ঢাকা শহরের একটি সত্যিকারের জ্যামের গল্প

৩৯২৫ পঠিত ... ১৮:৪১, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭

অলংকরণ: আসিফুর রহমান

আমার বড় খালা থাকেন উত্তরা। একদিন সকালে উনার জরুরি তলব। না গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে টাইপ ব্যাপার। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য পরদিন আমি আমার ছোট্ট লাল গাড়িটা নিয়ে উনার বাসায় হাজির হলাম। ব্যাপার তেমন কিছু না, উনি এক্সপেরিমেন্টালি কিছু পিঠা বানিয়েছেন। সেগুলোর কিয়দংশ আমাকে ধানমন্ডিতে বোনের বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। পৌঁছে দিতে গিয়েই ফেঁসে গেলাম।

গ্রিন রোড মানে পান্থপথ থেকে সায়েন্স ল্যাব যাওয়ার যে রাস্তা তার মাঝামাঝি বসে আছি চার ঘণ্টা হলো। যখন সর্বশেষ থেমেছি তখন থেকে আর এক ইঞ্চিও আগাই নাই। বিকাল চারটা থেকে আমি গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে আছি। এখন বাজে রাত আটটা। সামনে, পিছে, ডানে, বাঁয়ে যেদিকে চোখ যায় শুধু গাড়ি, রিকশা, ভ্যান আর হাফ ট্রাক। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সব। আমার গাড়ির কয়েক গাড়ি সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স। সাইরেন বাজিয়েই যাচ্ছে। ডানের রিকশাওয়ালা বলল, ওই অ্যাম্বুলেন্সে নাকি একটা প্রেগনেন্ট মহিলা আছে। অবস্থা সুবিধার না।

বামের রিকশায় বসে আছে সবুজ জামা পরা এক ফুরফুরে তরুণী। মোবাইলে টেপাটেপি করছে। অনুমান করছি ফেসবুকে ব্যস্ত। বাতাসে তার ঘন কালো সুন্দর চুল উড়ছে। উড়ুক। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। সারি সারি রিকশা। সেসব রিকশায় বাচ্চাসহ একটা দম্পতি, দুই বন্ধু, বৃদ্ধ এক মহিলার সঙ্গে এক তরুণ, দুটো বয়স্ক লোক, স্কুল ড্রেস পরা দুটি মেয়ে, কে নাই। সবাই গল্প-গুজবে ব্যস্ত। এই থেমে থাকায় কারও কোনো আপত্তি নাই। কয়েক দিন আগে রবীন্দ্র রচনাবলীর পুরো সেট কিনেছিলাম। সেটা গাড়িতেই ছিল। আমি পড়া শুরু করলাম।

রাত ১০টা বাজে। এখনো ঠিক একইভাবে একই জায়গায় সবাই থেমে আছি। রবীন্দ্রনাথ পড়া থামাতে হলো আজানের শব্দে। হঠাৎ কে জানি আজান দিল রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে। কী ঘটনা? পাশের রিকশাওয়ালা জানাল, অ্যাম্বুলেন্সের মেয়েটার বাচ্চা হয়েছে। বলেন আলহামদুলিল্লাহ। বললাম। রাত একটার দিকে বাচ্চা হওয়ার মিষ্টিও চলে এল। আমি পাশের রিকশায় তাকিয়ে দেখি সবুজ জামার ফুরফুরে মেয়েটা এখন আর একা না। একটা ঝকঝকে তরুণ তার পাশে বসে আছে। মেয়েটা হাত নাড়িয়ে গল্প করছে। তাদের পাশের রিকশাটা এখন খালি। নিশ্চয়ই তরুণটা আগে ওই রিকশাতেই ছিল। শিফট করেছে। তবে দুজনকে মানিয়েছে বেশ। 

পরদিন দুপুর দুইটা। ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছি সবাই। রিকশা, গাড়িতেই সবাই সবার দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। এই তো এইমাত্র দেখলাম পাশের দোকান থেকে দুধ, ডায়াপার, ছোট ছোট জামা কিনে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলেন এক লোক। নিশ্চয়ই সেই মেয়েটার হাজব্যান্ড। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার জন্য জিনিসপত্র কিনছেন। 

...এভাবে এক দিন দুই দিন করে সপ্তাহ পেরুল। সপ্তাহ গড়িয়ে মাস গড়াল, মাস পেরিয়ে বছর হতে চলল। ঠিক যেভাবে জ্যামে পড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছি সবাই। গাড়িতে একটা ক্যালেন্ডার ছিল, সেটাতে এখন ২০২০ সাল দেখাচ্ছে। গাড়িতে যখন উঠেছিলাম তখন ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাস। 

অলংকরণ: আসিফুর রহমান

গতকাল আমার সামনের গাড়ি থেকে এক ভদ্রমহিলা মাথা বের করে বললেন, এখানে কি কোনো এগ্রিকালচারিস্ট আছেন কেউ? আমি মাথা বের বললাম, আছি। কেন? উনি বললেন, আমি গত বছর বৃক্ষমেলা থেকে একটা আমের চারা কিনেছিলাম। এই যে গাড়ির ভেতরেই রাখা। এবার মুকুল এসেছে। কিন্তু সব মুকুল ঝরে যাচ্ছে। এটা প্রতিরোধের কোনো উপায় আছে? আমি একটা ওষুধের নাম বলে স্প্রে করতে বলে দিলাম। উনি উনার ড্রাইভারকে পাঠিকে ওষুধ কিনে আনালেন। এরপর স্প্রে করলেন। মুকুল পড়া থেমে গেল। কিছুদিনের ভেতরই গুটি গুটি আম হলো। সেই কাঁচা আম থেকে কিছু আম ওই মহিলা আচারের জন্য পেড়ে রাখলেন। ...তারও তিন মাস পর এক রিকশাওয়ালাকে দিয়ে ওই মহিলা আমাকে এক হালি পাকা টসটসে আম পাঠালেন।

এর ভেতর রবীন্দ্র রচনাবলী পুরোটা পড়া শেষ। তিন বছর লাগল এবার পড়তে। সেদিন লাস্ট বইয়ের লাস্ট চাপ্টারটা যখন পড়ছিলাম তখন শুনলাম পাশের রিকশা থেকে বেশ আনন্দ ধ্বনি। কী বিষয়। পাশের রিকশার তরুণীটির বিয়ে। কার সাথে? ওই যে পাশের তরুণটার সাথে? না না। ওই তরুণের সাথে না। সেই তরুণের সাথে গত দুই বছর ডেট করেছে মেয়েটা। কিন্তু সম্পর্কটা টিকেনি মানে ব্রেক আপ আরকি! পরে সে বেছে নিয়েছে চার রিকশা পরের অন্য এক তরুণকে। রিকশাওয়ালা সেদিন রাতে একটা পলিথিন দিয়ে রিকশার সামনেরটা ঢেকে দিল, তাদের বাসর রাত পালনের জন্য। আমি তাদের বললাম, তারা চাইলে আমার গাড়িতে বাসর রাত পালন করতে পারে। তারা সে প্রস্তাব লুফে নিল। 

দিন যায় মাস যায় বছর যায়। আমরা ওভাবেই বসে আছি গ্রিনরোডের ওই রাস্তায়। একদিন জ্যাম ছুটবে এই আশায়। মাঝখানে বেশ একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলো। অ্যাম্বুলেন্সে যে বাচ্চাটা হলো তার বয়স এখন ছয়। নাম রাখা হয়েছে তিলোত্তমা। তাকে তো এবার স্কুলে দিতে হবে। কিন্তু কোন স্কুলে দেওয়া হবে, সেটা নিয়ে সবার মাঝে তুমুল বিতর্ক। একদল বলছে বাংলা মিডিয়াম, আরেক দল বলছে ইংলিশ মিডিয়াম। শেষে ভোটাভুটি হলো। সেখানে ইংলিশ মিডিয়ামেরই জয় হলো। সেই বাচ্চাটাকে এখন পাশেরই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। প্রতিদিন সকালে দেখি মেয়েটা স্কুলড্রেস পরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বেরিয়ে পাশের স্কুলে যায়। দেখতে বেশ ভালোই লাগে। 

দেখতে দেখতে এর ভেতর ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা এখনো সেখানেই বসে আছি। সেই গ্রিন রোডের রাস্তাতেই। সেদিনের পর থেকে এক ইঞ্চিও সামনে যাইনি। তবে আমাদের খারাপ লাগছে না। সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অবশ্য এই মুহূর্তে আমরা সবাই ব্যস্ত একটা বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে। ওই যে মেয়েটার জন্ম হয়েছিল অ্যাম্বুলেন্সে, তিলোত্তমা নাম, সেই মেয়েটারই বিয়ে ঠিক হয়েছে। ভালো পাত্র পাওয়া গেছে পাশের এক রিকশাতে। ছেলে মস্ত বড় ফেসবুক সেলিব্রিটি। চাইলে আপনারাও আসতে পারেন ওই বিয়েতে নবদম্পতিকে দোয়া করার জন্য।

ঠিকানা তো সবার জানাই।

(আনিসুল হকের 'যানজট বিষয়ক একটি বোরিং রচনা' থেকে মেরে দিয়ে অথবা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা।)

৩৯২৫ পঠিত ... ১৮:৪১, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top