বিচিত্র প্রেম

১০৮ পঠিত ... ১৭:৩৬, এপ্রিল ০৭, ২০২৫

13

লেখা: বিমল কর

দিন চারেক হলো অতুল বাড়ি ছাড়া। পাড়া ছেড়েই পালিয়ে এসেছে। যে-রকম কেচ্ছা হয়ে গেল বাড়িতে তারপর কোনো ভদ্রলোকই আর মুখ দেখাতে পারে না। অতুলও মুখ দেখাচ্ছে না। অবশ্য এই মুখ আর দেখার মতনও নেই, চারদিনেই চুপসে গেছে, গালে দাড়ি জমেছে বিস্তর, চোখে হলুদ হলুদ ছোপ ধরেছে, মাথার চুলে জটের গন্ধ। তবু এই মুখই একজনকে অন্তত না দেখালেই নয় বলে অতুল রেল স্টেশনের ডাউন প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে বসে আছে।

এখন এদিকে কোনো গাড়িটাড়ি নেই। কখনও সখনও দু একটা মালগাড়ি যাচ্ছে। যাক। অতুল প্ল্যাটফর্মের কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় গোল করে বাঁধানো সিমেন্টের বেদিতে বসে। বসে বসে বিকেলের আকাশ দেখছে উদাস চোখে, মাঠঘাট নজর করছে বিষন্নভাবে, লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেলছে, সিগারেট টানছে ঘন ঘন। আর থেকে থেকে দূরে ওভারব্রিজের দিকটা লক্ষ করছে।

অতুলের অপেক্ষার অবসান হলো আরও খানিকটা পরে, বিকেলের আলো যখন মাঠঘাট ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়েছে এবং ক্রমশই ফিকে হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে—তখন।

প্রীতি কাছাকাছি আসতেই অতুল আবার বড় করে নিশ্বাস ফেলল। খুঁটিয়ে দেখতে লাগল প্রীতিকে। অতুলের মতন লণ্ডভণ্ড চেহারা নয়, মোটামুটি ফিটফাট। ছাপা শাড়ি, কলাপাতা রঙের ব্লাউজ, চোখমুখ পরিষ্কার। বাহ, বেশ! তোফা আরামে আছ মাইরি! সত্যি, মেয়েরা একটা জিনিস। এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল, তারপরও যেমনকে তেমন, মুখে পাউডার মাখতেও ভোলেনি। অতুলের রীতিমতো অভিমান হলো, কিংবা হয়তো ক্ষুব্ধই হলো সে।

প্রীতি এসে সামনে দাঁড়াল। নজর করে দেখতে লাগল অতুলকে। তারপর একটা ‘ইস’ শব্দ করল, দুঃখে না বিরক্তিতে বোঝা মুশকিল।

অতুল বলল, যাক, তা হলে এসেছ? আমি ভাবছিলাম, আসবে না। ক্ষোভের গলাতেই বলল অতুল।

প্রীতি বলল, বাহ, কাজকর্ম সেরে আসব না। তা ছাড়া আমি খবরই পেলাম দুপুরে। যোগেন গিয়ে বলল, তুমি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা করতে বলেছ! এত জায়গা থাকতে এই প্ল্যাটফর্ম তোমার মাথায় এল কেন জানি না, বাবা। বাড়ি থেকে কম দূর?

অতুল গম্ভীর মুখে বলল, প্ল্যাটফর্মই ভালো। অনেক মালগাড়ি যাচ্ছে। দু পা এগিয়ে গলাটা বাড়িয়ে দিলেই চলবে।

প্রীতি টেরা চোখ করে কটাক্ষ হানল। বলল, আহা—কী কথা রে।

অতুল একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। প্রীতি ততক্ষণে পাশে বসেছে।

তোমার মার খবর কী? অতুল জিজ্ঞেস করল।

মা ভালো হয়ে গেছে। তবে বেশ গম্ভীর। কথাবার্তা বেশি বলে না।

অতুল একটু চুপ করে থেকে বলল, কেরাসিন তেলের অ্যাফেক্ট। বোধ হয় এখনও স্টমাক থেকে তেলের গন্ধ উঠছে।

প্রীতি আড়চোখে দেখল অতুলকে। বলল, তোমার বাবার খবর রাখ?

শুনেছি ভালো আছে।

শুধু ভালো কেন, সেই বুড়ো তো লাফ মেরে মেরে নাচছে…বগল বাজাচ্ছে।

অতুল ঘাড় ফিরিয়ে প্রীতির দিকে তাকাল। শ্লেষের গলায় বলল, কথাগুলো কে শিখিয়ে দিয়েছে? তোমার মা?

প্রীতির মাথা গরম হয়ে উঠল। আমার মা যা শিখিয়েছে তোমার বাবা তোমাকে তার চেয়েও বেশি শিখিয়েছে।

অতুল সিগারেটের টুকরোটা রাগের মাথায় ছুড়ে ফেলে দিল। আমার বাবা সম্পর্কে একটা রেসপেক্ট আমি তোমার কাছে আশা করি। নিজের শ্বশুর সম্পর্কে তোমার যে সব কথাবার্তা, বুড়ো লাফ মেরে মেরে নাচছে, বগল বাজাচ্ছে…ছি ছি…এসব কথা কানেও শোনা যায় না।

প্রীতি বাঁ হাতটা মুঠো করে বুড়ো আঙুল দেখাল। তোমার বাবা আমার শ্বশুর? বয়ে গেছে আমার। তোমার বাবা আমার ইয়ে—বলে বুড়ো আঙুল নাড়াতে লাগল।

অতুল একেবারে থ। কান কপাল গরম হয়ে উঠতে লাগল। সামান্য তোতলানো জিবে অতুল বলল, আমার বাবা তোমার শ্বশুর নয়?

না।

অফিসিয়ালি নয়, কিন্তু আন-অফিসিয়ালি তো বটে।

মোটেই নয়। অমন লোককে আমি শ্বশুর করব না। একটা সত্তর বছরের বুড়ো—দুটো ঘুমের বড়ি খেয়ে ন্যাকামি করে বাড়ি মাথায় করল; ওই লোককে আমি শ্বশুর করব। কখনও নয়।

অতুল বেশ চটে গিয়েছিল, কিন্তু অবস্থাটা যা তাতে পুরোপুরি ঝগড়া করাও যায় না। সে তো মেয়ে নয়, পুরুষ। তার খানিকটা সংযম ও কাণ্ডজ্ঞান থাকা দরকার। অতুল বলল, আমার বাবা সম্পর্কে তুমি যা-তা বলছ! সত্তর বছরের বুড়ো আমার বাবা নয়। সিক্সটি ফাইভ সিক্স হবে। ন্যাকামি করার জন্যে কেউ স্লিপিং ট্যাবলেট খায় না…

ভীমরতি হলে খায়, প্রীতি বেঁকা গলায় বলল।

তোমার মাও কেরাসিন তেল খেয়েছিল, পালটা ঠোক্কর দিল অতুল, তোমার মা কচি খুকি নয়। বয়সটাও ষাটের কাছাকাছি। আমিও তো বলতে পারি তোমার মা ন্যাকামি করে কেরাসিন তেল খেয়েছিল।

প্রীতি রুক্ষ গলায় বলল, আমার মাকে তুমি ছেড়ে কথা বলছ নাকি? প্রথম থেকেই তো যা তা বলছ! তুমি বলোনি, মার স্টমাক থেকে এখনও কেরাসিন তেলের গন্ধ উঠছে?

অতুল আর এগুলো না; হল্ট মেরে গেল। চেঁচামেচি ঝগড়া বচসা করে লাভ হবে না। অতুল বলল, সরি! আমার অন্যায় হয়েছে! আসলে আমার মাথার ঠিক নেই। কটা দিন যা যাচ্ছে! কিন্তু তুমি এটা বুঝে দেখ, তোমার মা যদি আগে কেরাসিন তেল না খেত—আমার বাবা স্লিপিং ট্যাবলেট খেত না। এই কেলেঙ্কারির শুরু তোমার মা করেছে, আমার বাবা নয়।

প্রীতি পিছিয়ে যাবার পাত্রী নয়। বলল, আমার মা কেরাসিন খেয়েছিল তোমার বাবার জন্যে। তোমার বাবা দোতলায় খোলা বারান্দায় এসে আমার মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালাগাল দিত। বলত, ছেলেচোর ডাইনি, সর্বনাশিনী, আমার মার জিব নাকি মা কালীর মতন লকলক করছে। এসব কথা শুনলে কার মাথার ঠিক থাকে। আমার মা ছেলেচোর? তুমি কোন রাজপুত্তুর যে তোমাদের ওই ধ্যাড়-ধেড়ে দেড়খানা বাড়ির লোভে তোমায় চুরি করবে! নিজেকে তুমি রাজপুত্ত্বর ভাব নাকি? বেঁটে বাঁটকুল চেহারা, বিদ্যে তো বি. কম, চাকরি করো ব্যাংকে—কেরানির। তোমার মতন রাজপুত্ত্বর এ-শহরে গড়াগড়ি যাচ্ছে। বেশি কথা বোলো না।

অতুল একেবারে স্তম্ভিত হয়ে প্রীতির দিকে তাকিয়ে থাকল। এ মেয়ে না রক্ষেকালী? জিবটা শান দিয়ে এসেছে নাকি প্রীতি? এতটা দেমাকই বা কীসের? তুমি কোথাকার রাজকুমারি গো? হাইট তো পাঁচ এক, মোটা হিলের জুতো পরলে ইঞ্চিখানেক বাড়ে। গায়ের রংটা একরকম ফরসা তা বলে তুমি সোনার বরণ নও। চ্যাপ্টা-ধ্যাবড়া চেহারা, ভোঁতা নাক, ছোটো কপাল, খরখরে চোখ। নিজের চেহারাটা আয়নায় গিয়ে দেখ না সখি, দেমাক ভেঙে যাবে। লেখাপড়াতেই বা কী? কোনোরকমে টুকে-টাকে বি-এটা পাস করেছ।

অতুল মুখ ফিরিয়ে রেল লাইনের দিকে তাকাল। যেন এখন একটা মালগাড়ি থাকলে সে বোধহয় ঝাঁপ মেরে বসত।

একটু চুপচাপ। শেষ আলোটুকুও কখন আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে। মাসটা ভাদ্র। হয়তো শেষাশেষি। গাছপালা মাটির ভেজা-ভেজা গন্ধের সঙ্গে শরতের হাওয়া মিশে রয়েছে। আর সামান্য পরেই ঝাপসা অন্ধকার নামবে।

অতুলের বুকের মধ্যে মোচড় মারতে লাগল। একেই বলে জগৎ। সেই কবে—টুনি—যার কিনা পোশাকি নাম প্রীতি—সেই টুনির সঙ্গে তার সম্পর্ক। টুনি যখন ইজের পরত আর হরদম ইজেরের দড়িতে গিট লাগাত, গায়ে থাকত পেনি ফ্রক, মাথায় বব চুল—তখন থেকে টুনির সঙ্গে অতুলের গলাগলি সম্পর্ক। কতদিন টুনি অতুলকে দিয়ে ইজেরের দড়ির গিট খুলিয়ে নিয়েছে। সেসব দিনে টুনি যত ছেলেমানুষ ছিল অতুল অতটা ছিল না—টুনি পাঁচ, অতুল দশ—বছর পাঁচেকের ছোট বড়। সেই টুনি এখন একুশ, অতুল ছাব্বিশ। এত বছরের ভাব ভালবাসার পর টুনি আজ বলল, তুমি কোথাকার রাজপুত্তুর গো, ওই তো বেঁটে বাঁটকুল চেহারা, বিদ্যেতে বি. কম., ব্যাংকের কেরানি!

অতুল ডান হাতটা মাথার চুলে চিরুনির মতন করে চালিয়ে দিল। বুক হুহু করছে, এবং মনে হচ্ছে অসাড় রেল লাইনের মতন তার হৃদয়ট্রিদয়ও কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। গলার কাছটায় ফুলে উঠল অতুলের। কিন্তু এই রকমই হয়, এই তো জগৎ সংসার, প্রেম, ভালবাসা।

অতুল বেশ শব্দ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, তা হলে আর কী! আমি যখন রাজপুত্তুর নই তখন এইখানে একটা শেষটেষ হয়ে যাক।

প্রীতি এই সন্ধের মুখে কয়েকটা বককে সোঁ-সোঁ করে উড়ে যেতে দেখেছিল। এবং টেরা চোখে অতুলকেও। বলল, করো না শেষটেষ, আমার কী।

অতুল মুখ উঁচু করে ওপারের প্ল্যাটফরমের দিকে তাকাল। বলল, একুশটা বছর আমার নষ্ট হল। ওয়েস্ট।

একুশ কেন?

তোমার পাঁচ ছ বছর থেকে ধরছি। আজ আমার ছাব্বিশ।

তুমি তোমার খুশি মতন ধরবে? আমার যখন পাঁচ-টাঁচ তখন আমি এখানে থাকতাম নাকি? মার সঙ্গে মামার বাড়িতে আসতাম-টাসতাম। আমি এখানে রয়েছি পাকাপাকিভাবে চোদ্দো পনেরো থেকে। বলে প্রতি পিঠের বিনুনি বুকের ওপর টেনে নিল। বিনুনি নিয়ে কারুকর্ম করতে করতে বলল, একুশ থেকে দশ বাদ দাও। তা হলে থাকছে এগারো। এগারো বছরের সম্পর্ক বলতে পার।

অতুল যদি পুরুষমানুষ না হত হয়তো কেঁদে ফেলত। মেয়েরা কি এই রকম নিষ্ঠুর হয়? ফ্রেইলিটি না কুয়েলিটি কোনটা মেয়েদের ঠিক ঠিক ভূষণ! কথার জবাব দিল না অতুল। আবার একটা সিগারেট ধরাল। টুনি যা বলেছে সেটা কোনো হিসেবই নয়। টুনি তো জন্মেছেই এখানে। তবু অতুল জন্মকাল থেকে ধরছে না। টুনির বাবা কাতরাসগড়ের লোক। সেখানেই থাকত টুনিরা। এখানে টুনির মামার বাড়ি। অতুলদের বাড়ির পাশেরটাই টুনিদের মামাবাড়ি ছিল। টুনির মাকে বরাবর পিসিমা বলে এসেছে অতুলরা। সেই পিসিমার বিয়েও দেখেছে অতুল—কিন্তু মনে নেই। টুনির জন্মও মনে পড়ে না ; কেননা অতুল তখন খুবই বাচ্চা ছিল। কিন্তু যখন থেকে মনে আছে তখন থেকে বাদ দেবে কেন? অতুল কি বলছে, টুনিরা এখানে বরাবর থাকত? না, অতুল সেকথা বলছে না। অতুল বলছে, ওই পাঁচ-টাঁচ থেকে—টুনির যখন পাঁচ অতুলের বছর দশ বয়েস—তখন থেকে সব তার মনে আছে। টুনি পিসিমার সঙ্গে মামার বাড়িতে আসত যেত, মাঝে মাঝেই আসত, ছুটি ছাটায় থাকত, আবার ফিরে যেত। একেবারে পাকাপাকিভাবে অবশ্য এল টুনির বাবা মারা যাবার পর। এখানে বাড়িতে ছিল টুনির দিদিমা। তিনি আগেই গিয়েছিলেন, টুনির মামা তখন বেঁচে, মামি মারা গেছেন, ছেলেপুলেও নেই, কাজেই পিসিমা আর টুনির বরাবরের জায়গা হয়ে গেল এবাড়িতে। সেই মামা—তিনিও বছর দুই হল মারা গেছেন। এখন টুনিরাই ওবাড়ির মালিক। বাডিতে লোেক জনও কম। নীচে এক ঘর ভাড়াটে আছে, ওপর তলায় থাকে টুনিরা।

সিগারেটে পর পর কয়েকটা টান মেরে অতুল বিমর্ষ গলায় বলল, হিসেবটাকে তুমি আরও ছোট করতে পারো, আমি পারি না। মেয়েরা বরাবর কৃপণ। আমি তোমার মতন কিপ্টে হতে পারব না।

প্রীতি ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, ছেলেরা হিসেব বাড়াতে পারে, তিলকে তাল করে—আমি তোমার মতন হিসেব বাড়াতে পারব না।

পেরো না।

পারব না। এগারো বছর ধরতে পারি।

ওকে। সেই এগারো বছরের রিলেশান আজ শেষ হোক।

হোক। আমার কোনো আপত্তি নেই।

জানি-জানি। আমি তো রাজপুত্তুর নই। বেঁটে বাঁটকুল চেহারা, ব্যাঙ্কের কেরানি, বি কম। তুমি তো রাজকন্যে। হাঁটলে পায়ের নখ থেকে ইয়ে ঝরে পড়ে।

প্রীতি কনুই দিয়ে খোঁচা মারল অতুলকে। অতুল কাতরে উঠল।

প্রীতি বলল, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা যদি বলবে, চিপটিনি কাটবে—তোমায় আমি শেষ করে দেব।

আমি কিছু অন্যায় বলিনি।

ন্যায় বলেছ।

হ্যাঁ।

প্রীতি দু মুহূর্ত তাকিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তা হলে চলি!

অতুল থতমত খেয়ে গেল। প্রীতি এইভাবে উঠে দাঁড়াবে সে ভাবতে পারেনি। বলল, আমি তোমায় যেতে বলিনি।

তা হলে ন্যাকামি করছ কেন?

অতুল আর কথা বাড়াতে ভরসা পাচ্ছিল না। বলল, তোমার সঙ্গে কথা ছিল।

বলো।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় নাকি! বসো।

চাঅলা ডাকো।

এখানে চাঅলা কই?

ওদিকের প্ল্যাটফর্মে আছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকো।

অগত্যা অতুলকে উঠতে হলো, ওভারব্রিজের দিকে হেঁটে গেল খানিকটা। হাঁক পাড়ল বার কয়েক। টি স্টলের কেউ এদিকে আসবে মনে হল না। অতুলকেই লাফ মেরে রেল লাইনে নামতে হল, তারপর ওদিককার প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল।

চা এনে প্রীতির হাতে দিচ্ছে যখন অতুল—তখন অন্ধকার হয়ে গেছে।

প্রীতি বসল না। পায়চারি করতে লাগল প্ল্যাটফর্মে। পাশে পাশে অতুলও। অতি মনোরম হাওয়া দিয়েছে তখন। তারা ফুটতে শুরু করেছে। প্রতি হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে পায়চারি করতে করতে গুনগুন করছিল।

অতুল বলল, তুমি এত ফুর্তি পাচ্ছ কেমন করে আমি বুঝতে পারছি না।

একটা সিগারেট দাও না?

সিগারেট!

আরও ফুর্তি দেখাব।

অতুল অবাক। এক আধবার সে নিজেই টুনির মুখে নিজের সিগারেট ঠেকিয়ে দিয়ে টানতে বলেছে, কেননা টুনি সিগারেটটা ঠোঁটে টিপে রাখতে পারে না, জিব লাগিয়ে ভিজিয়ে দেয়। অতুল যখন সেই সিগারেটটা আবার টেনে নিয়ে নিজের মুখে ঠোঁটে চেপে ধরে—অন্যরকম একটা স্বাদ লাগে তার, বেশ চনমন করে মনটা। কিন্তু আজ হলো কী টুনির? সিগারেট ফুঁকতে চাইছে।

তোমার যতই ফুর্তি হোক, আমার হচ্ছে না, অতুল বলল, আমি মরে আছি।

কেন

কেন? তোমার মা—মানে পিসিমা খেল কেরাসিন তেল, আমার বাবা স্লিপিং ট্যাবলেট। পাড়ায় একটা কেচ্ছা হয়ে গেল। এরকম কেলেঙ্কারি আর কখনও হয়নি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। পাড়ায় গিয়ে মুখ দেখাব কেমন করে?

আমি তো দেখাচ্ছি।

তোমার… অতুল কোনোরকমে সামলে নিল। বলতে যাচ্ছিল—তোমার দু কান কাটা। সামলে নিয়ে বলল, তোমার প্রচণ্ড সাহস। তা ছাড়া তুমি মেয়ে—যাবেই বা কোথায়! আমার মতন তো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বন্ধুদের মেসে গিয়ে থাকতে পারবে না।

তুমি থাকছ কেন? কে বলেছে থাকতে?

বলাবলির দরকার করে না! যা কেচ্ছা হয়ে গেল—এরপর কোন ভদ্দরলোক বাড়িতে থাকতে পারে বলো—? আমার দাদাটি তো গিলে খাচ্ছে আমায়, বউদি মুখ বেঁকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বসে আছে। অতুল সখেদে বলল। টান মারল সিগারেটে, তারপর আবার বলল, সমস্ত কেলেঙ্কারিটা আমাদের নিয়ে। শালা বিয়ে করব আমরা, প্রেম করব আমরা। এটা আমাদের বিজনেস। তোমাদের কী? তোমার মা—মানে পিসিমার রাগ করে কেরাসিন তেল খাওয়াই বা কেন, আর আমার বাবার স্লিপিং ট্যাবলেট গিলে মরতে যাওয়াই বা কেন? লোকে বলে না, বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়, আমার বাবার তাই হয়েছে। এমনিতেই তো গলাবাজি করে সংসার কাঁপিয়ে রেখেছে তারপর ওই জেদ, জবরদস্তি। মরে যেতে ইচ্ছে করে, ভাই।

প্রীতি হেসে ফেলল।

অতুল বলল, হেসো না, হাসার ব্যাপার এটা নয়। আমার বাবা একটি ওয়ান্ডার। ছেলেকে জব্দ করতে কোনো বাপ ঘুমের ওষুধ খায়, শুনেছ?

প্রীতি আরও জোরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে নুয়ে গেল।

হাসছ? অতুল বলল।

তোমায় জব্দ করতে না আমার মাকে জব্দ করতে?

পিসিমাকে জব্দ করতেও হতে পারে—তবে ওটা সেকেন্ডারি। আমারটাই প্রাইমারি।

প্রীতি অতুলের গায়ে ঠেলা মারল কাঁধ দিয়ে। বলল, “তুমি ঘোড়ার ডিম বুঝেছ! তোমার কোনো ব্যাপারই নেই।

নেই?

না মশাই, তোমার কেসই এটা নয়। মাকে নিয়েই সব ঝাট। মা রোজ রোজ তোমার বাবার—মানে মামার—এখন মামাই বলি—মামার হম্বিতম্বি, গালি-গালাজ, তড়পানি শুনতে শুনতে মনের দুঃখে কেরাসিন খেয়েছিল। পুরো বোতল খায়নি। আধ বোতল কি সিকি বোতল হতে পারে। আজকালকার কেরাসিনে যা জল, কতটুকু আর কেরাসিন পেটে গেছে—বলতে বলতে প্রীতি ফট করে অতুলের মুখ থেকে সিগারেটটা টেনে নিল। নিয়ে নিজেই বার দুই টানল। টেনে থুথু করে ছুঁড়ে ফেলে দিল প্ল্যাটফর্মে।

অতুল ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল; কেউ যদি দেখে ফেলে। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা।

অতুল বলল, পিসিমা কেরাসিন তেল খেয়েছে শুনেই বাবার ঘুমের বড়ি খাবার জেদ চেপে উঠল বলছ?

তা আর বলতে! তুমি কেরাসিন তেল খেয়ে আমায় জব্দ করবে ভাবছ, দাঁড়াও আমি ঘুমের ওষুধ খাব… এই আরকি। প্রীতি হাসছিল।

অতুল মাথা চুলকে বলল, আমার একটা ডাউট আছে। বাবা মাত্র দুটো বড়ি খেয়ে ইয়ে হবে কেমন করে ভাবল? ঘুমের ওষুধ পেলই বা কোথায়?

প্রীতি বলল, ঘুমের ওষুধ না কচু, সোডার ট্যাবলেট খেয়েছে… কে আর দেখতে গেছে?

অতুল জোর করে অস্বীকার করতে পারল না।

প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে পৌঁছে এবার ওরা ফিরতে লাগল।

অতুল বলল, বাবার এই ছেলেমানুষির কোনো মানে হয় না। সমস্ত বাড়িতে একটা রই রই পড়িয়ে দিল। পাড়াময় রটে গেল, জনার্দনবাবু ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরতে গিয়েছিল। স্ক্যান্ডেল!

আমার মা-টিও ওই রকম; তবে তোমার বাবার মতন অতটা নয়!

অতুল চুপ করে কয়েক পা হেঁটে এল। তারপর বলল, দুজনের এই জেদাজিদি কেন আমি বুঝতে পারি না। কে কাকে জব্দ করবে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে নাকি?

প্রীতি কিছুক্ষণ কথা বলল না, না বলে অতুলের বাঁ হাত নিজের ডান হাতে ধরে দোলাতে লাগল। যখন বেশ জোরে জোরে ওদের হাত দুলছিল—তখন আচমকা হেসে ফেলে প্রীতি বলল, তুমি একেবারে কাঁচকলা। কিছু বোঝ না!

বুঝব কী! এর কিছু বোঝা যায় না।

যায় মশাই, যায়।

কী যায়?

বলব?

বলো!

তোমার বাবা লোকটি আমার মার সঙ্গে যৌবন বয়সে খুব প্রেম করত।

অতুল প্রীতির হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লাফ মেরে উঠল। বলল, প্রেম—মানে বাবার ভাষায় প্রণয়।

আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রণয়। পাশাপাশি বাড়ির ছেলেমেয়ে—ইয়ের বয়েস থেকেই প্রণয়।

যাঃ যাঃ! অতুল হাঁচির শব্দর মতন যা যা করল।

প্রীতি বলল, মোটেই যাঃ যাঃ নয়। তোমার বাবা একটা ইয়ে—কোনো সাহস নেই, ভিতু, ডরপোক্কা। মার বিয়ে হয়ে গেল। তোমার বাবার আর তো কোনো ক্ষমতা হল না—মার ওপর রাগ নিয়ে বসে থাকল। সেই জের এখনও চলছে…

অতুল সন্দেহের গলায় বলল, আমার বাবা তোমার মার সঙ্গে প্রেম করত কে বলেছে?

দেখেছি। প্রীতি সটান গলায় বলল।

 

তুমি দেখেছ?

হ্যাঁ মশাই দেখেছি। তোমার বাবার দেওয়া একটা বই মা এখনও কী যত্ন করে রেখে দিয়েছে। তাতে কি লেখা আছে জানো? লেখা আছে—আমার আদরের ধন লক্ষ্মীমণিকে।

অতুল এবার সত্যি সত্যি লাফ মেরে উঠল। যাঃ শালা। এই কেস। কী বই, মাইরি?

চন্দ্রশেখর।

এই বইয়ের কথা তুমি আগে বলোনি তো?

আগে ছাই আমি দেখেছি নাকি। মা কোথায় লুকিয়ে রাখত কে জানে! বইটা তো সেদিন দেখলাম; মার কেরাসিন তেল আর তোমার বাবার ঘুমের ওষুধ খাবার পর। মা এখন মাথার কাছে বইটা রেখে শুয়ে থাকে।

অতুল বার কয়েক মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে নিল। ফস করে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর বলল, আমার বাবাটা চরিত্রহীন নাকি?

চরিত্রহীন?

না তেমন চরিত্রহীন নয়। ক্যারেকটার নেই আর কি? প্রেম করতিস তো করতিস—সো হোয়াট? বিয়ে করলেই লেঠা চুকে যেত।

প্রীতি জোরে চিমটি কাটল অতুলকে। তারপর জিব দেখাল। ঘোড়ার মতন বুদ্ধি তোমার। তোমার বাবা আর আমার মা বিয়ে করলে—আমাদের কী হত মশাই? তোমায় যে দাদা বলতে হত!

অতুলের খেয়াল হল যেন ব্যাপারটা। জিব কেটে ফেলল। বলল, রিয়্যালি, আমার কোনো সেন্স নেই। খাজা মাথা। তুমি ঠিক বলছ! আমাদের ব্যাপারটার জন্যে ওদের স্যাক্রিফাইস করা উচিত ছিল। যাক গে, ওই বইটা আমাকে দিয়ো।

কী করবে বই নিয়ে?

অতুল রহস্যময় মুখ করে হাসল, ততোধিক রহস্যময় গলায় বলল, ব্ল্যাকমেইল করব। প্রেশার দেব। তোমার আমার ব্যাপারে বাবা এবার যদি ঝামেলা করে—বইটা আমি আমার মার হাতে তুলে দেব। মা একটিবার শুধু দেখুক আমার ফাদারমশাই কাকে আদরের ধন ‘লক্ষ্মীমণি’ বলতেন। বাস ওতেই হয়ে যাবে। কিস্যু আর করতে হবে না আমাদের।

প্রীতি একটুর জন্যে থমকে দাঁড়াল। তারপর দমকা হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। হাসতে হাসতেই বলল, ভীষণ বুদ্ধি তো তোমার! এত বুদ্ধি ওই মাথায় ধরে রেখেছিলে! দেখি—দেখি বলে প্রীতি হাত বাড়িয়ে অতুলের চুলের ঝুঁটি ধরে মাথাটা নিজের মুখের কাছে নামিয়ে নিল। তারপর চকিতে একবার চারপাশ দেখে নিল প্ল্যাটফর্মের। কেউ নেই।

অতুল মুখ তুলে ভেজা গালের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বলল, বড্ড দাড়ি হয়ে গিয়েছে। স্কিনে টাচ করল না।

দুজনেই হেসে উঠল একসঙ্গে। হাসতে হাসতে ওভারব্রিজের দিকে এগিয়ে চলল।

 

১০৮ পঠিত ... ১৭:৩৬, এপ্রিল ০৭, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top