বাসি পুরুষমানুষ

৫১ পঠিত ... ১৬:৩৬, মার্চ ১৮, ২০২৫

আপনি আর আসবেন না।

একি স্বাতী? আমায় আপনি-আপনি করে কথা বলছ? হা। এখন থেকে এভাবেই ডাকব আপনাকে।

তুমি আমার নাম ধরেই ডাকতে। শঙ্কর বলে ডেকে এসেছ এই সাড়ে চার বছর। আমায় কেউ নাম ধরে ডাকে না আর। মা নেই, বাবা নেই

কে ডাকবে আর। বন্ধু কমে গেছে ভীষণ। শুধু তুমি শঙ্কর বলে ডাকতে বলেই আমি বেকুবের ম বিশ্বাস করে ফেলেছি—আমি আবার শঙ্কর হয়ে গেছি।

স্বাতী—মানে আর-পাঁচটি বাঙালি বাড়ির বিয়ে না-হওয়া অনার্স গ্রাজুয়েট মেয়ে। যে চাকরি খোঁজে—আবার বরও খোঁজে। চওড়া কাঁধ। উদার। ভালোবেসে যে ঝাপিয়ে পড়তে পারে—এমন বর। বাবা বিপত্নীক। খেলা ভালোবাসেন। শঙ্করকে একবার শিল্ড ফাইনালের টিকিট দিতে চেয়েছিলেন। দাদা খেতে ভালোবাসে। স্বাতীকে ভালোবাসে। শঙ্করকে ঘেন্না করে। স্বাতীর সঙ্গে শঙ্করকে কথা বলতে দেখে একদিন বলেছিল:

কুকুরটা এসেছিল কেন? স্বাতী চান করতে যাবে বলে রােজকার ম আজও সর-হলুদ মেখেছে মুখে, ঘাড়ে-গলায়—দুহাতে। সে আর কথা বাড়াতে চায় না বলেই চুপ করে থাকল। বাবা চান করতে গেছে। দাদা অফিসে। শঙ্কর ফের বলল, তুমিই বহুদিন পরে আমায় শুধু শঙ্কর বলে, তুমি বলে ডাকায়—আমি ভুলেই গেছি—আমি বাবা, কাকা, জ্যাঠা—এটসেটেরা, এটসেটেরা।

স্বাতী মুখ তুলে তাকাল। বাড়ির বাইরে ভাদ্র মাসের দুপুরবেলা। রাস্তা শুনশান। সেখানে শুধু কুকুর ঘুরছে—আকাশে শুধু মেঘ। শঙ্কর নামে লোকটির মুখখানি সামান্য যৌবন-মাখানো আগাগোড়া একজন পুরোনো লোকের মুখ। এই মুখ দেখে আমি ভুলেছিলাম। আশ্চর্য!

স্বাতী বলল, আপনি শুধু-শুধু চোখের জল ফেলবেন না। ও-রকম অনেকবার হয়েছে। আর নয়। কাজের চাপে থাকেন সবসময়। আপনাকে আমি পাই না। আমি আর অপেক্ষা করব না।

কী আর নয় স্বাতী ? আমি মাকে ছাড়া থাকতে পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি। আমায় ফেলে দিয়াে না—আমি সহ্য করতে পারব না একদম। দয়া কর। আমি নিরুপায়।

দিব্যি আপনার বউয়ের কাছে গিয়ে থাকবেন। আছেনও। রাস্তায় কারও সঙ্গে দেখা হলে বলে থাকেন—আমাদের বাড়ি যেয়ো। সে হয় জানতে চাইল, বউদি আছেন? আপনি বললেন, হ্যা, মাদের বউদি আর আমি আছি। যেয়ো—

যতক্ষণ একসঙ্গে আছি—বলতে  হবেই। ও  বলেছে—ডিসেম্বরে আমায় ডিভোর্স দেবেই।

যাক ওসব কথা। অনেক হয়েছে। আপনার বউকে বলে দিয়েছি ফোনে—আপনার স্বামীকে ফেরত দিয়ে দিলাম।

ওভাবে কি ফেরত দেওয়া যায় স্বাতী। আমার কোনও জায়গা নেই। একমাত্র তুমিই আমায় নিতে পারতে।

আপনার জন্যে সে ভালোবাসা আমার আর নেই। আমি আর বাসি পুরুষমানুষে নেই। আপনি  আমায় বলেইছেন—আমার চেয়ে একজন বেটার স্বামী খুঁজে নাও।

আমার সেদিন কাজ ছিল। আমি সুপার-অ্যানুয়েটেড লোক। যে অফিসে কাজ দেয়—তাদের সময়ম কাজ না দিলে নতুন কাজ পাব না। কাজ না করলে টাকা আসবে না। টাকা না হলে মায় পাব না। তাই আমায় জোর করেই যেতে হয়েছিল সেদিন। মার সেদিন উচিত ছিল—আমায় এক কাপ চা করে দিয়ে বলা—যাও, কাজটা করে এস। কিন্তু তার বদলে বললে—এখুনি, এখন থেকে এ ঘরে আমায় নিয়ে থাক। আমি তা কী করে পারি স্বাতী?

ওসব পুরানো কথা থাক।

আমার এতদিনকার বিবাহিত স্ত্রীর জন্যে আমার একটা মানসিক দায়িত্ব, মর্যাদা, ভদ্রতা সব সময়েই থাকবে স্বাতী। আমি সেদিন সেকথাই বলতে চেয়েছিলাম। তুমি বুঝলে না কিছুতেই।

আমার আর নতুন করে বোঝার কিছু নেই। সব শেষ হয়ে গেছে আপনার সঙ্গে। এবার আমি একজন আনকোরা পুরুষকেই ভালোবাসব। আর বাসি নয়। আর বাসি নয়। বাসিতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।

আমায় দয়া কর স্বাতী। আমি সেদিন নিরুপায় ছিলাম। তুমি থিয়েটার দেখে ফেরার পথে বললে—আমি যা বলছি তা নাকি অভিনয়। আমি বলেছিলাম—ট্যাক্সি নিয়ে মায় পৌছে দিতে গিয়ে যখন জ্যামে আটকালাম—তখন বলেছিলাম আমারই ভুল—অটো নেওয়াই উচিত ছিল মার কথাম। তাতে তুমি বললে—অভিনয় করছ কেন?

কী বলেছি—আজ আর তা বলে কী হবে বলুন? | সেদিন যখন আমি অফিসের কাজের কথা বললাম—তখন তুমি হাতের

মুন স্টোনের আংটিটা দেখিয়ে বললে :

—ওটা কি কাচ? আমি এত অপমানিত কখনও হইনি স্বাতী। মার রাশিচক্র দেখে জ্যোতিষী ওই মুন স্টোন পরতে বলেন—আমি তাই নিয়ে আসি। তুমি বললে কাচ—

আপনাকে  গোড়াতেই বলেছিলাম—আমি পাথর ধারণে বিশ্বাস করি না।

আমিও ব্যাপারটা বুঝি না। আমি শুধু বুঝি—স্টোন পরলে যদি ভালো হয় মার।

আমার ভালোতে আর কাজ নেই আপনার। দরজা বন্ধ করব। আপনি এখন আসুন।

আমি পারব না স্বাতী। বিশ্বাস কর আমাকে। আমি খারাপ লোক নই। নয় কোনটার পরে কোনটা করতে হবে—তা ঠিক করতে পারিনি। নতুন জীবন করতে গেলে আগের জীবনের সব দায়-দায়িত্ব সুন্দর করে মিটিয়ে আসতে হয়। তাই করতে আমি ব্যস্ত ছিলাম। সবটা মাকে লক্ষ করেই, আমার স্বাতী—

আপনার সঙ্গে মিশে আমার যা ক্ষতি হবার তাই হয়েছে।

কী ক্ষতি স্বাতী ?

আমি যে নতুন করে আনকোরা মানুষের সঙ্গে মিশব—সেখানেও আপনার নামের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে গেছে। মুছতে যে অনেক দিন লাগবে।

আমার এই বাসি নামটা । সেজন্য আমি আপনাকে সবটা দোষ দেব না। আমিও  আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু এখন আপনার নাম থেকে আমার আলাদা হতে সময় নেবে।

অথচ সময় খুব কম! তাই না স্বাতী ? স্বাতী কোনও কথা বলল না। একবার মুখ তুলে তাকাল। সে-মুখে সরহলুদ ভালো করে মাখানোর পর একটা আভা বেরুচ্ছে। আপনি আসুন। আমার সামনে বসে চোখের জল ফেলবেন না। আমার বিচ্ছিরি লাগে। আসুন—

বলেই স্বাতী উঠে দাঁড়াল।

বাসি পুরুষমানুষ শঙ্কর ঘোষাল-কুকুর-ছড়ানো শুনশান রাস্তায় এসে দাঁড়াল। স্বাতীর হাতে এখন সময় খুব কম। আমার নাম থেকে যত তাড়াতাড়ি ও আলগা হতে পারে ততই ওর পক্ষে ভালো। ততই ও আনকোরা বিয়ে-না-হওয়া পুরুষের কাছাকাছি হয়ে যেতে পারে।

একটা সাইকেল-রিকশা নিল শঙ্কর ঘোষাল। এ রাস্তাটুকু সে হাঁটতে পারছিল না। তার নিজের অফিসটা উঠে গেছে। নইলে সেখান থেকে যা পি এফ, গ্র্যাচুইটি পেত—তা থেকে কোথাও রেখে মাস গেলে নিয়মিত কিছু-কিছু পাওয়া যেত। স্বাতী আমায় ভালোবেসেছিল বলেই এই সাড়ে চার বছরে আমি আনকোরা হয়ে উঠেছিলাম। একটু একটু করে। আমার আগেকার শেকড়গুলো আমি বিনয়ী, ভদ্র, অলস কাঠুরের মই কাটছিলাম। স্বাতী আর ধৈর্য রাখতে পারল না।

বাড়ি ফিরে শঙ্কর দেখল, তার বউ তার জন্যে টমেটো দিয়ে সুপ করেছে। খেতে খেতে মহিলার মুখে তাকাল শঙ্কর। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে এই কথাগুলো এল। মার জন্যে—শুধু মারই জন্যে—খাওয়ার পর শঙ্করের মনে হল, এই সব কথার মানে কী।

মার জন্যে স্বাতীকে… অথবা শুধু মারই জন্যে স্বাতীকে…

কী অস্পষ্ট সীমারেখা, যা কিনা একটার সঙ্গে আরেকটা মিশে গেছে। কোথায় মিশেছে ধরা যায় না। আমার বউ আমার ওপর নির্ভর করে। তার জন্যে আমার মায়া হয়। আমি না হলে ওর আর কী বা থাকে হওয়ার ম? ওর ঘুম থাকে না। হাসি থাকে না। আবার স্বাতী না-হলে আমি যে রোজ বাসি হয়ে যাই। বাসি থেকে আরও বাসি। কিছুতেই আর আনকোরা হতে থাকি না। সেই দশায় আমি যত বেশি করেই বউয়ের কাছে থাকি না কেন—আমি যে মরে থাকব।

শঙ্কর ঘোষাল রাস্তার এমন একটা মোড়ে এসে দাঁড়াল—যেখানে চারদিকে চারটি রাস্তা গেছে।

পুব দিকে গেলে অফিস। ওখানে আমি অভ্যেস বশে কিছু করলেই তিরিশ দিন অন্তর ডাল-ভাত, সাবান, সোডা, বাসের টিকিট, ব্লাড প্রেসারের ডাইটাইড বড়ির দাম পাওয়া যায়।

পশ্চিমে গেলে বড়ো ছেলের বাড়ি। আজ ওর ছোটো ছেলের জন্মদিন। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। যতবারই ছেলের বাড়ি যাই ততবারই ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন সে যুবক। বিবাহিত। কোনও বিশেষ অকেশন না-হলে কোনও বাবা তার বিবাহিত ছেলেকে জড়াতে পারে না। এই যেমন বিজয়া দশমী। দুঃসংবাদ। অফিসে প্রমোশন। নয় খারাপ দেখায়। তার ছেলের ছেলেকে কোলে নিয়ে সে-সাধ মেটাতে হয়। কিন্তু আজ জন্মদিন হলেও বড়োখোকার ছোটোখোকাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না। তার যে হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এখন সে স্কুলে। এই রাস্তায় গিয়ে কী হবে? আনন্দ নেই। আশা নেই। ফিউচার নেই কোনও।

উত্তর দিকের রাস্তাটায় খানিকটা গিয়ে ফিরে এল শঙ্কর ঘোষাল। ওই রাস্তায় আমার পিঠোপিঠি ভাই থাকে। বাড়ি করেছে। বাড়ির কাজের লোকের জন্যেও মাসে অফিস থেকে পাঁচশো টাকা পায়। বছরে মাইনে দুলক্ষ টাকা। না না। এগজ্যাক্টলি বলতে হলে বলতে হয়—এক লক্ষ নিরানব্বই হাজার পাঁচশো দশ টাকা। কোম্পানির স্কেলে মাইনে? না মাইনে নয়—বলা হয় কমপেনসেশন। সেলার আছে বাড়িতে। কথা বলার সময় ছোটোভাই সমীরের হাত ঘন-ঘন সিগারেটের দিকে চলে যায়। ভীষণ টেনশনে ভাগে। মোটা মাইনেতেও লোকে বিপন্ন বোধ করে। মনে করে—আমি কি নিরাপদ? এই রাস্তায় ঢুকলে আনন্দ আসবে কোত্থেকে?

দক্ষিণের রাস্তাটা ধরে এগোলো শঙ্কর। একটা দশতলা বাড়ির দশতলায় তার এক বন্ধু থাকে। সে-ই এখনও তাকে শুধু শঙ্কর বলে ডাকে। বাড়ি ছিল। দরজাও খোলা। দেওয়ালে মুরাল। জানলায় সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের অন্য আর সব দশ বারোতলা বাড়ির মাথা। একটা সিংহাসন টাইপের চেয়ার থেকে বন্ধু বলল, ভেতরে আয়। বোস।।

শঙ্কর বলল, কতদিন পরে তাই না? হ্যা। অনেকদিন পরে। র সব খবর পাই শঙ্কর। আজকাল কাদের সঙ্গে মিশিস ? যাকে পাই। ডাক্তার, প্রমোটার, বড়ো ফুটবল ক্লাবের পাণ্ডা—সবাই  আমার কাছে টাকা নিতে আসে। কেউ নার্সিংহোমে , কেউ মাল্টিস্টোরিড, নয় জবরদস্ত টিম বানাতে চায়। খবরের কাগজ করবে বলে কেউ কেউ টাকা চাইতে আসে। শর্ট টার্মে রেডি লোন। নো হ্যাঙ্কিপ্যাক্কি। তেইশ পারসেন্টে।

র অনেক টাকা?

সবই পরের টাকা। ফাইনান্স কোম্পানি গড়ে লা চাট্টিখানি কথা নয় শঙ্কর। ছাব্বিশ বছর লাগল। অনেক হ্যাপা। এখন  ডিপোজিট বিয়াল্লিশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। হপ্তাওয়ারি রিপোর্ট দিই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। ফিল্ড এজেন্টই আছে সাড়ে তিনশোর ওপর। পার্টি হোলটাইমারের মতই।

তোর ভয় করে না?
এত টাকা— ভয় কীসের?
তোর ভয় করে না শঙ্কর ?
কীসের ভয়?

এই যে শুনি একটা হাঁটুর বয়সি মেয়ের সঙ্গে লটরপটর করে বেড়াচ্ছিস। একদিন গাড়ির জানলা দিয়ে চোখে পড়ল—রা দুজন হাসতে হাসতে হেঁটে যাচ্ছিস। যেন নতুন বিয়ে করেছিস।

দেখেছিস? হা শঙ্কর। কে কী বলে ডাকে? ডার্লিং? নারে। ইদানীং বলে—ঘাটের মড়া।

কে ঘাটের মড়া বলে ডাকে শঙ্কর! হাঃ! হাঃ! ওটা নিশ্চয় আদরের ডাক। তোর চেহারা  এখনও রীতিম টঙ্ক আছে। একটু মোটা। কিন্তু নাক-মুখ-চোখ এখনও শার্প।

চেহারা নয় রে ! আমার মনটাই নাকি পচে-গলে গেছে। মন কী দিয়ে দেখতে পায় শঙ্কর ?

তা জানি না। হয় আমার স্বভাবে ফুটে ওঠে। আসলে কী জানিস, ওল্ড এজ জিনিসটাই বড় বিচ্ছিরি। কোনও আলাে নেই। আশা নেই। ঘটনা নেই। ভবিষ্যৎ নেই। আনন্দ নেই। কেউ আসে না। কোনও সুগন্ধ নেই। তার ভেতর স্বাতী এসে যখন বলল—আমি নাকি এখনও পারি—

কী পারিস? | তা জানি না। ওই-যে একটা পারি’ ভাব—যেন আমি অরণ্যদেব! যেন আমি জেমস বন্ড। সামনে অঢেল ফিউচার। হাতে ছ-ঘড়ার পিস্তল। এই ভাবটা জাগিয়ে দিয়ে ও আমাকে এমন এক আনন্দের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল—

বল—ভালোবাসার ধাক্কা শঙ্কর।

সে যাই বলিস। আমি সেই আনন্দেই ভাসছিলাম। এ আনন্দে কেউ ডােবে । ভাসতেই থাকে। ভাসতেই থাকে। মনে হত আমি সব সময় উড়ে চলেছি।

মনে হচ্ছে, এখন যেন পড়ে গেছিস!

তাতে আমি কারও দোষ দেখি না। এমন  হয়েই থাকে। সত্যিই  আগেকার বয়সের হিসেবে আমাকে ওর ঘাটের মড়া লাগতেই পারে।

সময়ম প্রেজেন্ট-ট্রেজেন্ট কিনে দিসনি নিশ্চয়। মাঝে-মধ্যে শপিংয়ে নিয়ে যাবি ।

এই বয়সে অত পয়সা কোত্থেকে পাব? র ম ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি নেই আমার। কে দেবে আমায় পয়সা? আমি যা পারি, সাধ্যম করতাম। আর জিনিসপত্রে স্বাতীর কোনও আগ্রহ নেই।

কার বউ?

তার জন্যেও করি—যেটুকু পারি। ছেলে দুজন বড়ো হয়ে তাদের যেহেতু মা আছে, তারাও তাদের মাকে খানিক-খানিক দেখে।

এটা আশা করিস না শঙ্কর-বাপের প্রেম-ভালোবাসার জন্যে ছেলেরা পয়সা জোগাবে।

তা করি না। আমার মুশকিল হয়েছে—আমি কাউকে অপমান, অসম্মান করতে পারি না। কাউকে বলতে পারি না—এখুনি চলে যাও। আমি মায় আর ভালোবাসি না। মেয়েটা কী চায়? এখুনি ওকে নিয়ে আলাদা হতে হবে। নয় নয় কী শঙ্কর ?

ওর  বয়স বয়ে যাচ্ছে। বেলা বহে যায়! তার ওপর ট্রপিকাল কান্ট্রি। ও কেন ওর সুন্দর বয়সটা নষ্ট করবে? অথচ আমারও চলে আসতে যে এখনও তিন-চার মাস দরকার। তাই বলছিল—

কী বলছিল ? এখুনি আমাকে বিয়ে করে আলাদা হও। আজই। নয় আমাকে বিয়ে করার জন্যে তিনজন আনকোরা না-বিয়ে-হওয়া যুবক আমার হাতে রেডি। তবু আমি আর-খানিকটা সময় চাইলাম স্বাতীর কাছে।

বন্ধুটি গদি-মোড়া সিংহাসন-মার্কা চেয়ারে দুই পা ভাঁজ করে বাবু হয়ে বসল। আরি ব্বাস! এ  চিমা-বিজয়ন। সব ক্লাব চাইছে—এমন একজনকেই আমি খুঁজছিলাম।

কী করবি ?

আমার অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কে বসাব শঙ্কর। এত রকমের হােস্টাইল লােকজন আসে—যাদের এমন মেয়েই সামলাতে পারবে। হ্যান্ডসাম কমপেনসেশন দেব। অমন মেয়ে কাউন্টারে দেখলে পাবলিক চনমন করবে। যাতায়াত অফিসের গাড়িতে। শুনে আমার গর্ব হচ্ছে—আজকাল বাঙালির ঘর থেকে এমন মেয়েও আসছে তা হলে। আমরা তা হলে কারও চেয়ে আর পিছিয়ে নেই। কী বলিস শঙ্কর?

ভালোবাসা বলে এতকাল যা শুনে আসছি—আসলে সেটা কী বলত? সেটা কোথায় গেল? সেটা ঠিক কেথায় থাকে? স্বাতী বলেছিল, ও নাকি পঙ্কজকে চুমু খেয়েছে।

পঙ্কজটা আবার কে?

আমি যেখানে কাজ দিই—সেখানকার তরতাজা ঘোড়া। তাকে নাকি চুমু খেয়েছে হর্টিকালচার গার্ডেনে। বললাম, তুমি খেলে? স্বাতী বলল, হ্যা। ভালো লাগল। আপনাকে পাই না। আমি কী করব? পঙ্কজ আমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। খুব জোরে।

আমি বললাম খেতে পারলে?—বলতে গিয়ে আমার বুক ভেঙে গেল। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায়, অপমানে আমি ঘেমে গেলাম।

স্বাতী বলল, হ্যা। পারলাম। কেন পারব না? শুনে ভাবছিলাম, এই স্বাতীকে আমি একদিন যখন বলেছি—আমি বয়স-হয়ে-যাওয়া মানুষ—আমাকে নিয়ে তুমি কী করবে?—তখন স্বাতী উপুড় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছে—ফাটা রেকর্ডটা আর বাজিয়ো না।

জানতে চাইলাম, শুয়েছ? কিরে-কাটার গলায় বলল, না। তা করিনি এখনও।

স্বাতীকে ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখাচ্ছে। ঠোটে অরেঞ্জ লিপস্টিক। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। হাতে কালো ডায়ালের ঘড়ি। সেই ঘড়ির কাটায় প্লাটিনামটুকু আমার প্রাণ। ইচ্ছে করলেই স্বাতী টিপে মেরে ফেলতে পারে। যৌবন দয়ালু হয়। যৌবন নিষ্ঠুর হয়। এখানে প্রার্থনার জায়গা নেই। আসলে ভালোবাসা ঠিক কোথায় থাকে? স্বাতী জানে ? পঙ্কজ জানে? শঙ্কর জানে? | ভালোবাসা শঙ্কর। ভালোবাসা, প্রেম—ও-সবই হল হরমোহন ঠাকুরের খেলা! ঠাকুর হরমমোহন দেবশর্মণঃ।

হরমোহন ঠাকুর ? সে কোন ঠাকুর রে ভাই? রবীন্দ্রনাথের কেউ?

আরে না! হরমোন শুনিসনি? প্রেম-ভালোবাসার আকাশে তিনিই সূর্য। ওই-যে র ভালো লাগেনা দেখলে আকুপাকু করিস—এসবই হরমোহন ঠাকুর র শরীরের ভেতর বসে করান। ওই-যে কে ঘাটের মড়া, মনটা র পচা-গলা হয়ে গেছে বলে কে জরুরি নোটিস দিয়েছে—এখুনি চলে এস, আমাকে নিয়ে থাক—নয় হাটো ! ওর মনেও হরমোহন ঠাকুর বসে বসে কলকাঠিটি নাড়ছেন। সময় নেই। আর সময় নেই। এখনই আমার পায়ে কিক আছে। এখনই। তিন তিনটে ক্লাব আমায় ডাকছে। এ দশায় কে বল এরিয়ান্সের তাঁবুতে থাকে? আবার এই হরমোহন ঠাকুরই কে ওর চোখে নবকার্তিকটি করে তুলেছিল একদিন।

ফের রাস্তায় নেমে এসে শঙ্কর ঘোষাল চৌরাস্তার মােড়ের দিকে এগোতে লাগল। এই হরমোহন লোকটা কে? সে আমাদের শরীরের ঠিক কোথায় থাকে? রক্তে? হাড়ে? মাংসে? ঘিলুতে? শুধু একজনকে আলাদা করে ভালো লাগে কেন? শুধু একজনের আমাকেই বা কখনও ভালো লাগবে কেন? সেই ভালোলাগায় কেন আনকোরা হয়ে যাই? সেই ভালো-না-লাগায় কেনই-বা ঘাটের মড়া হয়ে উঠি?

সরকার বলেছেন—পুজোর আগে কলকাতার সব রাস্তা সারানো হয়ে যাবে। একটা রোড রোলার ঢিমে তালে শঙ্করের আগে-আগে চৌরাস্তার মোড়ের দিকে চলেছে। এই রোডে রোলারের ভেতরে কোথাও কোনও হরমোহন ঠাকুর বসে নেই। ওর গড়ান আছে। ওজন আছে। সব স্টোনচিপ পিষে ময়দা করে গরম আলকাতরা দিয়ে মাখতে পারে। পুজোর আর দেরি নেই। কলকাতার সব রাস্তা এখন ওকে চাইছে। পচা-গলা ধসে-পড়া সব রাস্তাকে ও সমান-সরল- সিধে করতে করতে এগোবে। আনকোরা করে দেবে।

আমাদের দেশে এখন একশো জনে পঞ্চান্ন জনই ষাটের ওপর। ঠাকুর হরমোহন দেবশর্মণঃ এদের সবাইকে কি আনকোরা করে দিতে পারেন না?

৫১ পঠিত ... ১৬:৩৬, মার্চ ১৮, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top