একটা সময় দেশে বিদ্যুৎ ছিলো না। ছিলো না বলতে একেবারে ছিলো না, তা-না। ছিলো, তবে তা কালে ভদ্রে আসতো। বড়লোকদের বাড়িতে জেনারেটর, আই পি এস থাকলেও আমাদের বাসায় ছিলো হারিকেন কিংবা মোমবাতি। হারিকেনের আলোয় সুর করে ঝুলে ঝুলে আমরা পড়তাম। সেটা ২০০৪-০৫ এর কথা। এরপর একদিন হঠাৎ চোখ তুলে আবিষ্কার করি, চারদিকে কেবল আলোর ছটা। মনে হলো আসমান থেকে কেউ বুঝি বিশেষ তদারকির মাধ্যমে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের গিফট প্যাক পাঠাচ্ছে। এমনকি আমার দাদাবাড়ি চর নিজ আশাবটে—যেখানে ভ্যানগাড়ি পর্যন্ত যেতে চাইতো না, সেখানেও বিদ্যুৎ, আইপিএস হাজির। এ দৃশ্য হজম করতে আমার বেশ সময় লেগেছিলো। এমন অবস্থাকে আমি নাম দিয়েছিলাম ‘বিদ্যুৎপন্নমতি’—অর্থাৎ উপস্থিত বিদ্যুৎ আছে যার।
যাদের বিদ্যুৎ নিয়ে এতকাল ভোগান্তি ছিলো, তাদের কষ্ট ঘুচেছে আরও আগেই। তবে এখন শুরু হয়েছে হোসাইনদের কষ্ট। বৃহস্পতিবার ভারী বৃষ্টিতে মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে একই পরিবারের তিনজন সহ মোট চারজন বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায়। মিজান-মুক্তা দম্পতি, তাদের বড় কন্যা লিমা(৭) এবং লিমাকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারা যান অনিক নামের এক অটোরিকশাচালক।
ছোট্ট হোসাইন অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়ে এই মুহুর্তে সে আছে তার দাদার কাছে। একটু পর পর সে কাঁদছে। জন্মের পর থেকে যেসব মুখ দেখে সে বড় হচ্ছিলো, সেসব মানুষ এখন মর্গে। হোসাইনের কান্না থামছে না। সে যখন বড় হবে আমরা তাকে কী উত্তর দিবো? অবশ্য হোসাইনদেরকে উত্তর দেওয়ার জন্য আমরা দায়বদ্ধ নই। মাস পেরোলেই মানুষ ভুলে যাবে এই বস্তিবাসীর কথা। ইশ্বর থাকেন ভদ্রপল্লীতে, বেশিরভাগ মানুষও এখন ভদ্রপল্লীর বাসিন্দা। অশিক্ষিত, অস্বাস্থ্যকর, লো লিভিং স্ট্যান্ডার্ডসম্পন্ন বস্তিবাসীর শোকে আমরা বড়জোর এসির নিচে বসে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে পারি।
ঝিলপাড় বস্তিতে এক হাজারেরও বেশি বসবাসকারী পরিবারের অধিকাংশেরই বৈধ বিদ্যুৎ লাইন নেই। নিয়মিত তাদের একটি চক্র অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। চিন্তা করে দেখুন, দোষ আসলে বস্তিবাসীর না। এই সময়ে এসে জীবনযাপনের জন্য বিদ্যুৎ ছাড়া কিছু চিন্তা করতেও গায়ে অসহ্য জ্বালাপোড়া হয়। সে হিসেবে, যে কোনো মূল্যে তাদের বিদ্যুৎ চাই-ই। বিদ্যুৎ চাওয়া দোষের কেন হবে?
আবার যারা হুক দিয়ে মাটির উপরে নিচে অবৈধ ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে, দোষ তো তাদেরও না। ডিমান্ড সাপ্লাই কার্ভ পড়ে থাকলে জানতে পারবেন, ডিমান্ড থাকলে সাপ্লাই থাকবেই। এই স্লোপ সবসময় উর্ধ্বমুখী।
ডেসকোর পরিচালক মো. কাওসার আমির আলী বলেছেন, তাদের দায়িত্ব সংযোগ দেয়া মিটার পর্যন্ত। ভিতরের বিষয় তাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।
আবাসস্থল সুরক্ষিত না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু বস্তি ঠিক করার দায়িত্ব তো তাদের নয়। (তথ্যসূত্র: ইত্তেফাক) কাওসার সাহেবের কথাও আমার ভুল মনে হয়নি। এত এত কাজ থাকতে এক বস্তি ২৪ ঘণ্টা দেখভাল করে রাখা কি তাদের কাজ? উঁহু, তারাও আসলে নির্দোষ।
চিন্তা করে দেখলাম দোষ আসলে এই পরিবারটিরই।
এই ভারী বর্ষায় বাইরে থাকাই ছিলো তাদের মূল সমস্যা। ঘরে থেকে ঝরো ঝরো মুখরিত বাদল দিনে করলে তাদের এমন ভোগান্তিতে পড়তো না। অবশ্য তাদের আর ভোগান্তি কই? এই পরিবারের রেমন্যান্ট হিসেবে রয়ে গেছে সাত মাসের হোসাইন—পৃথিবী তার কাছ থেকেই হিসাব নিকাশ করে নেবে। যারা মরে যায়, তারা বেঁচে যায়। পরিবারহীনভাবে বেড়ে ওঠা কষ্ট আর ভোগান্তির মাঝে শিশু হোসাইন যখন বড় হবে, হয়তো তারও একদিন মনে হবে সে-ও ওই রাতে বিদ্যুতায়িত হলেই পারতো...
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন