উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার ওথেলো নাটকে দেখিয়েছেন, কীভাবে ওথেলো তার স্ত্রী ডেসডিমানাকে সন্দেহ করে অবশেষে হত্যা করে। ডেসডিমানার ঘরে একটি রুমাল পেয়ে; সেই রুমাল অন্য পুরুষের; সেই সন্দেহ ডালপালা মেলেছিলো ওথেলোর মনে। পশ্চিমা সমাজ এই সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত পুরুষ মন বা ওথেলো কমপ্লেক্স নিয়ে এর শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রে আলোচনা করেছে। যাতে এসব মনোজাগতিক সমস্যা দূর করে সমাজ মন দিতে পারে কাজের কাজে।
রবার্ট ব্রাউনিং-এর মাই লাস্ট ডাচেস কবিতায় একজন ডিউক তার স্ত্রীর পোট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করেন, তার এই প্রয়াত স্ত্রীর; যে চিত্রকরের মিউজ হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলো ডিউক। ডাচেস-এর মৃত্যুর কারণ অনুমান করা যায়। ঐ যে স্বামীর সন্দেহবাতিক।
পুরুষের এই সন্দেহ বাতিক থেকেই হালে ঢাকায় "সুড়ঙ্গে"র মতো নাটক নির্মিত হয়; কলকাতায় ‘অসমাপ্ত’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জিকে যেখানে অনেক পুরুষে আসক্ত দেখানো হয়েছে।
কৃষাণ চন্দরের ‘এক যুবতী হাজার প্রেমিক’ গল্পে একটি যুবতী মেয়ে একটি বাজারের মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে আপেলে কামড় দিয়ে ফেলে দিলে; বাজারের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে আপেলের ওপর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে জমিদার পত্নী বিমলা একজন ফ্রড দেশপ্রেমিক সন্দ্বীপের প্রেমে পড়ে। পরে যখন বুঝতে পারে সন্দ্বীপ আসলে লুণ্ঠনের জন্য রাজনীতি করে; খুব করে দেশপ্রেমের নাটক করে; তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে। বিমলার স্বামী তাকে ক্ষমা করে দেয় এই ভ্রান্তির জন্য।
কিন্তু আমাদের ফেসবুকের কোন বিমলা যেন ক্ষমার অযোগ্য। এইখানে ওথেলো যেন কাতারে কাতার। কোন একটি খবরে ‘নারী’ সংশ্লিষ্টতা থাকলেই; পৃথিবীর তাবত ব্যর্থ প্রেমিক ও প্রতারিত স্বামী যেন শকুনের মতো নেমে আসে ফেসবুক স্টেটাসে; মন্তব্যে খুবলে খায় নারীটিকে; শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তকের ‘হুরমতী’-র মতো তার কপালে ছ্যাঁকা দেয়া হয়।
ফেসবুকের এই পুরুষদের আলোচনা শুনলে মনে হবে যেন, এরা সব সাধু-সন্ন্যাসী; দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। আর তাদের সারিন্দা হয় কিছু সন্ন্যাসিনী; নিজেরা যেন ভাজা মাছ উলটে দিলেও বেছে খেতে পারবে না; এমন ভাব করে এসে বলে, কী দুঃশ্চরিত্রা, কত বড় সাহস! আমারে তো গাছের সঙ্গে বিয়া দিলেও সারাজীবন গাছের তলায় দুধ-পানি ঢেলে সংসার করবো!
এ প্রসঙ্গে একটি পুরোনো হিন্দী ছবির গল্প মনে পড়ে যায়। কাদের খান তার বন্ধুদের সঙ্গে শলা করে রাস্তায় দাঁড়ায়। যে মেয়েরা আসবে তাদের কুপ্রস্তাব দেবে বলে। এমন সময় একটি স্কার্ট পরা মেয়ে দেখে; সহজেই পটে যাবে এরকম ক্লিশে অনুমানে গিয়ে কুপ্রস্তাব দেয় কাদের খান। চড় খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে। এরপর দেখে মন্দিরে পূজা দিয়ে সাদা শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে একটি মেয়ে আসছে। ভয়ে ভয়ে নিশ্চিত চড় খাবে এই ধারণা নিয়ে গিয়ে কাদের খান তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। মেয়েটি অবাক করে দিয়ে বলে, ইধার নেহি উস গলিমে চলো!
দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষ মানসে এই যে নারীর পোশাক দেখে তার চরিত্র বিচার, ফেসবুকে এসে পর্দা-পুসিদা'র নসিহত; এগুলো প্রকৃষ্ট ওথেলোর লক্ষণ। এরা কোনমতে জীবনে একটা প্রেমিকা বা স্ত্রী পেলে তাকে ঢেকে ঢুকে সারাক্ষণ সিসিটিভির আওতায় রাখবে।
জীবনে নারীকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে ফেললে ওথেলো মানস তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এই ব্যাপারটা আমাদের সমাজে ঘটে। আর কবি-সাহিত্যিক-গায়কেরাও ‘তুমি তুমি’ করে জান দিয়ে ফেলায় ছেলেদের মনে ধারণা তৈরি হয় নারী মহার্ঘ্য বস্তু। এই কারণে একসময় ফিল্মের নায়িকারা গ্রীবা উঁচিয়ে ‘মাই ফুট’ বলে অবজ্ঞা করতো নায়ককে।
আবার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার যেহেতু অনেক তেলাঞ্জলি দিয়েও কাংক্ষিত নারীকে হাসিল করতে পারেনি; তাই চিত্রনাট্যে দেখায়, নায়ক গম্ভীর হয়ে আছে; আর নায়িকা গান গেয়ে গেয়ে তার পাত্তা তুলতে চেষ্টা করছে।
নারী-পুরুষের সমমর্যাদার সম্পর্ক, ফ্রেন্ড নট মাস্টার ধারণাটা সাহিত্য-সংগীত-চলচ্চিত্রে না থাকায়; বাস্তবজীবনেও এরকম অসমান ও অমসৃণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
আর একটু আভাগার্দ ফিল্ম বানাতে গিয়ে ভাই বেরাদারেরা নারীকে শিকারের হরিণী করে তুলেছে; পিঁপড়া বিদ্যা দিয়ে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়ার যে অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছে; তা অসংখ্য ওথেলো-কমপেক্স তৈরির মনোভূমি সৃষ্টি করেছে।
আর আছে সহমত ভাইদের বাবুবিলাস; ধন ধান্য পুত্রভরা বসুন্ধরার হারুন-শারুনের জুরিগাড়ি, মুনিয়ার ট্র্যাজেডি। প্রথম প্রজন্মের ক্ষমতায়িত নারীকে "মিসট্রেস হলে সোনার হরিণ পাবে" স্বপ্ন দেখিয়ে মাস্টাররা পিউ-পাপিয়ার আসর গড়েছে; পেটে একটু খুশিজল পড়লেই এরা মোবাইল গুঁতিয়ে শিকারের সন্ধান করে। এইভাবে উন্নয়নের শিব গড়তে বানর গড়েছে, সিঙ্গাপুর গড়তে ব্যাংকক গড়েছে; প্রেমিক দেবদাস গড়তে ওথেলো গড়েছে।
ভিলেজ পলিটিক্সের ভিনটেজ কাসুন্দি
এই যে যেসব সহমত ভাই ফেসবুকে এসে পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদাকে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে জ্ঞান জিজ্ঞাসা করছে; এটা তাদের জীনগত অনুসন্ধিৎসা থেকে তো অবশ্যই।
এরা সেই ঊনবিংশ শতকের বিজন গ্রামে বেড়ার ফাঁক দিয়ে গৃহের ভেতরে ফুচকি মারা নানী দাদীর নাতি। গৃহের ভেতরে ঝগড়ার শব্দ শুনে কানটা লম্বা করে বেড়ার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিতো যার গ্র্যানি। গৃহের লোক ব্যস্ত দেখে বাইরের লেবু গাছ থেকে টপাটপ কয়টা লেবু ছিঁড়ে আঁচলে বেঁধে রওনা হতো পাতকূয়াতলার দিকে।
সেইখানে এসে ঠারে ঠুরে হেঁয়ালি করে বুঝিয়ে দিতো, তার কাছে তথ্য আছে। বিনোদনহীন জীবনে ঢেউ জাগতো পাতূয়াবাসিনীদের। বানাইয়া ছানাইয়া ঐ গৃহের শয়ন কক্ষের গল্প বলে স্টোরি টেলার অফ দ্য ডে হয়ে যেতো সহমত ভাইয়ের গ্রানি।
এরপর সদলবলে রওনা হতো অকুস্থলের দিকে। গৃহস্বামী কলহ করে বেরিয়ে গেলেই গ্র্যানি গ্যাং ঢুকে পড়তো গৃহে। গৃহনারীকে শুরু করতো জেরা।
—তুমি যে মঘাশাস্ত্রীয় দাওয়াখানায় গেছিলা, স্বামীরে কওনাই ক্যান! রজব কিডা যে সে তুমার লগে দাওয়াখানায়। স্বামীর চাইতে রজব কী তর আপন হইলো, কথা কসনা ক্যা ও ঢে-নি মা-!
নাতি আইডেন্টিক্যাল জেনেটিক মিলে একই প্রশ্ন করেছে ফেসবুকে। ঠিকই ফেসবুকে পাতকূয়াতলার দ্যোতনা এনেছে।
তবে নাতি আরও চালাক লোক।
পুলিশ ছাত্রলীগের দাঁত ভেংগেছে, যেহেতু এ নিয়ে ছাত্রলীগ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করবে না বলে রফা হয়েছে; কারণ লাইলাতুল ইলেকশনের আগে ছাত্রলীগের দাঁতের চেয়ে পুলিশের ডেন্টাল ক্লিনিকের প্রয়োজন বেশি; তাই সহমত ভাই প্রসংগটা নিয়ে যাচ্ছে সানজিদার ব্যক্তি জীবনের কাসুন্দিতে। চ্যানেল আই, সময় টিভি এগুলো পাতকূয়া মিডিয়ার দায়িত্ব পালন করছে।
এসবই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ভিলেজ পলিটিকসের ভিনটেজ কাসুন্দি ঘাঁটার কায়দা কানুন। হুরমতীর কপালে আধুলির ছ্যাঁকা দেবার ছলে বাঁচিয়ে নেবে কানকাটা রমজানকে। কারণ লাইলাতুল ইলেকশনে কান কাটা রমজানকে লাগবে।
পোস্টমডার্ন কলতলা
ড্যান ব্রাউনের কিংবা অরুন্ধতী রায়ের বইয়ের প্রচ্ছদ, ফ্রিদা কাহালোর ছবি, কোন পশ আউটলেটে কফি পান, তাহেরির ওয়াজ নিয়ে হাসাহাসি, উচ্চাংগ সংগীতের আসরের ভিডিও ক্লিপ, নেট ফ্লিক্সের ভালো ভালো ছবির স্পয়লার দিয়ে এরপর একদিন ডারউইন নিয়ে আলাপ করলে; তাকে নিয়ে গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে।
কিন্তু হঠাৎ করে কোন খবরে কারো ব্যক্তি জীবনের সামান্য ইতিউতি বেরিয়ে আসা মাত্রই যখন হাকালুকি করে অন্যের প্রাইভেসিতে উঁকি দিয়ে বেডরুমের আলাপটা শুরু হয়, কমেন্টে এসে পুলকে খলসে মাছের মতো হুটোপুটি খায় কবিতা পড়ার প্রহরের বন্ধুরা; বোঝা যায় সকলই গরল সকলই ভেল।
শীর্ণ করপুট ভরি সুন্দরের দান, যতবার নিতে যাই, হে কলতলা! তুমি অগ্রে আসি করো তান!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন