদিন হিসাব করে সন্ন্যাসীকে ভিক্ষা দেন। এমনি করে দুই দিন যায়, ১০ দিন যায়। দুই সপ্তাহ ভিক্ষা দেওয়ার পর ভাণ্ডারী হিসাব করে দেখল, ভিক্ষাতে অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখে তার মন খুঁত্ খুঁত্ করতে লাগল। রাজামশাই তো কখনো এত টাকা দান করেন না! সে মন্ত্রীকে খবর দিল।
মন্ত্রী বললেন, ‘তাইতো হে, এটা তো আগে খেয়াল হয়নি। তা এখন তো আর উপায় নেই, মহারাজের হুকুম নড়চড় হতে পারে না!’
তারপর আবার কয়েক দিন গেল। ভাণ্ডারী আবার মহাব্যস্ত হয়ে মন্ত্রীর কাছে হিসাব শোনাতে চলল। হিসাব শুনে মন্ত্রীমশায়ের মুখের তালু শুকিয়ে গেল।
তিনি ঘাম মুছে, মাথা চুলকিয়ে, দাড়ি হাতড়িয়ে বললেন, ‘বল কি হে! এখন এত? তাহলে মাসের শেষে কত দাঁড়াবে?’
ভাণ্ডারী বলল, ‘আজ্ঞে তা তো হিসাব করা হয়নি।’
মন্ত্রী বললেন, ‘দৌড়ে যাও, এখনি খাজাঞ্চিকে দিয়ে পুরো হিসাব করিয়ে আন।’ আধঘণ্টা যেতে না যেতেই ভাণ্ডারী কাঁপতে কাঁপতে হিসাব নিয়ে এসে হাজির। মন্ত্রী বললেন, ‘সবসুদ্ধ কত হয়?’
ভাণ্ডারী হাত জোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে, এক কোটি সাতষট্টি লক্ষ সাতাত্তর হাজার দু শ পনের টাকা পনের আনা তিন পয়সা!’ মন্ত্রী চটে গিয়ে বললেন, ‘তামাসা করছ নাকি?’ ভাণ্ডারী বলল, ‘আজ্ঞে তামাসা করব কেন? আপনিই হিসাবটা দেখে নিন!’
সে হিসাবের কাগজখানা মন্ত্রীর হাতে দিল। মন্ত্রীমশাই হিসাব পড়ে, চোখ উল্টিয়ে মূর্ছা যান আর কি! সবাই ধরাধরি করে অনেক কষ্টে তাঁকে রাজার কাছে নিয়ে হাজির করল।
রাজা বললেন, ‘ব্যাপার কি?’ মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, রাজকোষের প্রায় দুই কোটি টাকা লোকসান হতে যাচ্ছে!’ রাজা বললেন, ‘সে কি রকম?’ মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, সন্ন্যাসী ঠাকুরকে যে ভিক্ষা দিবার হুকুম দিয়েছেন, এখন দেখছি তাতে ঠাকুর রাজভাণ্ডারের প্রায় দুই কোটি টাকা বের করে নেওয়ার ফিকির করেছে!’
রাজা বললেন, ‘এত টাকা দেওয়ার তো হুকুম হয়নি! তবে এ রকম বে-হুকুম কাজ করছে কেন? বোলাও ভাণ্ডারীকে!’
মন্ত্রী বললেন, ‘আজ্ঞে, সমস্তই হুকুমমতো হয়েছে! এই দেখুন না দানের হিসাব।’
রাজামশাই একবার দেখলেন, দুবার দেখলেন, তারপর ধড়ফড়্ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন! তারপর অনেক করে তাঁর জ্ঞান হলে পর লোকজন ছুটে গিয়ে সন্ন্যাসী ঠাকুরকে ডেকে আনল।

১ম দিন— ১ পয়সা
২য় দিন— ২ পয়সা
৩য় দিন— ১ আনা
৪র্থ দিন— ২ আনা
৫ম দিন— ৪ আনা
৬ষ্ঠ দিন— ৮ আনা
৭ম দিন— ১ টাকা
৮ম দিন— ২ টাকা
৯ম দিন— ৪ টাকা
১০ম দিন — ৮ টাকা
১১শ দিন — ১৬ টাকা
১২শ দিন — ৩২ টাকা
১৩শ দিন — ৬৪ টাকা
১৪শ দিন — ১২৮ টাকা
১৫শ দিন — ২৫৬ টাকা
১৬ শ দিন— ৫১২ টাকা
১৭শ দিন — ১০২৪ টাকা
১৮শ দিন — ২০৪৮ টাকা
১৯শ দিন — ৪০৯৬ টাকা
২০শ দিন — ৮১৯২ টাকা
২১ শ দিন — ১৬,৩৮৪ টাকা
২২শ দিন— ৩২,৭৬৮ টাকা
২৩শ দিন— ৬৫,৫৩৬ টাকা
২৪শ দিন— ১৩১০৭২ টাকা
২৫শ দিন — ২৬২১৪৪ টাকা
২৬শ দিন — ৫২৪২৮৮ টাকা
২৭শ দিন— ১০৪৮৫৭৬ টাকা
২৮শ দিন — ২০৯৭১৫২ টাকা
২৯শ দিন — ৪১৯৪৩০৪ টাকা
৩০শ দিন — ৮৩৮৮৬০৮ টাকা
মোট ১৬৭৭৭২১৫.১৫ টাকা

ঠাকুর আসতেই রাজামশাই কেঁদে তাঁর পায়ে পড়লেন। বললেন, "দোহাই ঠাকুর, আমায় ধনে-প্রাণে মারবেন না। যা হয় একটা রফা করে আমার কথা আমায় ফিরিয়ে নিতে দিন।" সন্ন্যাসী ঠাকুর গম্ভীর হয়ে বললেন, "রাজ্যের লোক দুর্ভিক্ষে মরে, তাদের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা চাই। সেই টাকা নগদ হাতে হাতে পেলে আমার ভিক্ষা পূর্ণ হয়েছে মনে করব।" রাজা বললেন, "সেদিন একজন এসেছিল, সে বলেছিল দশ হাজার টাকা হলেই চলবে!" সন্ন্যাসী বললেন, "আজ আমি বলছি পঞ্চাশ হাজারের এক পয়সা কম হলেও চলবে না!" রাজা কাঁদলেন, মন্ত্রী কাঁদলেন, উজির-নাজির সবাই কাঁদল। চোখের জলে ঘর ভেসে গেল, কিন্তু ঠাকুরের কথা যেমন ছিল তেমনি রইল। শেষে অগত্যা রাজভাণ্ডার থেকে পঞ্চাশটি হাজার টাকা গুণে ঠকুরের সঙ্গে দিয়ে রাজামশাই নিষ্কৃতি পেলেন।

দেশময় রটে গেল দুর্ভিক্ষে রাজকোষ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করা হয়েছে। সবাই বললে, "দাতাকর্ণ মহারাজ!"

২৩৪৮ পঠিত ... ১৬:০২, অক্টোবর ৩০, ২০১৭

আরও

 

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top